পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পলাতক অবস্থায় ভারতে বসে জুলাই-আগস্ট বিপস্নবের বিরুদ্ধে নানা উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ায় জনমনে গভীর ক্রোধের সৃষ্টি হয়েছে। যার বহিঃপ্রকাশে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় তিন দিন ধরে বিভিন্ন স্থাপনা ও বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এ সুযোগে ষড়যন্ত্রকারী চক্রও ভয়ঙ্কর ফাঁদ পেতে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা চালালেও তা অনেকাংশে ব্যর্থ। এতে নতুন করে অস্থিরতার শঙ্কায় জনমনে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও ভীতির সঞ্চার হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাসের মাথায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যখন কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসছিল ঠিক এ সময়ে দেশকে নতুন করে অস্থিতিশীল করে তোলার ষড়যন্ত্র তীব্র গতি পেয়েছে। যা দেশের অর্থনীতিসহ সার্বিক পরিস্থিতির জন্য অশনি সংকেত। এ সংকট দ্রম্নত সামাল দেওয়া না গেলে দেশজুড়ে ভয়াবহ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারী চক্র এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশকে অগ্নিগর্ভ করে তুলবে।
এদিকে গত তিন দিনে একযোগে দেশের ৩৫ জেলায় আওয়ামী লীগের কার্যালয়, দলটির কেন্দ্রীয় নেতা, সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের বাড়ি ও বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাকে স্রেফ জনগণের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বলে মেনে নিতে চাইছেন না সুধীজনরা। তাদের অভিমত, এর নেপথ্যে গভীর কোনো ষড়যন্ত্র রয়েছে। এছাড়া, এ ধরনের ঘটনা প্রতিহতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা দেশের সাধারণ মানুষকে ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে। দলমত নির্বিশেষে সব শ্রেণিপেশার মানুষ নতুন করে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
তাদের শঙ্কা, গণ-অভু্যত্থানের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার দেওয়া নানা উসকানিমূলক বক্তব্যে ক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার ভিড়ে মিশে সংঘবদ্ধ ষড়যন্ত্রকারী চক্র তাদের বিশেষ মিশন সফল করতে নানা অপতৎপরতা চালাতে পারে। এতে নিরীহ মানুষেরও হয়রানি-নির্যাতনের শিকার হওয়ার ভয় রয়েছে। এছাড়া, হামলা-পাল্টা হামলাসহ বিভিন্ন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে আমদানি-রপ্তানিসহ সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা দেখা দিতে পারে। শিল্পখাতে দেখা দিতে পারে অস্থিরতা। এতে মূল্যস্ফীতি আরও এক ধাপ বেড়ে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠার জোরালো আশঙ্কাও রয়েছে।
এদিকে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছে খোদ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তাদের শঙ্কা, ভারতে আত্মগোপনে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উসকানিতে নতুন করে বিপদ ঘনিয়ে আসছে। গত ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর মামলা-হামলার ভয়ে ঘরছাড়া নেতাকর্মীরা অনেকেই আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করলেও সে পথ এখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যেসব নেতাকর্মী ঘরবাড়িতে ফিরতে না পারলেও আশপাশের এলাকায় অবস্থান করতে পারছিল, তাদের ফের আত্মগোপনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের উসকানির কারণে দলের নেতাকর্মীদের 'অপারেশন ডেভিল হান্ট'র থাবায় পড়তে হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের থানা পর্যায়ের একজন নেতা এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'নেতারা কোটি কোটি টাকা কামাইয়্যা এখন বিদেশে বসে আমোদ-ফুর্তি করছেন। আর আমরা ছয় মাস পালাইয়্যা থাকতে গিয়া টাকা-পয়সা সব খুঁইয়াছি। এলাকার বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের ম্যানেজ কর্ইযা পরিবার-পরিজন ঘরে রেখে নিজে অন্য এলাকায় থাকতাছি। কিন্তু এখন ফের পালাইতে হইব। 'অপারেশন ডেভিল হান্ট' শুরু হইলে বাঁচতে পারুম কিনা আলস্নাহই জানে।'
ওই নেতার ভাষ্য, ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালের বিভিন্ন ঘটনায় তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ একাধিক মামলা হয়েছে। গত ছয় মাসে এর একটিতেও তিনি জামিন নিতে পারেননি। তাই 'অপারেশন ডেভিল হান্ট' ধরা পড়লে তাকে নিশ্চিত জেলে যেতে হবে। অথচ তার পক্ষে আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মতো পরিবারে আর কেউ নেই। দলীয় সহকর্মীরা ধাওয়ার ওপর থাকায় তারাও তাকে সহায়তা করতে পারবে না। ফলে চারদিকে তিনি ঘোর অন্ধকার দেখছেন।
এদিকে অপরাধ পর্যবেক্ষকদের শঙ্কা, ৭ ফেব্রম্নয়ারি গাজীপুরে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ তুলে তার ক্যাডাররা ছাত্র-জনতার ওপর যেভাবে ভয়ঙ্কর হামলা চালিয়েছে, এ ধরনের ঘটনা আগামীতে আরও ঘটতে পারে। আন্দোলনের নামে উসকানির ফাঁদে পা দিয়ে আওয়ামী লীগের দুষ্কৃৃতিকারীরা চোরাগোপ্তা হামলাও চালাতে পারে। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের ভাইরাল হওয়া ফোনকলের হুঙ্কারে এরই পূর্বাভাস স্পষ্ট বলে মনে করেন তারা।
