বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২

'সৈনিক' সম্পাদকের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি

যাযাদি ডেস্ক
  ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
'সৈনিক' সম্পাদকের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি
'সৈনিক' সম্পাদকের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি

বাঙালি জাতি বুকের তাজা রক্ত ঢেলে ভাষার অধিকার প্রিতিষ্ঠা করেছে। পাকিস্তানি জান্তার শোষণ-নিপীড়নের প্রথম আঘাত আসে 'বাংলা ভাষা'র ওপর। আটচলিস্নশ থেকে বায়ান্নর ২১ ফেব্রম্নয়ারি হয়ে ছাপ্পান্নতে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি- দীর্ঘ এক সংগ্রামের ইতিহাস। ভাষা আন্দোলনে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখায় এই দিনে 'সৈনিক' পত্রিকার সম্পাদকের ওপর হুলিয়া জারি করে পাকিস্তানি জান্তা সরকার।

১৯৪৮ সালের ১৪ নভেম্বর এই পত্রিকাটি প্রকাশ করেন তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম। এটি ছিল মজলিসের ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র। তখন এর সম্পাদক ছিলেন প্রফেসর আব্দুল গফুর। ওই সময় আবুল মনসুর আহমদ সম্পাদিত 'ইত্তেহাদ' ছাড়া অন্য কোনো পত্রিকা ভাষা আন্দোলনকে তেমন সমর্থন করেনি।

১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দীনের বক্তব্যের পর পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরিতে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করা হয়। সেখানে তৎকালীন ইডেন কলেজের ছাত্রী মাহবুবা খাতুন বক্তৃতা করেন। তিনি বলেন, 'বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি স্বীকার করে নেওয়ার জন্য প্রয়োজন হলে মেয়েরা জীবন বিসর্জন দেবে।' ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে ১৯৫২ সালের ১১ ও ১৩ ফেব্রম্নয়ারি 'পতাকা দিবস' পালিত হয়। এ সময় প্রায় ৫০০ পোস্টার লেখার দায়িত্ব নাদিরা বেগম ও শাফিয়া খাতুনকে দেওয়া হয়। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্য ছাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে সে দায়িত্ব পালন করেন।

২১ ফেব্রম্নয়ারি সর্বাত্মক হরতাল পালনের জন্য দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ব্যাপক প্রস্তুতি চলে। এতে মেয়েদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। ১১ ফেব্রম্নয়ারি পতাকা দিবস পালনের পরদিন ১২ ফেব্রম্নয়ারি দৃশ্যমান কোনো কমর্সূচি ছিল না। তবে এ সময় ছাত্ররা ২১ ফেব্রম্নয়ারির হরতাল কর্মসূচি সফল করার জন্য অর্থ সংগ্রহ এবং গণসংযোগে ব্যস্ত সময় পার করছিলেন। এ সময় লায়লা সামাদ, শামসুন নাহার, শাফিয়া খাতুন, সারা তৈফুর, রওশন আরা বাচ্চু, সুফিয়া আহমেদ, রওশন আরা রহমান, হালিমা খাতুন, কায়সার সিদ্দিকী প্রমুখ ছাত্রীরা ঢাকার তৎকালীন বকশীবাজার কলেজ (বর্তমান বদরুন্নেসা কলেজ), মুসলিম গার্লস স্কুল, বাংলা বাজার গার্লস স্কুল, কামরুন্নেসা গার্লস স্কুলে গিয়ে মেয়েদের উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করেন।

সৈনিক পত্রিকা বের হওয়ার আগে আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী সম্পাদিত সাপ্তাহিক ইনসাফ ভাষা আন্দোলনকে সমর্থন করত। সিলেট থেকে প্রকাশিত নওবেলাল পত্রিকাটি ভাষা আন্দোলনের পক্ষে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এছাড়া মিলস্নাত, ইনসাফ প্রভৃতি পত্রিকা ভাষা আন্দোলনের সমর্থক ছিল। পাকিস্তান অবজারভার এবং আজাদেও ভাষা আন্দোলনের খবর মাঝে মধ্যে গুরুত্বসহকারে ছাপা হতো। প্রফেসর আবুল কাসেমের আজিমপুর ১৯ নম্বর বাসা ছিল সৈনিক পত্রিকা ও তমদ্দুন মজলিসের অফিস। ভাষা আন্দোলন যেহেতু সরকারবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয় তাই ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র সৈনিক পত্রিকাটিও প্রথম সরকারবিরোধী পত্রিকা হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে পরিচিতি লাভ করে। সরকারবিরোধী দলগুলোর বক্তব্য-বিবৃতি এবং কর্মকান্ড গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হতে থাকে এ পত্রিকায়। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন সৈনিক পত্রিকা একই দিনে কয়েকটি সংস্করণ বের হয়েছে এবং তা নিমেষেই বিক্রি হয়ে গেছে। ২২ ও ২৩ ফেব্রম্নয়ারি পত্রিকাটির তিনটি সংস্করণ বের করা হয়। মফস্বলেও ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সাড়া জাগায় পত্রিকাটি। শুধু প্রেসনোট ছাপার সরকারি নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও পত্রিকাটি সরকারি সে আদেশ মানেনি।

মূলত ভাষার দাবিতে উত্তাল বায়ান্ন সালে এভাবেই একের পর এক বাঙালির সমন্বিত নানা সফল আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়।

সূত্র:আবদুল হক, ভাষা-আন্দোলনের আদি পর্ব, ঢাকা, ১৯৭৬; বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, ১ম খন্ড, ঢাকা, ১৯৭৯।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে