পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে মাস দুয়েক ধরে নিত্যপণ্যের আমদানি বেড়েছে। জানুয়ারি মাসে বিপুল পরিমাণ নিত্যপণ্য আমদানি হয়েছে, যা অনেক ক্ষেত্রে পুরো রোজার মাসের চাহিদার সমান। কিছু ক্ষেত্রে আমদানি রোজার চাহিদাকেও ছাড়িয়ে গেছে। এরপর ফেব্রম্নয়ারি মাসজুড়ে আরও নিত্যপণ্য আমদানি হচ্ছে। এতে সরবরাহে কোনো ধরনের ঘাটতি না থাকার কথা থাকলে খুচরা বাজারে এর উল্টো চিত্রের দেখা মিলছে।
বাজার পর্যবেক্ষকরা জানান, ভোজ্যতেল, ছোলা, খেজুরসহ রোজার অধিকাংশ পণ্যের মজুত বাড়লেও সরবরাহ এখনো স্বাভাবিক হয়নি। ফলে রোজা শুরুর আর মাত্র সপ্তাহখানেক বাকি থাকলেও এসব পণ্যের দাম এখনো চড়া। যদিও বেশকিছু ক্ষেত্রে পাইকারিতে দাম বেশকিছুটা কমানো হয়েছে। তবু খুচরা বিক্রেতারা বাজার সিন্ডিকেটের কারসাজির অজুহাত তুলে চড়া দামেই পণ্য বিক্রি করছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বড় কয়েকটি শিল্প গ্রম্নপের আমদানি কমে যাওয়ায় বাজারে সরবরাহে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু বাস্তবে তেমনটি ঘটেনি। পুরনো আমদানিকারকদের কেউ কেউ নতুন করে সক্রিয় হয়েছেন। নতুন নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নিত্যপণ্য আমদানিতে যুক্ত হয়েছে। ফলে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এবারের রোজার পণ্য আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া, আমদানি বাড়ানো ও মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে অন্তর্বর্তী সরকার ভোজ্যতেল, চিনি, পেঁয়াজ, আলু, খেজুরসহ বিভিন্ন পণ্যে শুল্ক ছাড় দিয়েছে। পাশাপাশি ঋণপত্র খুলতে মার্কিন ডলারের সংকটও অনেকটা কেটেছে। সব মিলিয়ে আমদানিতে উৎসাহ বেড়েছে। তবে এরপরও রোজার পণ্যের বাজার কেন অস্থির তা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে এখনো অজানা রয়েছে।
শুক্রবার রাজধানীর মালিবাগ, রামপুরা, যাত্রাবাড়ি, কারওয়ান বাজারসহ এক ডজন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সবখানেই বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট রয়েছে। কয়েক দোকান ঘুরেও ক্রেতারা চাহিদা অনুযায়ী বোতলজাত সয়াবিন তেল কিনতে ব্যর্থ হচ্ছে। কবে নাগাদ বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক হবে, সেটিও জানাতে পারছেন না বিক্রেতারা।
বিক্রেতারা জানান, গত নভেম্বর মাস থেকেই বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট চলছে। মাঝের সময়ে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে আট টাকা বাড়ানোর পরে সরবরাহের সংকট কিছুটা কমেছিল। তবে চলতি মাসের শুরু থেকে আবার তীব্র হয়েছে এ সংকট।
অথচ গত ১২ ফেব্রম্নয়ারি সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশিরউদ্দীন আশ্বাস দিয়েছিলেন, পরবর্তী ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ভোজ্যতেলের বাজার স্থিতিশীল হবে। এরপর গত রোববার ভোজ্যতেল পরিশোধন ও বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, আসন্ন পবিত্র রমজান সামনে রেখে বাজারে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি ভোজ্যতেল সরবরাহ করা হচ্ছে। তাই রমজানে বাজারে ভোজ্যতেল সরবরাহে কোনো সংকটের আশঙ্কা নেই।
টিসিবির তথ্য অনুসারে, গত এক মাসে খুচরা পর্যায়ে খোলা সয়াবিনের দাম প্রতি লিটারে ২০ টাকা বেড়েছে। এর মধ্যে এক সপ্তাহের ব্যবধানে খোলা সয়াবিনের দাম লিটারে পাঁচ টাকা বেড়েছে।
এদিকে চাহিদার তুলনায় বেশি আমদানি হলেও এবং দেশে এ বছর উৎপাদন ভালো হলেও ছোলার দাম কেজিপ্রতি ১৫ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে। গত বছর রোজার আগে এই সময় মান ভেদে যেখানে কেজিপ্রতি ছোলার দাম ছিল ৭৫ থেকে ৯৫ টাকা এখন তা বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১১৫ টাকা। পরিবহণ খরচ ও ডলারের বিনিময়মূল্য বৃদ্ধির কারণে ছোলার দাম বাড়াতে হয়েছে বলে অজুহাত তুলেছেন ব্যবসায়ীরা।
ট্যারিফ কমিশনের হিসেবে রোজায় ছোলার চাহিদা এক লাখ টন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত আড়াই মাসে (ডিসেম্বর-ফেব্রম্নয়ারি) প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার টন ছোলা আমদানি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৮৯ টন ছোলা। সেই হিসেবে এবার আমদানি গত বছরের তুলনায় প্রায় ৭১ হাজার টন বা ৮০ শতাংশ বেশি হয়েছে। ইতিমধ্যে আরও ছোলা আমদানির পথে।
আমদানিকারকেরা বলছেন, রোজার মাস ছাড়া অন্য মাসগুলোতে দেশে প্রতি মাসে গড়ে ১০ হাজার টন ছোলার চাহিদা থাকে। সেই হিসেবে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রম্নয়ারি, এই তিন মাসের ৩০ হাজার টন চাহিদা বাদ দিলেও আমদানি করা আরও ১ লাখ ৩০ হাজার টন ছোলার সরবরাহের জন্য অবশিষ্ট থাকবে।
তাহলে রমজানের চাহিদার তুলনায় এই অল্প সময়ে এত বেশি ছোলা আমদানি করা হলো কেন তা খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, রমজান সামনে রেখে গত জানুয়ারি মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় আটটি খাদ্যপণ্য বাকিতে আমদানির সুযোগ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ছোলা, ডাল ও মটর রয়েছে। এসব পণ্য ৯০ দিনের সাপস্নায়ার্স বা বায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়। এই সুবিধায় আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত এসব পণ্য আমদানি করা যাবে। এই সুযোগ দেওয়ার পর আমদানিকারকরা বিপুল পরিমাণ ছোলা আমদানি করেছে, যা তারা রোজার চাহিদা মিটিয়ে বছরের বাকি সময় বেচবে।
টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের এপ্রিলে রোজা শুরুর আগে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ছোলার দাম ছিল গড়ে ৭৫ টাকা। রোজা শুরুর পর সেই দাম কমে ৭০ টাকায় নেমে আসে। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে রোজার আগের মাসের তুলনায় রোজার মাসে ছোলার দামের খুব বেশি হেরফের হয়নি। অথচ এ বছর পাইকারী বাজারেই প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৯২ থেকে ১০৫ টাকা।
এদিকে রমজানে খেজুরের দাম সহনীয় রাখতে গত ২২ নভেম্বর আমদানি শুল্ক ও অগ্রিম আয়কর (এআইটি) কমিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর মধ্যে বিদ্যমান কাস্টমস ডিউটি ২৫ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ, অগ্রিম আয়কর ১০ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। অথচ সরকারের নজরদারি না থাকায আমদানির চেয়ে দ্বিগুণ দামে খেজুর বিক্রি হচ্ছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত গত এক বছরে ১৭৫ জন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ৭৩ হাজার ৯১৭ মেট্রিক টন খেজুর আমদানি করেছে। আমদানি করা খেজুরগুলোর শুল্কায়ন মূল্য ছিল ১ হাজার ৫৯৬ কোটি ৪৯ লাখ ২ হাজার ২৬৩ টাকা।
প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব খেজুর আমদানি করেছে সেগুলোর বিল অব এন্ট্রি বিশ্লেষণ কওে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি কেজি খেজুর সর্বোচ্চ ৪ ডলার এবং সর্বনিম্ন এক ডলার আমদানি মূল্য দেখিয়ে পণ্যটি খালাস করেছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ খেজুর আমদানি হয়েছে তিন ডলারের নিচে। প্রতি ডলার ১২৫ টাকা হিসেবে ধরলে এই হিসাবে এক কেজি খেজুরের সর্বোচ্চ আমদানি মূল্য ছিল ৫০০ টাকা এবং সর্বনিম্ন আমদানি মূল্য ছিল ১২৫ টাকা। এর সঙ্গে প্রতি ৫০ শতাংশ শুল্ককর যোগ করলে ভালো মানের প্রতি কেজি খেজুরের দাম পড়ে ৭৫০ টাকা। কম দামের প্রতি কেজি খেজুরের দাম পড়ে ১৮৭ টাকা।
কিন্তু খেজুরের অন্যতম পাইকারি বাজার চট্টগ্রাম নগরীর ফলমন্ডি এলাকায় নিম্নমানের খেজুর বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩৫০ টাকায়। আর আজওয়া, মরিয়ম, মাবরুমসহ ভালো মানের খেজুর প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে এক হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১৫০০-১৬০০ টাকায়।
এদিকে সারা বছর বিদেশি ফল কিনতে না পারলেও নিম্নমধ্যবিত্ত অনেকেই রমজানে ইফতারির পেস্নটে এক-দুই টুকরো রাখার চেষ্টা করেন। তবে এবার তাতেও লাগাম টানতে হচ্ছে। কেননা এক মাসের ব্যবধানে বিদেশি আট ধরনের ফলের দাম বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। এর মধ্যে আনারের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ, চায়না কেনু কমলার দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ, মালটার বেড়েছে ২০ শতাংশ, নাশপাতির বেড়েছে ১৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ, আঙুরের বেড়েছে ২০ শতাংশ ও আপেলের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ। এসব ফলের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে।
জানা গেছে, গত মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদেশি ফলের দাম বেড়ে গেছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, বিভিন্ন ফলের দোকানে আনার প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ টাকায়, এক মাস আগে যার দাম ছিল ৪৫০ টাকা। এ ছাড়া চায়না কমলা এক মাস আগে বিক্রি হতো ২৫০ টাকায়, এখন বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়, মালটা ২৪০ টাকা থেকে বেড়ে ৩০০ টাকা, কেনু ২০০ টাকা থেকে বেড়ে ২৫০ টাকা, আপেল ২৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৩০০ টাকা, নাশপাতি ৩০০ টাকা থেকে বেড়ে ৩৫০ টাকা, কালো আঙুর ৪০০ টাকা থেকে বেড়ে ৪৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সবুজ আঙুর বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকায়।
ফল ব্যবসায়ীরা জানান, আমদানি পর্যায়ে শুল্ককর বা ভ্যাট বাড়ানোর খবরেই বাজারে ফলের দাম বেড়েছে। তবে শুল্ককর কমানোর জন্য চট্টগ্রামের ফলমন্ডিতে আন্দোলন করেছেন ফল ব্যবসায়ীরা। মানববন্ধন করার পাশাপাশি বিদেশ থেকে আমদানি করা ফল খালাস না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা।
চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা সৈয়দ মুনিরুল হক জানিয়েছেন, বিদেশি ফলের আমদানিতে শুল্ক বৃদ্ধির ঘোষণায় আমদানিকারকরা আন্দোলন শুরু করেছেন। ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ফলের চালান খালাস করেননি গত কয়েক দিন ধরে। এতে বাজারে প্রভাব পড়েছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, আসন্ন পবিত্র রমজানে চাল, ডাল, ছোলা, তেল, চিনি, খেজুর, বিদেশি কিছু ফল, পেঁয়াজ, গরুর মাংস, দুধ, ডিম, মুরগিসহ ১২ থেকে ১৫ ধরনের পণ্যের বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়। প্রতিবছরের মতো এবারও বাড়তি চাহিদার সুযোগ নিচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। সরবরাহের সংকট দেখিয়ে কোনো না কোনো পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন তারা। যদিও প্রতিবছরের মতো এবার রমজানে নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা ঠেকাতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আমদানিতে শুল্কছাড়, বাজার মনিটরিং ও টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিক্রি আগেই ছিল। এখন এই ভর্তুকি মূল্যের পণ্য বিক্রি, বাজার মনিটরিং আরও বাড়ানোসহ বাড়তি কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এসব পদক্ষেপে বাজার নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে আশা করলেও আস্থার সংকট কাটেনি ভোক্তার।
বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তা গতানুগতিক। এতে নতুনত্ব কিছু নেই। তা ছাড়া প্রয়োজনের তুলনায় ব্যবস্থা অপ্রতুল। এবার টিসিবির কার্ডের মাধ্যমে তেল, চিনি, ডাল, ছোলাসহ রমজানের পণ্য পাবেন না প্রায় ৪৩ লাখ পরিবার। তাই সরকারিভাবে এসব পণ্যের জোগান বাড়াতে হবে। আর তদারকিতেও দুর্বলতা রয়েছে, যার কারণে ভোজ্যতেলের বাজার এখনো স্বাভাবিক হয়নি। অথচ জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বাজার তদারকির পাশাপাশি ঢাকা মহানগরীর বাজারগুলোতে নিত্যপণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে তিনটি দল গঠন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। গত মঙ্গলবার থেকে এই টিম বাজার তদারকি শুরু করেছে। এছাড়া, অধিদপ্তরের মাধ্যমে নিয়মিতভাবে ৬টি দল কাজ করছে। রমজানে আরও ৪টি দল বাড়ানো হবে। এছাড়া, টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড পূর্ণাঙ্গ করা, হিমাগারের ভাড়াবৃদ্ধির সমস্যা নিরসন, সয়াবিন তেলের সংকট দূর করা, পাহাড়ি ও দুর্গম অঞ্চলে টিসিবির পণ্য পরিবহণে সুবিধা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, রমজানে সাধারণ ভোক্তা ও নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনায় রেখে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে প্রতিদিন অন্তত ৬০ হাজার পিস ডিম, ৬ হাজার লিটার দুধ, ২ হাজার কেজি ব্রয়লার মুরগির মাংস এবং ২ থেকে আড়াই হাজার কেজি গরুর মাংস বিক্রির পরিকল্পনা নিয়েছে মন্ত্রণালয়। ঢাকা শহরে ২৫টি জায়গায় এসব পণ্য বিক্রি করা হবে।
তবে এসব উদ্যোগ খুব বেশি কাজে লাগবে বলে মনে করেন না বাজার পর্যবেক্ষকরা। তাদের আশঙ্কা, রোজার আগেই যেভাবে বাজার চড়তে শুরু করেছে, তাতে রোজা শুরুর পর এতে লাগাম টানা কঠিন হবে। দেশের খামারগুলোতে পর্যাপ্ত মুরগি থাকলেও এক সপ্তাহের ব্যবধানে দাম কেজিপ্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকা বৃদ্ধিতে সে আলামতই দেখা যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে কনজু্যমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, রোজায় যেসব পণ্যের চাহিদা বাড়ে, এ বছর সেসব পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। এমনকি ভোজ্যতেলের মজুতও পর্যাপ্ত। কিন্তু সমস্যা হলো কার্যকর মনিটরিংয়ের ঘাটতি। রোজার সময় ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে বাজার অস্থির করে তোলে। আশা ছিল, বর্তমান সরকার আগের সরকারের দুর্বল দিকগুলো নজরে রেখে এবার বাড়তি কিছু পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু গতানুগতিকের বাইরে যেতে পারেনি তারাও।
নাজের হোসেন বলেন, 'তেলের বাজারে সমস্যাগুলো সমাধান হয়নি। বাণিজ্য উপদেষ্টা বারবার বলছে এক সপ্তাহের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঠিক করার পদক্ষেপ দেখছি না। ব্যবসায়ীরা যখন চাইবেন, এই সমস্যা শেষ হবে। কিন্তু ততক্ষণে তাদের বাড়তি মুনাফা করা হয়ে যাবে।'
এদিকে ভোক্তাদের অভিযোগ, শুধু ইফতারি কিংবা সেহেরির খাবারই নয়, সহ সবধরনের নিত্য খাদ্যপণ্যের দামই লাগামহীনভাবে বেড়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের নির্দেশনা এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিদপ্তরসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার তদারকি কোনো কিছুই তেমন কাজে আসেনি। বরং সংঘবদ্ধ বাজার সিন্ডিকেট সরকারি তদারকি সংস্থাগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আমদানি নির্ভর কোনো কোনো পণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বাড়িয়েছে। যার প্রভাব দেশে উৎপাদিত পণ্যের ওপর পড়ায় বাজার আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে।
যদিও বাজার পর্যবেক্ষকরা অনেকে এজন্য অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেটের চেয়ে ভোক্তাদের বেশি দায়ী করেছেন। তাদের ভাষ্য, রমজান শুরুর সপ্তাহখানেক আগে থেকেই অধিকাংশ মানুষ ছোলা, সয়াবিন তেলসহ ইফতারিতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পণ্যের পাশাপাশি অন্যান্য খাদ্যসামগ্রীও একসঙ্গে অধিক পরিমাণে কিনতে শুরু করেছে। এতে এসব পণ্যের চাহিদা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে এক লাফে দুই-তিনগুণ কিংবা তার চেয়ে আরও বেশি বেড়েছে। সে তুলনায় সরবরাহ না বাড়ায় বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। ভোক্তারা একসঙ্গে এক মাসের বাজার না করে ৪/৫ দিন কিংবা সর্বোচ্চ এক সপ্তাহের বাজার করলে এ সংকট তৈরি হতো না।
তাদের এ অনুমান যে অমূলক নয়, তা সোমবার কারওয়ানবাজার, মালিবাগ, যাত্রাবাড়ী, হাতিরপুলসহ রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে প্রমাণ পাওয়া গেছে। সপ্তাহিক ছুটির দিন না হলেও প্রতিটি বাজারে কিছু ক্রেতাদের অস্বাভাবিক ভিড়। বেশির ভাগ ক্রেতাকে মাছ-মাংস, চাল-ডাল, তেল-পেঁয়াজসহ সব ধরনের পণ্য একসঙ্গে এক মাসের কিনতে দেখা গেছে। দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বাভাবিক সময়ে দোকানে এক সপ্তাহে যে পরিমাণ মাল বিক্রি হয়, এখন প্রতিদিন তার চেয়েও বেশি বিক্রি হচ্ছে। ফলে প্রায় প্রতিদিন নতুন করে মাল কিনতে তাদের পাইকারি মার্কেটে ছুটতে হয়েছে। সরবরাহের তুলনায় চাহিদা আকস্মিক কয়েক গুন বেড়ে যাওয়ায় সুযোগ বুঝে পাইকারি ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
তবে শুধু এ ইসু্যতেই বাজার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে, এমন অভিযোগ মেনে নিতে চাননি অর্থনীতিবিদদের অনেকেই। তাদের ভাষ্য, প্রতিবছর রমজানের আগে ইফতারিতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের চাহিদা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কয়েক গুন বেড়ে যাওয়াটা খুবই গতানুগতিক। এ হিসাব বিবেচনায় রেখেই সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো সে ব্যাপারে যথেষ্ট দক্ষতা দেখাতে পারেনি। যার সুযোগ নিয়ে বাজার সিন্ডিকেট মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছে।