ভাষা আন্দোলনের মিছিলে প্রথম গুলি চলে যশোরে
প্রকাশ | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
মিলন রহমান, যশোর
যশোরে ভাষা আন্দোলনের বীজ বোপিত হয় ৪৭ এ দেশভাগের আগেই। ১৯৪৭ সালে যশোরে ভাষা আন্দোলনের বীজ বোপিত হওয়ার পর ঢাকা তথা সারাদেশের সাথেই ৫২ পর্যন্ত চলেছে ভাষা সংগ্রাম। তবে ভাষার দাবিতে যশোরেই প্রথম চলেছে গুলি; ঝরেছে রক্ত। ১৯৪৮ সালের ১৩ মার্চ ভাষার জন্য মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ। মার্চের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলো উঠে এসেছে ভাষা নিয়ে গবেষণাকারীদের তথ্য ও প্রকাশনায়। যদিও ইতিহাস সাক্ষ্য দিলেও কালের গহ্বরে হারিয়ে যেতে বসেছে সেই আন্দোলনমুখর ঘটনাপ্রবাহ। ভাষা আন্দোলন নিয়ে একাধিক গবেষকের গবেষণায় সেই ইতিহাস উঠে এসেছে।
যশোরের ভাষা আন্দোলনের গবেষক কবি সাইদ হাফিজ বলেন, 'ভাষা আন্দোলনের শুরুর দিকে ঢাকার আগে যশোরে প্রথম আন্দোলন গড়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালের জুলাইয়ে 'দৈনিক আজাদ' পত্রিকায় বাংলা ভাষাবিরোধী একটি লেখার প্রতিবাদে মাইকেল মধুসূদন (এম.এম) কলেজের ছাত্র ফেডারেশনের কর্মী হামিদা রহমান একটি পত্র লেখেন। ১০ জুলাই 'পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' শিরোনামে কলকাতা থেকে প্রকাশিত 'স্বাধীনতা' পত্রিকায় লেখাটি প্রকাশিত হয়। এর মধ্য দিয়েই যশোরে ভাষা আন্দোলনের বীজ রোপিত হয়। তখনও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়নি।'
'যশোরের ভাষা আন্দোলন' গ্রন্থে প্রয়াত কবি ও খ্যাতিমান সাংবাদিক ফখরে আলমও এই তথ্য উলেস্নখ করে লিখেছেন, বিচারপতি কেএম সোবহান ১৯৮৮ সালের ২২ ফেব্রম্নয়ারি 'সংবাদে' প্রকাশিত 'একুশের চিন্তা' প্রবন্ধে হামিদা রহমানের এই চিঠি সম্পর্কে লিখেছেন, 'ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত বলা যায় এখান থেকেই।'
১৯৪৮ সালের ১০ মার্চ জেলা প্রশাসক শহরে ১৪৪ ধারা জারি করেন। ছাত্র নেতারা কলেজে জরুরি বৈঠক করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ ও মিছিল মিটিং করার আহ্বান জানান। ১১ মার্চ শহরে মিছিল ও ধর্মঘট পালিত হয়। সেই দিনই পুলিশ ৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করে। আর ১৩ মার্চের মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ।
'যশোরের ভাষা আন্দোলন' গ্রন্থে কবি ও সাংবাদিক ফখরে আলম লিখেছেন, ১২ মার্চ ছাত্র ধর্মঘট এবং ১৩ মার্চ শহরে আবারও মিছিল হয়। ওই মিছিলে প্রায় ৩ হাজার মানুষ অংশ নেন। ১৩ মার্চ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি যশোরের সব শ্রেণি পেশার মানুষ রাজপথে নেমে আসে। সকাল ১০টায় যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজ থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। এই মিছিলে সব শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণের পাশাপাশি সরকারি কর্মচারীরাও যোগ দেন। মিছিলটি শহর প্রদক্ষিণ করে চৌরাস্তা থেকে ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যালয় যশোর কালেক্টরেট ভবনের দিকে এগোনোর চেষ্টা করলে দড়াটানায় পুলিশ বাঁধা দেয়। যশোর কোতোয়ালি থানার ওসি আব্দুল জব্বারের নেতৃত্বে পুলিশ মিছিলের উপর হামলা চালায়। বেধড়ক লাঠিচার্জ করে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে দেয়। কিন্তু সংগ্রামী ছাত্র-জনতা একত্রিত হয়ে পুলিশের হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পুলিশের উপর ইট-পাটকেল ছোড়ে। ছাত্রদের সহযোগিতার জন্য রিকসাওয়ালা, শ্রমিক, দোকানদাররা এগিয়ে আসেন। তারাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছোড়েন। এক পর্যায়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ডা. জীবন রতন ধর, আলমগীর সিদ্দিকী, আফসার আহম্মেদ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কালেক্টরেট ভবনে ঢুকে জানালা, দরজা ভাঙচুর করেন। ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট ইএ নোমানীর অফিসেও হামলা চালান। ছাত্রদের ইটের আঘাতে আহত হন ওসি আব্দুল জব্বার। কোতোয়ালি থানার দারোগা ফামউদ্দিনের মাথা ফেটে যায়। ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশকে গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। পুলিশ ছাত্র-জনতার উপর গুলি চালানো শুরু করে। গুলিতে সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম-আহবায়ক আলমগীর সিদ্দিকী আহত হন। তাঁর পায়ে গুলি লাগে। ১৩ মার্চ পুলিশের গুলি চালানোর এই ঘটনাটি ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর প্রথম গুলি বর্ষণের ঘটনা। এই গুলিবর্ষণের ঘটনায় পুরো যশোর শহর বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। অন্যদিকে পুলিশও বেপরোয়া হয়ে নির্যাতন চালানো শুরু করে। এসবের প্রতিবাদে ১৪ মার্চ শহরে আবার হরতাল পালিত হয়। এরপরও লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকে।
১৯৪৮ সালের ২ মার্চ সরকারি নীতির প্রতিবাদে পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী যশোরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভাষা আন্দোলনের প্রথম ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘটের সমর্থনে কলেজে এবং শহরে মিছিল মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। মিছিলকারীরা জিলা স্কুল থেকে ছাত্রদের বের করে আনেন। ৭ মার্চ পুনরায় যশোরে 'রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ'এর সভা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ৮ ও ৯ মার্চ প্রতিদিনই ১১ মার্চের ধর্মঘটের সমর্থনে যশোরে মিছিল মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। ১০ মার্চ যশোরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইএ নোমানী শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে সকল শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভ মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এই ঘোষণা শুনে ঐদিন বিকাল ৪টায় ছাত্র নেতৃবৃন্দ নতুন পরিস্থিতিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য 'রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ'-এর জরুরী বৈঠক আহবান করেন। এতে সভাপতিত্ব করেন ডা. ক্যাপ্টেন জীবন রতন ধর।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় ছাত্ররা সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সিদ্ধান্ত নেন ১১ মার্চ ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে সকাল ১০টায় সরকারি এমএম কলেজ থেকে প্রথম মিছিল বের হবে, সমর্থনকারীরা সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মিছিলে সামিল করে সারা শহর প্রদক্ষিণ করবেন এবং মিছিল শেষে ট্রেডিং ব্যাংক ময়দানে বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হবে।
বেলা ১১টার দিকে সেখান থেকে বিরাট একটি যৌথ মিছিল বের হয়। তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাস বর্জনের আহ্বান জানান। এ সময় মিছিলকারীদের কাছে সংবাদ আসে মোমিন গার্লস স্কুল (বর্তমান যশোর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়) ও যশোর পিটিআই স্কুল কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের ধর্মঘট ও মিছিলে যোগ দিতে বাধা সৃষ্টি করছে। খবর শুনে পুরো মিছিলটি সেখানে পৌঁছায় এবং সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা শুনে ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিলে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ঐ সময় মোমিন গার্লস স্কুলে পড়তেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইএ নোমানী সাহেবের মেয়ে। মেয়েদের মিছিলে অংশগ্রহণ করতে তিনি প্রচন্ড বাধা দেন। মেয়েদের স্কুল থেকে বের করতে হামিদা রহমান সেদিন বিপস্নবী ভূমিকা পালন করেছিলেন। হামিদা রহমান তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন এবং সম্ভবত তার একটি দাঁত ভেঙ্গে যায়। এ সময় ভাষাসৈনিক হামিদা রহমান স্কুলে ঢুকে ক্লাস থেকে ছাত্রীদের বের করে আনেন। পিটিআই এর তদানীন্তন প্রধান শিক্ষক বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাস বর্জন করে মিছিলে যোগ দেন। এরপর যশোরের সর্বস্তরের মানুষ মিছিলে অংশ নেন। প্রায় এক মাইল দীর্ঘ ঐ মিছিলটি তৎকালীন সময়ের একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। পুলিশের এক বিরাট বাহিনী মিছিলকে অনুসরণ করে চললো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় তারা মিছিলে আক্রমণ করলো না। সুদীর্ঘ মিছিলটি হৃদয়ের সব আবেগ ঢেলে দিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে আকাশ ফাটা শ্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে চললো। পিটিআই সড়ক দিয়ে রেল রোড ও ভোলা ট্যাঙ্ক থেকে বামে ঘুরে জিলা স্কুলের দিক থেকে বার লাইব্রেরির সামনে দিয়ে ট্রেডিং ব্যাংকের দিকে এগোতেই জেলা কাউন্সিলের তরুণতম চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মশিয়ূর রহমান 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' শ্লোগান দিয়ে মিছিলের পুরোভাগে এসে ভিড়লেন। তাঁর সাথে যোগ দেন আরও কয়েকজন আইনজীবী। মিছিলে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতা অ্যাডভোকেট মশিয়ূর রহমানকে করতালি দিয়ে বরণ করে নেন। মিছিল শেষে বেলা ১টার দিকে শহরের ট্রেডিং ব্যাংক মাঠে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
মিটিং শেষ হওয়ার সাথে সাথে পুলিশ পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে। বর্তমান পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসের সামনে থেকে মশিয়ূর রহমান, রণজিৎ মিত্র, এসএমএইচ জিন্নাহ, আবদুর রাকীব, অনন্ত মিত্র, পবিত্র ধর, রবি কুমার, হাবিবুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক, গোলাম মোর্তজা, লুৎফর রহমান, সৈয়দ আফজাল হোসেন, আমিনুল ইসলাম, ইমান আলীসহ মোট ১৪ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ছাত্র-কর্মীগণ গ্রেফতারকৃত নেতাদের মুক্তির দাবিতে কোর্টের সামনে জড়ো হয়ে মিছিল করেন। পুলিশ লাঠিচার্জ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে বন্দিদের দ্রম্নত জেলখানায় নিয়ে যান। শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে ঐদিনই পুলিশ আরও ২০/৩০ জনকে গ্রেফতার করে।
এ ঘটনার প্রেক্ষাপটে রাতে এমএম কলেজের পুরনো হোস্টেল ভবনের ছাদে ছাত্র নেতৃবৃন্দ সংগ্রাম পরিষদের পরবর্তী করণীয় বিষয়ে জরুরী সভা আহবান করেন। একমাত্র ডা. ক্যাপ্টেন জীবন রতন ধর ছাড়া রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দদের মধ্যে আর কেউ এই সভায় উপস্থিত হননি। সভায় আলমগীর সিদ্দিকী, হামিদা রহমান, আফসার আহমেদ সিদ্দিকী ও সংগ্রাম পরিষদের আরও কয়েক জন নেতা উপস্থিত ছিলেন।