বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২

ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা ছিল কয়েকটি পত্রিকার

যাযাদি ডেস্ক
  ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা ছিল কয়েকটি পত্রিকার
ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা ছিল কয়েকটি পত্রিকার

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালির জাতির আত্মপরিচয়ের বীজমন্ত্র, জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের উৎসশক্তি। আন্দোলনের এই সময়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান হয়ে উঠেছিল সাম্রাজ্যবাদী স্বৈরশাসকবিরোধী আন্দোলনে অগ্নিগর্ভ। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে তৎকালীন গোটা পূর্ব পাকিস্তান তখন উত্তাল। এ সময় বিভিন্ন সংবাদপত্র সভা-সমাবেশের খবর, বিবৃতি ইত্যাদি ছেপে ভাষা-আন্দোলনকে গতিশীল ও ত্বরান্বিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

বস্তুত পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই ভাষা বিতর্ক শুরু হয়। তখন আবুল মনসুর আহমদ ও অলি আহাদ সম্পাদিত 'দৈনিক ইত্তেহাদ' ভাষা আন্দোলনের পক্ষে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ইত্তেহাদের 'রবিবাসরীয়' বিভাগে ১৯৪৭ সালের ২২ ও ২৯ জুন দুই কিস্তিতে ছাপা হয় লেখক-সাংবাদিক মোহাম্মদ আবদুল হকের লেখা 'বাংলা ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব'। ৩০ জুন দৈনিক আজাদ পত্রিকায় তিনি লেখেন 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' নামের আরেকটি প্রবন্ধ। 'উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে' নামে এই বিষয়ে আবদুল হক তৃতীয় প্রবন্ধটি লেখেন ১৯৪৭ সালের ২৭ জুলাই দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকায়। সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকার ৩ আগস্ট, ১৯৪৭ সংখ্যায় চতুর্থ প্রবন্ধটি লেখেন 'মিসেস এম হক' ছদ্মনামে। তবে মাওলানা আকরম খাঁ সম্পাদিত 'দৈনিক আজাদ'-এর ভাষার প্রশ্নে ভূমিকা ছিল রহস্যজনক।

শুরু থেকেই বাংলা ভাষার ব্যাপারে ইংরেজি দৈনিক 'মর্নিং নিউজ'-এর ভূমিকা ছিল সম্পূর্ণ নেতিবাচক। মর্নিং নিউজের সঙ্গে সিলেটের 'আসাম হেরাল্ড'-এর ভূমিকাও ছিল একই সূত্রে গাঁথা। অন্যদিকে, এ পত্রিকাগুলোর প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায় সিলেটের সাপ্তাহিক 'নও-বেলাল'। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন তখনকার প্রগতিশীল যুব নেতা মাহমুদ আলী। এছাড়া, ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হয় 'মাসিক সীমান্ত' পত্রিকা। সীমান্ত পত্রিকার সম্পাদক মাহবুব আলম চৌধুরীই প্রথম ভাষা শহীদদের নিয়ে কবিতা লেখেন, 'কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি।' ১৯৪৯ সালের শেষ দিকে প্রকাশিত মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সাপ্তাহিক 'ইত্তেফাক'-এর ভূমিকাও উলেস্নখ করার মতো নয়। যদিও ব্যক্তি ভাসানীর ভূমিকা ইতিহাসে সোনার হরফে লেখা থাকবে।

ভাষা আন্দোলনে মর্নিং নিউজ পত্রিকার ভূমিকা প্রসঙ্গে আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক 'ভাষা আন্দোলন ইতিহাস ও তাৎপর্য' গ্রন্থে বলেছেন, '...অবাঙালি স্বার্থের প্রতিনিধি এবং মূলত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শ্রেণি স্বার্থের প্রতিনিধি 'মর্নিং নিউজ' ভাষা আন্দোলনের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন করা এবং তার চরিত্রহননের জন্য যত ধরনের সম্ভব মিথ্যা, মনগড়া সংবাদ পরিবেশ করেছিল এবং জঘন্য কুৎসামূলক সম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখে বাংলা ও বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেই কর্তব্য শেষ করেনি, সাম্প্রদায়িকতার উদ্দেশ্যমূলক উসকানিও দিয়েছে।'

মর্নিং নিউজ পত্রিকার ভূমিকা নিয়ে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদেও আলোচিত হয়েছে। ১৯৫২ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা বার অ্যাসোসিয়েশন হলে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক (পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিকামী মানুষের নেতা ও বাঙালি জাতির পিতা) শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, 'মুসলিম লীগ, লীগ সরকার, আর মর্নিং নিউজ ছাড়া প্রত্যেকেই বাংলা ভাষা চায়।' রাষ্ট্রভাষা কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ মর্নিং নিউজকে বাংলা ভাষাবিরোধী পক্ষ হিসেবে বর্জনের জন্য জনগণকে আহ্বান জানায়।

এক সময় 'সৈনিক' ছিল ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র। এছাড়া, কোনো কোনো পত্রিকা সক্রিয়ভাবে আন্দোলন করেছে। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হল মিলনায়তনে যে 'রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' গঠিত হয়েছিল তাতে 'ইনসাফ', 'জিন্দেগী', 'দেশের দাবি' পত্রিকা থেকেও একজন করে প্রতিনিধি নেওয়া হয়।

তথ্য : আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, ঢাকা, ১৯৭৫; আবদুল হক, ভাষা-আন্দোলনের আদি পর্ব, ঢাকা, ১৯৭৬; বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, ১ম খন্ড, ঢাকা, ১৯৭৯।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে