রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবিতে বায়ান্ন ১১ ফেব্রম্নয়ারি পতাকা দিবস পালন করা হয়। ৬ ফেব্রম্নয়ারি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভার ১১ ও ১৩ ফেব্রম্নয়ারি পতাকা দিবস পালনের এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
ভাষা রক্ষার দাবিতে এ দিন ঢাকাসহ আশপাশের এলাকাগুলো ছিল প্রতিবাদমুখর। দেশজুড়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' দাবিতে স্স্নোগান তোলে। প্রদেশের সব জায়গায় তখন বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার আওয়াজ। উল্টোদিকে আন্দোলনকারীদের ঠেকাতে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারও নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। কিন্তু কোনো কিছুকে তোয়াক্কা করে না ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে আন্দোলনকারীরা।
আন্দোলনকারীদের পিছু হটাতে না পেরে দমনপীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি সরকার। চলে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন। কিন্তু অদম্য বাঙালি সব কিছু তুচ্ছ করে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। পতাকা দিবস ঘিরে এইদিনে ঢাকার নবাবপুর রোডে ছাত্র-জনতার বিশাল মিছিল বের হয়। মিছিল আর স্স্নোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা। নবাবপুর রোড ও আশপাশের সব এলাকায় জনতার ঢল নামে। সবার এক আওয়াজ- হয় বিজয়, নয় মৃতু্য। মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় জীবন দিতে রাজি তখন বাঙালিরা। নারী-পুরুষ, কৃষক-শ্রমিক-মেহনতী মানুষ থেকে শুরু করে কবি, লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ তখন প্রতিবাদে সোচ্চার। প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে প্রতিরোধের। নারীরাও দলে দলে আন্দোলনে যোগ দেন।
এই দিনে পুরুষের পাশাপাশি নারী কর্মীরাও পতাকা দিবস পালন উপলক্ষে 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' লেখা পতাকা বিক্রি করে। পতাকা বিক্রির টাকা দিয়ে ভাষা আন্দোলনের জন্য তহবিল গঠন করা হয়। টাকার একাংশ দিয়ে বদরুদ্দিন উমরের লেখা 'আমাদের ভাষার লড়াই' এবং আনিসুজ্জামানের লেখা 'রাষ্ট্রভাষা কি এবং কেন?' পুস্তিকা দু'টি প্রকাশ করা হয় বলে জানা যায়।
অন্যদিকে, পতাকা বিক্রির এই টাকা ২১ ফেব্রম্নয়ারির হরতাল সফল করতে গণসংযোগের কাজেও ব্যয় হয়। অলি আহাদের লেখা থেকে জানা যায়, ১২ ফেব্রম্নয়ারি কোনো কমর্সূচি না থাকলেও ১১ থেকে ১৩ ফেব্রম্নয়ারি টানা তিন দিন ধরেই চলে পতাকা বিক্রি কর্মসূচি। এতে টাকা খুব বেশি সংগ্রহ না হলেও পতাকা দিবসকে সামনে রেখে আরও নতুন কর্মী এসে যুক্ত হতে থাকে রাষ্ট্রভাষা রক্ষার এই আন্দোলনে। সে সময় ৫০০ পোস্টার লেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল নাদিরা বেগম ও ডা. সাফিয়াকে। তারা দু'জন তাদের বান্ধবী ও অন্য ছাত্রীদের নিয়ে পোস্টার লেখার ব্যবস্থা করেন।
২১ ফেব্রম্নয়ারিকে সামনে রেখে বিক্ষোভের এই প্রস্তুতি কেবল ঢাকা শহরে নয়, সমগ্র পূর্ব বাংলায় চলতে থাকে। ৫ ফেব্রম্নয়ারি নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যকরী সংসদের জরুরি অধিবেশন হয়। এতে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আপসহীন সংগ্রাম পরিচালনার জন্য ছাত্রসমাজের প্রতি আবেদন জানানো হয়। এই আবেদন ঘিরেই জেগে ওঠে তৎকালীন পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ।
১৯৫২৫ সালের ১৭ ফেব্রম্নয়ারি প্রকাশিত সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে সভা, শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠান হয়েছে। বেশকিছু স্থানে স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বেশ টানাটানি চলে এই ধর্মঘট পালন নিয়ে। মাদারীপুরের ছাত্রছাত্রীরা ধর্মঘট ও মিছিল করে। বরিশালের রাজাপুর নিজামিয়া হাইস্কুলের ছাত্ররা কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহ্বানে এ হামিদের সভাপতিত্বে সভা করে। নীলফামারীতে হরতাল পালিত হয়। সাধারণ জনগণ ও ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে শহরে মিছিল করে। খয়রাত হোসেন, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, জবানউদ্দিন আহমদ মিছিলের পুরো ভাগে ছিলেন। ছাত্র জাকিউল আলমের সভাপতিত্বে বিরাট জনসভা হয়। খয়রাত হোসেন ছাড়াও ছাত্রনেতা সুফিয়ার, এনায়েতুর রহমান, আনোয়ার, সুফিয়া, ফিরোজা বেগম ও রাহেলা বক্তব্য দেন।
সূত্র: আবদুল হক, ভাষা-আন্দোলনের আদি পর্ব, ঢাকা, ১৯৭৬; বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, ১ম খন্ড, ঢাকা, ১৯৭৯।