স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশকের বেশি সময়ে এক ডজনেরও বেশি আদেশ বা পরিপত্র জারি হলেও ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বাংলা ভাষার যথাযথ প্রয়োগের জন্য গড়ে তোলা যায়নি মজবুত কোনো ভিত্তি। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করাসহ প্রশাসন, রাষ্ট্র পরিচালনা, শিক্ষা-প্রযুক্তির প্রসার, ভাষার উন্নয়ন আর নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ভাষার অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় যথাযথ পদক্ষেপ কোনো সরকারের আমলনামায় দেখা যায়নি। আজও গঠিত হয়নি ভাষা কমিশন, করা যায়নি জাতীয় ভাষানীতি। দীর্ঘ সময়ে বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ছাড়া আর সবকিছুর 'ফল শূন্য'।
ভাষা বিশেষজ্ঞদের মতে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি একটি রাষ্ট্রের অধিকারী হয়েছে বটে, কিন্তু যে উদ্দেশ্যে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল সেটা সফল হয়নি, অর্থাৎ বাংলাকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ শাসনবিভাগ, বিচারবিভাগ, দেশরক্ষা, ব্যবসায় ও শিক্ষায় ব্যবহৃত একমাত্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি। তারা মনে করেন, জাতীয় ভাষানীতি না থাকা এবং ভিনদেশি ভাষার আগ্রাসনে 'বাংলা ভাষা' 'জগাখিচুড়ি' ভাষায় রূপ নিয়েছে। এতে বাংলাভাষা তার স্বকীয়তা হারাতে বসেছে।
১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে বাঙালি জাতি আদায় করেছিল ভাষার সম্মান। এরই ধারাবাহিকতায় একাত্তরে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম হয় স্বাধীন বাংলাদেশের। ভাষা আন্দোলনের ৭৩ বছরে (১৯৫২-২০২৫) বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার এখনো উপেক্ষিত। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিকসহ দেশের বিশিষ্টজন। তাদের মতে, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে দেশে আইন হয়েছে ১৯৮৭ সালে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা আইন হয়েছে ২০১০ সালে। এরপরও দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন হয়নি। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের উদাসীনতায় আজও প্রণয়ন হয়নি 'ভাষানীতি'। ভাষা টেকসই করার জন্য ভাষানীতি প্রণয়ন জরুরি বলে তারা মনে করেন।
সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদে 'রাষ্ট্রভাষা' প্রসঙ্গে বলা আছে- 'প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা'। সংবিধানের আরও তিনটি অনুচ্ছেদে বাংলা ভাষার কথা উলেস্নখ আছে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের বিষয়ে উচ্চ আদালত কয়েক দফা নির্দেশনা দিলেও টনক নড়েনি সংশ্লিষ্টদের। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের 'বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ' এবং বাংলা একাডেমির 'প্রমিত বানানরীতি'ও মানা হচ্ছে না সর্বত্র। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকায় উচ্চ আদালত, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোয় ইংরেজির পাশাপাশি কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষায় মাতৃভাষাকে গুরুত্বহীন করে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গুরুত্ব পাচ্ছে ইংরেজি ও আরবি ভাষা। আবার বিশ্বায়নের দোহাই দিয়ে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিই প্রণীত হয়েছে সম্পূর্ণ ইংরেজি ভাষায়। দেশে দেদারসে গড়ে উঠছে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। একইভাবে ভাষানীতি না থাকায় হারিয়ে যেতে বসেছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নিজস্ব ভাষা অর্থাৎ মাতৃভাষা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলা ভাষা সর্বস্তরে প্রচলনের জন্য স্বাধীনতার পর থেকে এক ডজনেরও বেশি আদেশ, পরিপত্র বা বিধি জারি হয়েছে। তা সত্ত্বেও সর্বত্র রাষ্ট্রভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়নি। বিশ্বের অনেক দেশের মধ্যে ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, রাশিয়া, চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার মতো রাষ্ট্রগুলোর নিজস্ব ভাষানীতি আছে বলে জানা যায়। পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালেও রয়েছে নিজস্ব ভাষানীতি। এর আলোকে তাদের উচ্চ আদালতে মাতৃভাষায় রায় দেওয়া হচ্ছে। অথচ আমাদের দেশের উচ্চ আদালতে এখনো বাংলা ভাষা ব্যবহার কম।
তথ্য মতে, নব্বইয়ের দশক থেকে উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় ও আদেশ দেওয়া শুরু হয়। তৎকালীন বিচারপতি প্রয়াত এ আর এম আমীরুল ইসলাম চৌধুরী বাংলায় আদেশ দেওয়া শুরু করেন। এরপর সাবেক বিচারপতিদের মধ্যে বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, বিচারপতি হামিদুল হক, বিচারপতি আবদুল কুদ্দুছ, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী বাংলায় বেশ কয়েকটি রায় দেন। এরপর মাঝে মধ্যে বিচারপতিরা বাংলায় রায় ঘোষণা করে আসছেন।
বলাবাহুল্য, হাইকোর্ট ও সুপ্রিমকোর্টের রুল এবং দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধি আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রধান অন্তরায়। ১৯৮৭ সালের আইনে বাধা থাকলেও বিধির কারণে বিদেশি ভাষায় আবেদন-নিবেদন, আপিল, ডিক্রি ও রায় দেওয়া হচ্ছে। তবে, এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। তিনি বহুল আলোচিত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর রায় বাংলা ভাষায় লিখে উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার প্রচলনের ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে গেছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বাধীনতার পর দেশে নানা খাতের জরিপ হলেও এখন পর্যন্ত ভাষা জরিপ হয়নি। অথচ ভাষানীতি প্রণয়ন করতে হলে ভাষা কমিশন গঠন করা এবং এর আওতায় ভাষা জরিপ গুরুত্বপূর্ণ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাধীনতার আগে ১৯৬২ সালে বাংলা একাডেমি থেকে আঞ্চলিক ভাষা জরিপ কার্যক্রমের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ভাষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুলস্নাহ্?র উদ্যোগে কার্যক্রম শুরুর পর জরিপের প্রশ্নমালাও তৈরি হয়। জনগণকে এই কার্যক্রম সম্পর্কে জানাতে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে। পরে শিক্ষাবিদ ও গবেষক অধ্যাপক ডক্টর মোহাম্মদ আবদুল কাইউম তিনটি উপজেলায় প্রশ্নমালার ভিত্তিতে জরিপ করেন। তিনি তখন বাংলা একাডেমির সংকলন বিভাগের সহকারী অধ্যক্ষ ছিলেন। তবে ওই কার্যক্রম পরে সফলতার মুখ দেখেনি। যদিও দেশের ভাষা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলা একাডেমির পাশাপাশি ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট।
ভাষা গবেষকদের মতে, জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ার্সন ১৮৯৮ সালে 'ভারতীয় ভাষাগুলোর জরিপ' শুরু করেন- যা তিনি ১৯২৭ সালে বই আকারে ২০ খন্ডে প্রকাশ করেন। জরিপে তিনি ভারতবর্ষে প্রচলিত ১৭৯টি ভাষা আর ৫৪৪টি উপভাষার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা, ব্যাকরণ, শব্দভান্ডার আর নমুনা উপস্থাপন করেন। ওই বইয়ের পঞ্চম খন্ডে আছে বাংলা ভাষা বিষয়ক আলোচনা। এরপর অনেক বছর পার হলেও বাংলা ভাষা বিষয়ে আর কোনো জরিপ হয়নি। ২০০৭ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির প্রকাশিত 'বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা' বইয়ের ষষ্ঠ খন্ডে দেশের ১৫টি অঞ্চলের উপভাষার পরিচয় ও ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়। তবে দেশে প্রচলিত ভাষাগুলোর পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য সামগ্রিকভাবে সেখানে উঠে আসেনি বলে অনেকের অভিমত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৯৮৭ সালে প্রণীত 'বাংলা ভাষা প্রচলন আইন', এরপর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে তৈরি 'বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ' আর বাংলা একাডেমির প্রণীত 'প্রমিত বানানরীতি' দিয়েও জাতীয় ভাষানীতির অভাবে বাংলা বানানের ক্ষেত্রে সমতা আনা সম্ভব হচ্ছে না। ১৯৯৩ সালে বাংলা একাডেমি প্রমিত বানানরীতি চালু করলেও সরকারি বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের বানানে ওই রীতি অনুসরণ করা হয় না। প্রমিত রীতি ব্যবহারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে বাংলা একাডেমির প্রচার আটকে আছে '৯৪ সালে প্রচারিত একটি পোস্টার আর প্রতি বছর অভিধান প্রকাশের মধ্যে।
২০১২ সালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ একটা পরিপত্র জারি করে বলে, বানানে সমরূপতা ও সামঞ্জস্য বিধান করার জন্য বাংলা একাডেমি প্রমিত বানানরীতি অনুসরণ করা হবে। ২০১৫ সালে 'সরকারি কাজে ব্যবহারিক বাংলা' নামে একটি পুস্তিকা তৈরি করা হয়। ২০১৬ সালে হয় প্রশাসনিক পরিভাষা, পদবির পরিভাষার বই। এরপর সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন করা যায়নি।
এছাড়া, শহীদের রক্তস্নাত বাংলা ভাষা ও বানানের শৃঙ্খলা রক্ষায়ও নেই কোনো আইন। বানানে সমতা আনতে ভাষানীতি প্রণয়নের দাবি ভাষাবিদরা বরাবর জানিয়ে এলেও তা দাবিতেই বন্দি। ব্যক্তি বা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ভাষা-পরিকল্পনার কাজ সম্ভব হলেও ভাষানীতি প্রণয়ন ও এর বাস্তবায়ন কঠিন বলে তারা সরকারি উদ্যোগে ভাষানীতি প্রণয়নের দাবি জানাচ্ছেন।
বলাবাহুল্য, বাংলা ভাষা ব্যবহারের বেহাল অবস্থা আর বানান-নৈরাজ্যের অন্যতম কারণ নির্দিষ্ট ভাষানীতি না থাকা। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ সরকারের এক আদেশে এবং '৭৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদের সভাসহ বিভিন্ন সরকারের আমলে সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু ভাষানীতি না থাকায় সেসব সিদ্ধান্ত যথাযথভাবে কার্যকর করার দিকে কোনো সরকার হাঁটতে পারেনি। ফলে, সর্বস্তরে বাংলা আজো চালু হয়নি। ভাষানীতির অভাবে বাংলা চ্যালেঞ্জের মুখে ও দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর ভাষাও প্রায় বিলুপ্তির পথে।
ভাষানীতি না থাকায় সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তিমালিকানার অনেক প্রতিষ্ঠান প্রমিত বানানরীতি অনুসরণ করছে না। ফলে, পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশে নানা উদ্যোগ নিয়েও বাংলা বানানের ক্ষেত্রে নৈরাজ্য দূর করা যাচ্ছে না।
অস্বীকার করার উপায় নেই, গত দুই দশকে প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার বেড়েছে। বহু পণ্যের ব্যবহারবিধি বাংলায় দেওয়া হয়। অনেকে বাংলায় তাদের নথি পড়েন এবং বিভিন্ন আদেশ দিয়ে থাকেন। নিম্ন আদালতে বাংলায় রায় দেওয়া হয়। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রেও বাংলার ব্যবহার বেড়েছে।
এরপরও ভাষা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভাষানীতি ও ভাষা জরিপ শুধু প্রয়োজনই নয়, জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণও। শুধু উচ্চ আদালত নয়, উচ্চ শিক্ষায়ও বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে না। এটি খুবই পীড়াদায়ক। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা যারা কার্যকর করবেন, তাদের সদিচ্ছার অভাবকেই দায়ী করেছেন তারা।