প্রসঙ্গত, অতিসম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নেতাকর্মীদের সঙ্গে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের একটি ফোনকল ভাইরাল হয়েছে। ফোনকলে জাহাঙ্গীর হুমকি দিয়ে বলেন, ?'আমাদের সব টিম রেডি আছে। আমাদের সম্রাট ভাই এখানে আছেন। রাজধানীতে আমরা থাকতে চাই। আমাদের স্পষ্ট কথা, যে রাজধানীতে আমাদের মানুষ দিনে শান্তিতে ঘুরতে পারবে না, চলতে পারবে না, সেই রাজধানীর মানুষ রাতে ঘুমাতে পারবে না। আমাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, যে রাজধানীতে আমরা দিনে থাকতে পারব না সেই রাজধানীর মানুষের ঘুম আলস্নাহ দেবে না। আমরা সেইভাবে আমাদের তৈরি করে নিয়েছি।'
প্রায় ছয় মিনিটের ফোনকলে তিনি আরও বলেন, 'সব বিভাগ-জেলার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। সময়মতো মূল ব্যক্তিদের কাছে ম্যাসেজটা চলে যাবে। আমরা সময়মতো বুঝিয়ে দিতে চাই, আমরা কার সৈনিক। আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি, আপনারা তার রেজাল্ট পাবেন।'
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কা, আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের দুষ্কৃতিকারীরা নানা অপকৌশলে দেশকে অস্থিতিশীল করার মিশন নিয়ে এরইমধ্যে মাঠে নেমে গেছে। তারা এখন সময় ও সুযোগের অপেক্ষা করছে। দ্রম্নত তাদের প্রতিহত করা না গেলে যে কোনো ধরনের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
তবে আওয়ামী লীগের দুষ্কৃতিকারীদের দেশকে অস্থিতিশীল করার ফন্দি ও তাদের নানা অপকৌশলকে ততটা পাত্তা দিচ্ছেন না অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারকরা। তাদের দাবি, এ ব্যাপারে সরকার যথেষ্ট সতর্ক রয়েছে। দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির মিশন নিয়ে কোনো গোষ্ঠী মাঠে নামলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের কঠোরভাবে মোকাবিলা করবে। এ ব্যাপারে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া আছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে ও সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে ইতোমধ্যে যৌথ বাহিনীর সমন্বয়ে 'অপারেশন ডেভিল হান্ট' পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শনিবার থেকে সারাদেশে এই অভিযান শুরু হয়েছে।
এদিকে পুলিশের শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তাদের দাবি, আওয়ামী লীগের ক্যাডার কিংবা অন্য কোনো দুষ্কৃতিকারী চক্র বিশেষ কোনো মিশন নিয়ে মাঠে নামলে তাদের কঠিন বিপদে পড়তে হবে। জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুরসহ কোনো ধরনের নাশকতা করার চেষ্টা করলে তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তার করা হবে। দেশকে অস্থিতিশীল করতে বিশেষ গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র বানচাল করে দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ফুট ও কার পেট্রোল এবং গোয়েন্দা নজরদারিসহ সব ধরনের তৎপরতা বাড়িয়েছে বলে দাবি করেন তারা।
যদিও তাদের এসব দাবি অনেকটাই কথার 'ফুলঝুঁড়ি' বলে মনে করেন অনেকেই। তাদের ভাষ্য, গত কয়েকদিনে আওয়ামী লীগের কার্যালয়, দলটির কেন্দ্রীয় নেতা, সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের বাড়ি ও বিভিন্ন স্থাপনায় যেসব হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে- এর কোনোটিই পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। এমনকি অনেক স্পটে পুলিশ দীর্ঘ বিলম্বে পৌঁছেছে। গত ৭ ফেব্রম্নয়ারি রাতে একদল দুর্বৃত্ত গাজীপুরে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়িতে লুটপাটের চেষ্টা করছে এমন খবর পেয়ে ছাত্ররা সেখানে ছুটে গেলে তাদের ডাকাত ঘোষণা দিয়ে স্থানীয়রা বেধড়ক মারধর করে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এ সময় তারা পুলিশের হাতপায়ে ধরে আটক শিক্ষার্থীদের উদ্ধারের জন্য অনুরোধ জানালেও ওসি তাতে সাড়া দেয়নি, যা পরবর্তীতে পুলিশ কমিশনার নিজেই স্বীকার করেন।
এদিকে গত তিনদিনের বিভিন্ন হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা প্রতিরোধে 'সরকারের বিবৃতিনির্ভর নির্লিপ্ততায়' ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। শনিবার এক বিবৃতিতে 'উদ্ভূত পরিস্থিতিকে গণতন্ত্রে উত্তরণ, সুশাসন ও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁঁকিপূর্ণ' উলেস্নখ করে এমন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে সরকারের কার্যকর ভূমিকা অপরিহার্য বলে মনে করে টিআইবি।
অন্যদিকে এ ধরনের হামলা, ভাঙচুরের ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডবিস্নউ) এক বিবৃতিতে বলেছে, 'ক্ষমতাচু্যত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ন্যায্য হলেও আইনের লঙ্ঘন ন্যায্য নয়।'
দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিএনপিও দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। দলটি বলেছে, সরকার উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষমতা প্রকাশ করতে না পারলে রাষ্ট্র ও সরকারের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে। জনগণ এভাবে নিজের হাতে আইন তুলে নিলে দেশ-বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে।