জুলাই গণঅভু্যত্থানে নিহত ও আহত ব্যক্তিদের 'ইতিহাসের স্রষ্টা' হিসেবে অভিহিত করেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। অভু্যত্থানে নিহতদের পরিবার ও আহতদের হাতে রাষ্ট্রীয় সহায়তা তুলে দিতে গিয়ে তিনি বলেন, 'আপনারা জীবন্ত ইতিহাস; মনের গভীর থেকে আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। যে জাতি ইতিহাস স্মরণ করতে পারে না, সে জাতি কখনো জাতি হিসেবে গড়ে ওঠে না।'
আর্থিক চেক হস্তান্তরের অনুষ্ঠানটি হয় সোমবার; রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে। এদিন নিহত ২১ জনের পরিবার ও আহত ৭ জনের হাতে চেক তুলে দেন মুহাম্মদ ইউনূস।
এর মধ্য দিয়ে হতাহতদের রাষ্ট্রীয়ভাবে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার কার্যক্রম শুরু হলো বলে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে নিহত তিনজনের পরিবার ও তিনজন আহত ব্যক্তি নিজেদের অভিব্যক্তি তুলে ধরে। তারা হত্যাকান্ডের বিচার, রাষ্ট্রীয় সম্মাননা, আর্থিক সহযোগিতা ও পুনর্বাসনসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন। জুলাইয়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়েন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, 'সবসময় ভাবি, যাদের কারণে, যাদের ত্যাগের বিনিময়ে দেশকে আমরা নতুন বাংলাদেশ বলার সাহস করছি, তাদের এই ত্যাগ কোনো নিক্তি দিয়ে মাপা যায় না।'
শহীদ পরিবার ও আহতের উদ্দেশে তিনি বলেন, 'আজ (সোমবার) থেকে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের অংশ হলেন। এটা হলো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি। এর বাইরেও আপনাদের দায়িত্ব সমাজের সবাইকে গ্রহণ করতে হবে।'
সব হত্যাকান্ড ও গুম-খুনের বিচার হবে মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, 'বিচার তাৎক্ষণিক করতে গেলে অবিচার হয়ে যায়। বিচারের মূল জিনিসটা হলো, সুবিচার হতে হবে; অবিচার যেন না হয়। আমরা অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলাম বলেই এই সংগ্রাম হয়েছে, এই আত্মত্যাগ হয়েছে। আমরা যদি অবিচারে নামি তাহলে তাদের আর আমাদের মধ্যে তফাৎটা থাকল কোথায়! আমরা অবিচারে নামব না।'
তিনি বলেন, 'দেশে কোনো সহিংসতা ও হানাহানি যেন না হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখেন।'
হতাহতদের যা যা দেবে সরকার
অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে হতাহতদের জন্য সরকারের নেওয়া কর্মসূচি তুলে ধরা হয়। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জুলাই অভু্যত্থানে নিহতরা 'জুলাই শহীদ' নামে অভিহিত হবেন। আহতরা অভিহিত হবেন 'জুলাই যোদ্ধা' নামে।
প্রতিটি শহীদ পরিবার এককালীন পাবে ৩০ লাখ টাকার আর্থিক সহায়তা। এর মধ্যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জাতীয় সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ১০ লাখ টাকা এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরে জাতীয় সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ২০ লাখ টাকা সহায়তা দেওয়া হবে।
পাশাপাশি প্রত্যেক শহীদ পরিবারকে মাসে ২০ হাজার টাকা ভাতা দেওয়া হবে। শহীদ পরিবারের কর্মক্ষম সদস্যরা সরকারি ও আধাসরকারি চাকরিতে পাবেন অগ্রাধিকার।
'জুলাই যোদ্ধারা' দুটি মানদন্ডে চিকিৎসা পাবেন। গুরুতর আহতদের 'ক্যাটাগরি এ' অনুযায়ী এককালীন ৫ লাখ টাকা দেওয়া হবে। এর মধ্যে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে নগদ (ব্যাংক চেকের মাধ্যমে) দেওয়া হবে ২ লাখ টাকা। তিন লাখ টাকা দেওয়া হবে ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরে।
গুরুতর আহতরা মাসে মাসে ২০ হাজার টাকা ভাতাও পাবেন। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে আজীবন চিকিৎসাসেবা পাবেন। মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশ থাকলে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হবে দেশের বাইরে। তারা কর্মসংস্থানের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন সুবিধাও পাবেন।
'ক্যাটাগরি বি' অনুযায়ী জুলাই যোদ্ধাদের এককালীন ৩ লাখ টাকা দেওয়া হবে। এর মধ্যে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে এক লাখ এবং পরের অর্থবছরের দেওয়া হবে ২ লাখ টাকা।
তারা মাসে ভাতা পাবেন ১৫ হাজার টাকা। কাজের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও সরকারি-আধাসরকারি চাকরিতে অগ্রাধিকারও পাবেন তারা।
জুলাই যোদ্ধাদের পরিচয়পত্র দেওয়া হবে। তারা পরিচয়পত্র দেখিয়ে সরকারের বিভিন্ন সুবিধা নিতে পারবেন।
এখন পর্যন্ত জুলাই গণ-অভু্যত্থানে ৮৩৪ জন 'শহীদের তালিকা' গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে সরকার। আহতদের তালিকাও প্রস্তুত করা হয়েছে। খুব শিগগিরই তালিকাটি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে।
অনুষ্ঠানে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, 'আমরা জানি আপনাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল, আরও আগেই আমরা প্রাতিষ্ঠানিক কাজগুলো করতে পারব। আমাদের আন্তরিকতার কমতি ছিল না। আমাদের প্রধান উপদেষ্টাসহ সরকারের প্রত্যেকে আপনাদের ন্যায্য সম্মাননা দেওয়ার জন্য কাজ করেছেন। সংকটকালীন সময়ে আমাদের দায়িত্ব নিতে হয়েছে, সে কারণে আপনাদের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী আমরা করতে পারিনি। এ কারণে আমি দুঃখপ্রকাশ করছি।'
বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী সায়েদুর রহমানও উপস্থিত ছিলেন।
শিক্ষার্থীদের দ্রম্নত ভিসা দিতে অনুরোধ
এদিকে, বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ভিসা প্রক্রিয়া দ্রম্নত করতে কানাডার সরকারকে আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সোমবার কানাডার আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী আহমেদ হুসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তিনি এ আহ্বান জানান।
প্রধান উপদেষ্টার আহ্বানে সাড়া দিয়ে কানাডার মন্ত্রী বলেন, 'আমরা ভিসা কেটে দিয়েছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কিছু নেই। বাংলাদেশ থেকে যেকোনও বৈধ শিক্ষার্থীকে স্বাগত জানাই।'
এছাড়া দুদেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক সম্প্রসারণে ফরেন ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন অ্যান্ড প্রটেকশন এগ্রিমেন্ট (ফিপা) নিয়ে কারিগরি আলোচনা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ততাকে স্বাগত জানিয়েছে কানাডা।
আহমেদ হুসেন বলেন, 'ফরেন ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন অ্যান্ড প্রটেকশন এগ্রিমেন্ট (এফআইপিএ) স্বাক্ষরিত হলে কানাডার ব্যবসায়ীরা উৎসাহিত হবেন। তারা এটিকে একটি সিগন্যাল হিসেবে দেখবেন।'
বাংলাদেশের যুব শক্তির সুযোগ নিয়ে কানাডার উৎপাদন কারখানা বাংলাদেশে স্থানান্তর এবং দেশটিকে একটি উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বাংলাদেশ থেকে চুরি যাওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে আবারও কানাডার সহায়তা কামনা করেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, 'বেগম পাড়া বলে পুরো এলাকা আছে, যেখানে দুর্নীতিবাজ পরিবারের সদস্যরা বসবাস করছে। দুর্নীতি সর্বত্র হওয়ায় এ থেকে মুক্তি পেতে আমরা কঠোর পরিশ্রম করছি।'
বাংলাদেশকে কানাডা সরকারের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে মন্ত্রী আহমেদ হুসেন বলেন, 'আমরা কানাডায় জনগণের লুটপাট করা অর্থ চাই না।' অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি তার সরকারের সমর্থনের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি।
মন্ত্রী বলেন, 'আমি জানি বাংলাদেশের মানুষ তাদের আশা ও প্রত্যাশা পূরণের জন্য আপনার ও আপনার সরকারের দিকে তাকিয়ে আছে।'
প্রধান উপদেষ্টা ও কানাডার মন্ত্রী বাংলাদেশে চলমান সংস্কার উদ্যোগ, আসন্ন সাধারণ নির্বাচন এবং মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দুর্দশা নিয়েও আলোচনা করেন।
বাংলাদেশে নিযুক্ত কানাডার হাইকমিশনার অজিত সিং এবং এসডিজি বিষয়ক সিনিয়র সচিব লামিয়া মোরশেদ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।