রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্র-জনতার তুঙ্গে ওঠা আন্দোলনে পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যোগ দিয়েছিলেন নারীরাও। জীবন বাজি রেখে মিছিলে অংশ নেওয়া, রাত জেগে পোস্টার লেখা এবং পতাকা বিক্রিতে নারীদের ভূমিকা ছিল স্মরণীয়। '৫২-এর ভাষা আন্দোলনে যারা সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের মধ্যে- ডা. হালিমা খাতুন, রওশন আরা বাচ্চু, রওশন আরা রেণু, সুফিয়া আহমেদ, তৈফুরা, সুফিয়া খান, ড. শরীফা খাতুন প্রমুখর ছিলেন উলেস্নখযোগ্য ভূমিকায়।
ভাষা আন্দোলন চলাকালে ১৮ ফেব্রম্নয়ারি পাকিস্তান সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করলে পরিস্থিতি থমথমে হয়ে ওঠে। এ খবর পৌঁছে যায় প্রদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। উত্তেজিত হয়ে ওঠেন আন্দোলনকারী ছাত্ররা। এদিকে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ একুশের কর্মসূচি সফল করার লক্ষ্যে ২০ ফেব্রম্নয়ারি সন্ধ্যায় জরুরি সভা আহ্বান করে।
ড. সুফিয়া আহমদের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে গঠিত হয় 'সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ'। এ পরিষদ ২১ ফেব্রম্নয়ারি পূর্ব পাকিস্তানে সভা, হরতাল, বিক্ষোভ মিছিল ইত্যাদি কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। একুশে ফেব্রম্নয়ারি বিকাল ৩টায় ছিল গণপরিষদের অধিবেশন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য স্মারকলিপি প্রদানের উদ্দেশ্যে গণপরিষদের দিকে মিছিল নিয়ে যাওয়ার কর্মসূচিও ছিল। ছাত্রসমাজের এমন কর্মসূচিতে বিচলিত বোধ করে পাক জান্তা সরকার। তখন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নূরুল আমীন। তার সরকার ১৮ ফেব্রম্নয়ারি থেকে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করে।
ডা. হালিমা খাতুনের স্মৃতিচারণে পাওয়া যায়, সক্রিয় অংশগ্রহণের চিত্র। তিনি এক লেখায় বলেছিলেন, ১৪৪ ধারা ভাঙা নিয়ে তুমুল উত্তেজনা ছিল তাদের। তার ওপর দায়িত্ব ছিল মুসলিম গার্লস স্কুল এবং বাংলাবাজার গার্লস স্কুল থেকে মেয়েদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় আসা। ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তার দল ছিল মেয়েদের প্রথম দল। পুলিশ পথ আটকালে তারা পুলিশের রাইফেল ঠেলে স্স্নোগান দিতে দিতে এগিয়ে যান। পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং টিয়ারগ্যাস ছোড়ে। এতে তারা বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সি থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে আবার রাস্তায় নেমে আসেন এবং গণপরিষদ ভবনের দিকে এগোতে থাকেন। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারেননি তারা। শুরু হয় পুলিশের গুলিবর্ষণ।
রওশন আরা বাচ্চু সেদিনের স্মৃতিচারণে বলেছেন, তিনি দেখতে পান, ছাত্রদের দুটো দল পুলিশের ব্যারিকেড টপকে চলে যায়। এরপরই তিনি অন্যদের নিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ান। তাকে সামনে পেয়ে পুলিশের লাঠির আঘাত এসে পড়ে তার ওপরে। তিনি পুলিশের এলোপাতাড়ি লাঠিপেটায় আঘাত পান। গুলিবর্ষণ শুরু হলে রাস্তার পাশের একটি পুরনো রিকশার গ্যারেজে লুকিয়ে থাকেন। অনেকক্ষণ সেখানে থেকে সন্ধ্যায় ছাত্রী হোস্টেলে ফিরে যান। একুশের প্রথম শহীদ ছিলেন রফিকউদ্দীন। তার মাথার খুলি উড়ে গিয়েছিল। ঘটনার পরপরই এই ঐতিহাসিক দৃশ্যের ছবি তোলেন আমানুল হক- কাজী ইদ্রিস এবং মেডিকেল ছাত্রী হালিমা খাতুনের সহযোগিতায়। সেদিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহতদের সেবা দিতে গিয়ে ক্রোধে ফেটে পড়েছিলেন হাসপাতালের সেবিকারা। প্রতিরোধের জায়গাটি এভাবে তাদের সহযোগিতা, সমর্থনে দীপ্ত হয়ে উঠেছিল।