একুশের প্রভাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে আসা অনেকেই যে ভিড় জমাতেন বইমেলায়; সেই চিত্র এবার পাল্টেছে। শুক্রবার মহান একুশে ফেব্রম্নয়ারির সকালে মেলা ছিল প্রায় 'জনশূন্য'। এদিন সকাল ৭টায় মেলার দুয়ার খুলে দেওয়া হলেও ৯টা পর্যন্ত একদমই দেখা মেলেনি দর্শনার্থীর। কোনো কোনো প্রকাশনীর স্টলও দেখা যায় বন্ধ ছিল এ সময়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেলায় পাঠক-দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। আর বিকালে ছিল জনস্রোত। এ সময় সারিবদ্ধভাবে পাঠক-দর্শনার্থীকে মেলায় প্রবেশ করতে দেখা যায়।
এদিকে, অন্যদিনের তুলনায় শুক্রবার বিক্রি বেশ ভালো বলে জানান বিক্রেতারা। পয়লা ফেব্রম্নয়ারি শুরু হওয়া মাসব্যাপি এবারের মেলায় বিক্রি সন্তোষজনক নয় বলে জানান বাংলানামা প্রকাশনীর প্রকাশক হোসেন শহীদ মজনু। তিনি বলেন, 'অন্যান্য বছর সাধারণত পয়লা ফাল্গুন থেকে বিক্রি বাড়তে থাকে। মেলার প্রথম সপ্তাহে একটু কম বিক্রি হয়। বসন্ত উৎসব আর একুশে ফেব্রম্নয়ারি থাকে প্রকাশকদের কাঙ্ক্ষিত দিন। এছাড়া শুক্র-শনিবারও লোক সমাগম হয়। বিক্রিও ভালো হয়। এবার বসন্ত এবং একুশে ফেব্রম্নয়ারি শুক্রবার হচ্ছে। ফলে শুক্রবারের ছুটির যে আলাদা আমেজ, তা মিলছে না। আর মেলার ২০ দিনে বিক্রি খুব একটা ভালো নয়।'
অন্যদিকে মহান একুশের দিনে ৩০৭টি নতুন বই এসেছে জানিয়েছে বাংলা একাডেমি। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে বাংলা একাডেমি বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করে। রাত সাড়ে ১২টায় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজমের নেতৃত্বে বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে দিনের কর্মসূচি শুরু হয়। সকাল ৮টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর। স্বরচিত কবিতাপাঠে প্রায় দেড় শতাধিক কবি কবিতা পাঠ করেন। সভাপতিত্ব করেন কবি হাসান হাফিজ।
বিকালে বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় অমর একুশে বক্তৃতা ২০২৫। এতে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। 'ভাষার লড়াই, গণ-অভু্যত্থান ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন' শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক।
স্বাগত বক্তব্যে অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, 'একুশের চেতনা আমাদের মাঝে এক প্রাত্যহিক বর্তমানময়তা হয়ে সতেজ রূপে বহমান আছে। একুশ অতীত নয়, এটি প্রকৃতপক্ষেই বর্তমান। বাংলাদেশের ইতিহাসে ৫২-র একুশে ফেব্রম্নয়ারি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভু্যদয়, এর পরবর্তী ন্যায্যতা ও পূর্ববর্তী প্রেক্ষাপট-এই তিন ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা পালন করেছিল। তাই সংগত কারণেই একুশে ফেব্রম্নয়ারি বাংলাদেশের মানুষকে অন্তরঙ্গতায় এবং আবেগময়তায় সিক্ত করে।'
প্রাবন্ধিক বলেন, '১৯৪৮ সালে শুরু হয়ে মাতৃভাষার অধিকার এবং পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাভাষা প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিক আন্দোলন ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রম্নয়ারি শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেছিল। ভাষা আন্দোলনের প্রেরণাই ছিল পরবর্তী ঊনসত্তরের গণঅভু্যত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলন এবং চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণ-অভু্যত্থানের শক্তি। ন্যায়সংগত, বৈষম্যমুক্ত সমাজের আকাঙ্ক্ষা নিয়েই আমরা মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে নিরন্তর সংগ্রাম করেছি। এই পরিপ্রেক্ষিতে ন্যায়ভিত্তিক বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আমরা আজ প্রথমেই প্রশ্ন তুলতে পারি মাতৃভাষার অধিকার এবং নির্দিষ্টভাবে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার অবস্থান নিয়ে। প্রকৃতপক্ষে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হলে বৈষম্যের উৎস নির্মূল করতে হবে। সত্যিকারভাবে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে অগ্রহসর হতে গেলে পরিবর্তনের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও দার্শনিক অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে।'
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, 'ইতিহাস কেবল অতীতের বিষয়ই নয়। এটি পরিবর্তনের রহস্য উদ্ঘাটনের বিদ্যা। জাতীয় সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে আমাদেরকে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক ও জাতীয় সংগ্রামের ইতিহাস সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত হতে হবে। এর মাধ্যমেই আমরা একটি উন্নত ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য অগ্রসর হতে পারব।'
লেখক বলছি মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন- কবি মোহন রায়হান এবং কবি আবিদ আজম। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেন কবি রুম্মানা জান্নাত, কবি নিলয় রফিক ও কবি কাজিম রেজা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী শাহিন পারভীন, অধরা সরকার রিয়া, এ কে এম সাইদ হোসেন, তাহরিমা বতুল রিভা, লায়েকা বশীর, বিটু কুমার শীল, শেখ জেরিন শবনম, সৈয়দা সনজিদা জোহরা বীথিকা, শ্রাবণী পাইক, আরিফা নিশাত, বিভাস রঞ্জন মৈত্র, প্রেমা দাস। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন শিমুল বড়ুয়া (তবলা), রাজিব আহমেদ (কী-বোর্ড), মো. মেজবাহ উদ্দিন (অক্টোপ্যাড), সাইদ হাসান ফারুকী (লিড গীটার) এবং পলস্নব দাস (বেইজ গীটার)।
আজ বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে 'জীবন ও কর্ম : কায়কোবাদ' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইমরান কামাল। আলোচনায় অংশ নেবেন হাবিব আর রহমান। সভাপতিত্ব করবেন আবু দায়েন।