আটঘাট না বেঁধে বিভিন্ন ইসু্যতে অপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় তা বাস্তবায়নে সরকার বড় হোঁচট খাচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষ আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি নানা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। নিত্যপণ্য, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাসহ বিভিন্ন সেক্টরে সৃষ্টি হচ্ছে হযবরল পরিস্থিতি। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ব্যর্থতায় সরকারের ভাবমূর্তিও প্রশ্নের মুখে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে কোনো বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণের আগে এর প্রয়োজনীয়তা, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের সক্ষমতা ও কৌশল নির্ধারণ করা জরুরি। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কী ধরনের সংকট সৃষ্টি হতে পারে এবং কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে- তা পর্যালোচনা করা উচিত। একই সঙ্গে এসব প্রতিবন্ধকতা ও সংকট উত্তোরণের পথও আগাম খুঁজে রাখার কথা। অথচ গত ছয় মাসে বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, পলিথিন উৎপাদন ও ঢাকা মহানগরীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধ এবং সিএনজি অটোরিকশা মিটারে না চললে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করাসহ এক গুচ্ছ পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে এসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। ফলে, এসব উদ্যোগে বরাবরের মতো 'শূন্য ফল' মিলেছে। উল্টো সরকারের নেওয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার চেষ্টাকালীন স্বার্থন্বেষীগোষ্ঠী নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের নেতাকর্মীরা এসব পরিকল্পনার বিরোধীপক্ষকে মাঠে নামিয়ে রাজনৈতিক অরাজকতা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যা সামাল দিতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি অন্যান্য প্রশাসনকে হিমশিম খেতে হয়েছে।
ভোজ্যতেলের মূল্য স্থিতিশীল ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে সম্প্রতি তেলের সঙ্গে অন্য পণ্য কিনতে বাধ্য করলে শাস্তির আওতায় আনা
হবে বলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর হুঁশিয়ারি দিয়েছে। এর আগে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণেও বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। অথচ এতে বাজার নিয়ন্ত্রণে না এসে বরং আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল একরকম উধাও হয়ে গেছে। তবে, সয়াবিন রিফাইনারি কোম্পানিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বৈধ-অবৈধ গুদামে মজুতের পাহাড় থাকার অভিযোগ রয়েছে। যদিও এসব গুদামে হানা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অসহায়ত্ব প্রকাশ করছে।
রাজধানীর বেশ কয়েকটি বাজার পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, খুচরা দোকানে তেল কম, ডিলার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। তেলের সঙ্গে শর্তজুড়ে দেওয়ার বিষয়টির সত্যতা পাওয়া গেছে। পাইকারি বিক্রির ক্ষেত্রে রসিদ দেখাতে পারছে না। এসও করে নির্দিষ্ট সময়ে তেল সরবরাহ করা হচ্ছে না। তাছাড়া খোলা ভোজ্যতেলের দাম কোনো কোনো ক্ষেত্রে বোতলজাত তেলের চেয়ে বেশি।
নিউ মার্কেটের সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের বলেন, বাজারে ৫ লিটারের তেল নেই। ডিলাররা জানান, সরকারের সঙ্গে কোম্পানির আলোচনা হচ্ছে। দাম বাড়ালে তেল বাজারে চলে আসবে। কোম্পানির কাছে পর্যাপ্ত তেল আছে। তিনি বলেন, এখন ৫ কার্টন চাইলে ১ কার্টন দেওয়া হচ্ছে। তেল দিলে পোলাওয়ের চাল, আটা, লবণ, চা পাতাসহ অন্যান্য পণ্য কেনার শর্তজুড়ে দিচ্ছে। তেলের অর্ডার নিয়ে না জানিয়ে এসব পণ্য দিয়ে যাচ্ছে।
অথচ রোজার মাসকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রায় দ্বিগুণ নিত্যপণ্য আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে ছোলা, খেজুর, চিনি, মোটর ডাল, সয়াবিন তেল ও ফলসহ বিভিন্ন পণ্য গত বছরের তুলনায় অনেক আমদানি হয়েছে। আর গত বছরের জানুয়ারির চেয়ে গত জানুয়ারিতে প্রায় চার গুণ বেশি সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বলছে, গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে দুই লাখ ৩২ হাজার টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল খালাস হয়েছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এটি ৬৯ শতাংশ বেশি। একই সময়ে সয়াবিন বীজের আমদানিও বেড়েছে। গত জানুয়ারিতে তিন লাখ টন সয়াবিন বীজ আমদানি হয়েছে, গত এক বছরে রেকর্ড সর্বোচ্চ।
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি মাসে তিন লাখ ১৯ হাজার ২০ মেট্রিক টন সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে। গত বছর যা আমদানি হয়েছিল ৮১ হাজার ৮৯৯ টন। অর্থাৎ সেই হিসাবে প্রায় চার গুণ বেশি। ফলে, এত আমদানির পরও সয়াবিন তেলের সংকট কেন তা নিয়ে সর্বমহলে প্রশ্ন উঠেছে। নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করেও সরকার কেন সিন্ডিকেট ভাঙতে পারছে না- এ প্রশ্নটিও এখন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে শুধু ভোজ্যতেলই নয়, চিনি-ছোলাসহ রমজানে অতিরিক্ত ব্যবহার্য অধিকাংশ পণ্যের দামই বেড়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে ব্র্যান্ড ভেদে প্রতিকেজি প্যাকেট চিনি বিক্রি হচ্ছে ৮০-৮৫ টাকা। অন্যদিকে, প্রতিকেজি খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ৭৬-৭৮ টাকায়। সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা টিসিবির তথ্যমতে, গত বছর এই সময়ে ৬৫-৬৮ টাকায় খুচরা বাজারে প্রতিকেজি চিনি কিনতে পেরেছেন ভোক্তারা। ওই হিসাবে গত এক বছরে চিনির দাম বেড়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ। প্রতিকেজি ছোলার দাম বেড়েছে ৫ টাকা পর্যন্ত। রোজাদারদের খাদ্য তালিকায় অন্যতম অনুষঙ্গ খেজুরের দাম ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে খেজুরের দাম বেড়েছে প্রকারভেদে কেজিতে ৮০ থেকে ১৫০ টাকা। দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা অতিরিক্ত শুল্ক, ডলার সংকট, এলসি না পাওয়া ও সরবরাহে ঘাটতিকে দায়ী করছেন। একই সঙ্গে গুটিকয়েক ব্যবসায়ীকে আমদানির অনুমতি দেওয়াকেও দায়ী করছেন তারা। অথচ রমজান উপলক্ষে সরকার খেজুরে ১০ শতাংশ শুল্ক ছাড় দিয়েছে।
এদিকে শুধু বাজার নিয়ন্ত্রণই নয়, সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রেও সরকারের একাধিক পরিকল্পনা 'ফলাফল শূন্য' অবস্থাতেই গুটিয়ে নিতে হয়েছে। গত বছরের ১৯ নভেম্বর ঢাকা মহানগর এলাকার সড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল তিন দিনের মধ্যে বন্ধ বা বিধিনিষেধ আরোপ করতে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, ঢাকার জেলা প্রশাসক, দুই সিটি করপোরেশনের প্রশাসক, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি এ নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা বাস্তবায়নে মাঠে নামলে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকরা রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন শুরু করে। তাদের ভিড়ে মিশে ষড়যন্ত্রকারী একটি চক্র নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরির অপচেষ্টা চালায়। বেগতিক পরিস্থিতিতে 'শূন্য ফলাফল' অবস্থাতেই পুলিশ এ অভিযান গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়।
গোয়েন্দারা জানান, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশ বাহিনী অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তখনই ঢাকার অলিগলি থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা ঢাকা শহরে প্রবেশ করতে থাকে। পরবর্তী সময়ে রাজধানীর আশপাশের এলাকা থেকেও লাখ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা ঢাকায় ঢুকে পড়ে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রকারীরা প্রথমে বিচার বিভাগ দিয়ে কু্য করার প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে আনসার বাহিনী দিয়ে সরকার পতনের অপচেষ্টা চালায়। সেটিতেও ব্যর্থ হয়ে তারা ব্যাটারিচালিত রিকশা দিয়ে রাজধানী দখল করে নেওয়ার নীল-নকশা আঁকে। তবে, তার আগেই সরকার ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধ অভিযান গুটিয়ে নেওয়ায় তারা তাদের সে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে সফল হয়নি।
এদিকে হুট করে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধের উদ্যোগ নিয়ে বেগতিক পরিস্থিতিতে সেখান থেকে সরকার সরে এলেও আগামীতে এই যান যেন সড়কে আরও বড় 'বিষফোঁড়া' হয়ে না ওঠে তা নিয়ন্ত্রণে এখনো কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি বলে অভিযোগ তুলেছেন পরিবহণ বিশেষজ্ঞরা। তারা জানান, গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাটারিচালিত অবৈধ অটোরিকশা তৈরির কয়েকশ' কারখানা গড়ে উঠেছে। এছাড়া, গাড়ি মেরামতের ওয়ার্কশপগুলোতেও অবাধে এ অবৈধ যান উৎপাদন করা হচ্ছে। অথচ এসব কারখানা বন্ধে সরকার এখনো কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
অন্যদিকে, সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছাড়াই গত ১০ ফেব্রম্নয়ারি বিআরটিএ গ্যাস বা পেট্রোলচালিত অটোরিকশা চালকরা মিটারের নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি টাকা আদায় করলে জরিমানা বা কারাদন্ড দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। বরং ১৬ ফেব্রম্নয়ারি সকাল থেকে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সড়কে চালকদের অবরোধে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পর সরকারি এ সংস্থাটি তাদের আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। তবে, এরপরও দিনভর ঢাকা মহানগরবাসীকে নানা দুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছে। সিএনজি অটোরিকশা চালকরা দীর্ঘ সময় বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করে রাখায় অনেকেই নির্ধারিত সময়ে কর্মস্থলে পৌঁছাতে পারেনি। এছাড়া, ভয়াবহ যানজটে আটকা পড়ে সময়মতো বাণিজ্যিক পণ্য সরবরাহ করতে না পারায় ব্যবসায়ীরা অনেকেই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।
এদিকে বিকল্প ব্যবস্থা না করেই অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই বাজারের জন্য পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধে সোচ্চার হলেও বাস্তবে এর উৎপাদন ও বিপণন বন্ধ করতে পারেনি। বরং পলিথিনবিরোধী অভিযান চালাতে গিয়ে কোথাও কোথাও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন।
সংশ্লিষ্টদের ধারণা, বাজার থেকে পলিথিন তুলে দিতে যে কৌশল প্রয়োজন, তার কোনো তোয়াক্কা না করেই এ ব্যাপারে এলোমেলো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। যে কারণে তা সফল করা সম্ভব হয়নি।
ক্রেতা ও বিক্রেতারা মনে করছেন, উৎপাদন বন্ধ না করে বাজারে অহেতুক অভিযান চালিয়ে পলিথিন বন্ধের উদ্যোগ কাজে আসবে না। তাদের দাবি, পলিথিনের বিকল্প ব্যাগ বাজারে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি পলিথিনের উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। না হলে বাজারে অভিযানের মাধ্যমে তাদের হয়রানি বাড়বে। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।