শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২

তেল নিয়ে 'তেলেসমাতি'

রাইস ব্র্যান অয়েল রপ্তানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ লিটার প্রতি ১৫ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাবে সায় নেই সরকারের
বীরেন মুখার্জী
  ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
তেল নিয়ে 'তেলেসমাতি'
তেল নিয়ে 'তেলেসমাতি'

পবিত্র রমজান মাস শুরুর আগে ভোজ্যতেল নিয়ে নানা নাটক শুরু হচ্ছে। গত বছরের ডিসেম্বরে আচমকা বাজার থেকে হারিয়ে যায় বোতলজাত তেল। এরপর লিটার প্রতি ৮ টাকা দাম বাড়ানোর ঘোষণার পর সেই 'লুকানো' তেলের বোতল ফিরে আসে দোকানে দোকানে। জানুয়ারিতে কয়েক দফায় বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় বোতলজাত সয়াবিন তেল। ফেব্রম্নয়ারি মাসেও বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ দেখা যাচ্ছে না। দেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেও চলছে সংকট। অধিকাংশ দোকানে মিলছে না বোতলজাত সয়াবিন তেল। খোলা তেল পাওয়া গেলেও গুণতে হচ্ছে বাড়তি দাম। আবার কোনো কোনো এলাকায় অন্য পণ্য কেনার শর্তে দেওয়া হচ্ছে বোতলজাত তেল। বাজারে ভোজ্যতেল নিয়ে এমন 'তেলেসমাতি' কান্ডে ক্রেতারা ক্ষুব্ধ। রোজার বাজারে ক্রেতার পকেট কাটতেই ব্যবসায়ীরা সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছেন বলে অভিযোগ তাদের। তবে, ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, তেলের কোনো সংকট নেই। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বাজারে সরবরাহ বেশি।

এদিকে, আসন্ন পবিত্র রমজানে ভোজ্যতেলের বাজারে সার্বিক সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ে দেশের শীর্ষ ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছে ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। রোববারের ওই বৈঠকের পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রাইস ব্র্যান তেল রপ্তানি নিরুৎসাহিত করতে ২৫ শতাংশ রেগুলেটরি শুল্ক আরোপ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। দেশে উৎপাদিত রাইস ব্র্যান অয়েল স্থানীয় বাজারে সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে ভোজ্যতেলের বাজার স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হবে, আশা এনবিআরের।

অন্যদিকে, বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, নানা সময়ে বাজারে পণ্যের সংকট দেখিয়ে সরকারকে এক ধরনের চাপে রাখা সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের অতি পুরনো কৌশল। অতীতেও এমনটি বারবার দেখা গেছে। এবারও সরকারের কাছে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে সায় না পাওয়ায় তারা বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে, নানা অপকৌশলে ক্রেতার পকেটে ছুরি চালিয়ে কোটি কোটি টাকা লুট করার পাঁয়তারা করছেন ওই অসাধু ব্যবসায়ীরা। এদের টার্গেট আসন্ন রমজান মাস।

বাজারে ভোজ্যতেলের এমন সংকট পরিস্থিতিতে রোববার ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সঙ্গে দেশের শীর্ষ ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে দেশে ভোজ্যতেলের সরবরাহ পর্যাপ্ত রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা। তারপরও বাজারে কেন সংকট এমন প্রশ্নে তারা জানান, মাঠ পর্যায়ে কেউ কেউ অতিরিক্ত মজুত করে থাকতে পারে। পাইকারি ও খুচরা বাজারে কেউ কেউ অধিক লাভের আশায় বোতল কেটে খোলা তেল হিসেবে বেশি দামে বিক্রি করছে। অন্যদিকে, পার্শ্ববর্তী দেশে মূল্য অধিক হওয়ায় অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যের আশঙ্কার কথাও বলেন সরবরাহকারী কোম্পানির প্রতিনিধিরা।

সিটি গ্রম্নপের উপদেষ্টা অমিতাব চক্রবর্তী বলেন, 'সিটি গ্রম্নপ গত জানুয়ারি মাসে প্রায় ৫০ হাজার ৭০০ টন তেল সরবরাহ করেছে। এর মধ্যে ২২ হাজার ২৪২ টন বোতলজাত। ঠিক গত বছরের একই সময় (জানুয়ারি ২০২৪) তারা ১৪ হাজার ২৬২ টন বোতলজাত তেল সরবরাহ করেছিল।'

বৈঠকে অংশ নিয়ে ভোজ্যতেলের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রম্নপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) উপ-মহাব্যবস্থাপক তসলিম শাহরিয়ার বলেন, 'তাদের কোম্পানি জানুয়ারিতে ৪৭ হাজার ৬৬৮ হাজার টন তেল সরবরাহ করেছে। এর মধ্যে ১৫ হাজার টন বোতলজাত তেল। গত বছরের একই সময়ে সরবরাহ ছিল ২৫ হাজার টন- যার মধ্যে ১২ হাজার টন ছিল বোতলজাত।'

পাশাপাশি ব্যবসায়ীরা এটাও জানিয়েছেন, আসন্ন রমজান উপলক্ষে পাইপলাইনে বেশ কিছু ভোজ্যতেল ভর্তি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙরের অপেক্ষায় আছে। এগুলো অল্প সময়ের মধ্যে স্থানীয় বাজারে সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত হবে। পাইপলাইনে থাকা ভোজ্যতেলের পরিমাণ প্রায় দেড় লাখ টন।

এনবিআরের প্রজ্ঞাপনে জানা যায়, ভোজ্যতেল একটি অপরিহার্য খাদ্যপণ্য- যার সরবরাহ মূলত আমদানিনির্ভর। দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের চাহিদার সিংহভাগ পূরণ হয় অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেল আমদানিপূর্বক পরিশোধন কার্যক্রম থেকে। তবে দেশে ১ দশমিক ২ লাখ থেকে ১ দশমিক ৫ লাখ মেট্রিক টন রাইস ব্র্যান তেল (পরিশোধিত/অপরিশোধিত) উৎপাদিত হলেও তার সিংহভাগ প্রতিবেশী দেশে রপ্তানি হয়ে যায়। এই তেল দেশের ভোজ্যতেলের অভ্যন্তরীণ চাহিদার ২৫-৩০ শতাংশ মেটাতে সক্ষম।

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ৯ ডিসেম্বর ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো হয়। তার আগে বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বোতলের সয়াবিন তেল। তখন খুচরা পর্যায়ে প্রতি লিটার বোতলের সয়াবিন তেলের দাম সর্বোচ্চ ৮ টাকা বাড়িয়ে করা হয় ১৭৫ টাকা। দুই লিটারের বোতলে তা ৩৮০ টাকা এবং ৫ লিটার ৮৫২ টাকা। খোলা সয়াবিনের খুচরা বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয় ১৫৭ টাকা।

তার আগে বোতলের সয়াবিনের দাম ১৬৭ টাকা এবং খোলা তেল ১৪৯ টাকা ছিল।

গত বছরের ?জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অক্টোবরে আমদানি পর্যায়ে ভোজ্যতেলের মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ৫ শতাংশ কমানোর পাশাপাশি উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ের ভ্যাট পুরোপুরি প্রত্যাহার করে সরকার।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানিয়েছে, নানা সুবিধা দেওয়ার পরেও রমজানের আগে আরেক দফা সয়াবিন তেলের দাম বাড়তে সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়ে কৌশলী বিপণনের পথ ধরেছেন ব্যবসায়ীরা। খুচরা পর্যায়ে কমিশন কমিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি মিলার ও ডিলার পর্যায়ে বাকিতে তেল দেওয়া বন্ধ করা হয়েছে। এর প্রভাবে পাড়ায় মহলস্নার দোকানগুলোতে কমেছে বোতলজাত তেলের সরবরাহ। খুচরা বিক্রেতাদের মধ্যে গুঞ্জন রয়েছে, রমজানের আগেই দাম বাড়াতে চান ব্যবসায়ীরা। সেজন্য ডিলাররা বাকিতে তেল দেওয়া বন্ধ করেছেন।

তবে, নিয়মিত সরকারি তদারকির আওতায় থাকা কারওয়ান বাজার, শান্তিনগর, কমলাপুর, টিঅ্যান্ডটি কলোনি, মহাখালীর কাঁচাবাজারগুলোতে তেলের যথেষ্ট সরবরাহ দেখা গেছে। আর তুলনামূলক কম তদারকিতে থাকা যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া ও ধোলাইপাড়সহ বিভিন্ন এলাকার অনেক মুদি দোকানে মিলছে না রান্নার এ জরুরি উপকরণটি। যদিও এসব এলাকায় থাকা সুপারশপগুলোতে বোতলের সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে।

রোজার আগে বা শুরুতে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর ঘটনা ভোক্তাদের কাছে নতুন নয়। এর আগে গত বছর রোজা শুরু হওয়ার আগে এপ্রিল মাসে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর জন্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দাবি ওঠে। তখন সরকার মূল্য সমন্বয় করে। বৈশ্বিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে তখন সরকার এ পদক্ষেপ নিয়েছিল।

লিটার প্রতি ১৫ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাবে সায় নেই সরকারের

ডিসেম্বরে ৮ টাকা বাড়ানোর পর চলতি বছরের জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে সয়াবিন তেলের দাম বাড়াতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দেয় ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের সংগঠন। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ব্যবসায়ীরা লিটার প্রতি ১৫ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন। হিসাব করে ১১ টাকা বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি-তর্ক চলছে। সর্বশেষ ২৩ জানুয়ারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশীরউদ্দিনের বৈঠক হয়। তবে ওই বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। ব্যবসায়ীদের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের মতামত চেয়ে প্রতিবেদন দিতে বলেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সেই প্রতিবেদনও এখনো জমা পড়েনি।

এ বিষয়ে ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনষ্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ মুস্তাফা হায়দার জানান, ২০১১ সালে সরকার একটি নীতিমালা করে। সয়াবিন তেলের দাম সময়ে সময়ে বৈশ্বিক বাজার ও অভ্যন্তরীণ খরচের সঙ্গে সমন্বয় করার কথা। এখন তা ১৫ দিন পর পর সমন্বয় করার কথা। বৈশ্বিক বাজারে তেলের দর, আমদানি খরচ, পরিবহণ ও বিভিন্ন ধাপে সরকারের ভ্যাট যুক্ত করে সয়াবিন তেলের দর নির্ধারণ করা হয়।

ডলারসহ অন্যান্য খরচ বেড়ে যাওয়ার যুক্তি দিয়ে তিনি জানান, আমরা শুধু বলেছি সরকারের নীতিমালা মেনেই দর সমন্বয় করতে। তবে, সরকার রোজায় পণ্যটির দাম বাড়াতে চাইছে না। সেজন্য রোজা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভ্যাট ছাড় অব্যাহত রেখেছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত সচিব আবদুর রহিম খান জানান, 'দাম বাড়ানোর কোনো সিদ্ধান্ত নেই। বর্তমান দরেই বিক্রি করতে হবে।'

এদিকে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে খুচরা বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী বলেছেন, তারা চাহিদামতো সয়াবিন তেলের সরবরাহ পাচ্ছেন না। কোম্পানিগুলো ঠিকমতো তেল দিচ্ছে না। তারা বলেন, ডিলারদের পাঁচ কার্টন তেল অর্ডার দিলে এক থেকে দুই কার্টন পাওয়া যায়। ফলে, বাজারে এক ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে।

ট্যারিফ কমিশনের তথ্যমতে, দেশে প্রতি বছর ভোজ্যতেলের চাহিদা ২৩ থেকে ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে আড়াই লাখ টন তেল দেশে উৎপাদিত হয়। বাকি ২০ থেকে ২১ লাখ টন ভোজ্যতেল আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে রমজানে চাহিদা ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টন।

এ বিষয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন জানান, সংকটের কোনো কারণ নেই। আমরা বিগত দিনে দেখেছি দেশে ৫ থেকে ৬টি কোম্পানি সয়াবিনের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়ার পর সাপস্নাই বন্ধ করে দেয়। সাপস্নাই বন্ধ করে দিয়ে তারা সরকারের কাছে প্রস্তাব দেয় দাম বাড়ানোর। এবারও সেটাই করা হচ্ছে। রোজা ঘিরে তারা এমন কারসাজি করছে। ভোক্তাদের জিম্মি করার অপকৌশল কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে