শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৩ বৈশাখ ১৪৩২
গুঁড়িয়ে দেওয়া ধানমন্ডি ৩২

ইট ও রড নেওয়ার হিড়িক মাটি খুঁড়ে বিদু্যতের তারও

যাযাদি রিপোর্ট
  ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
ইট ও রড নেওয়ার হিড়িক মাটি খুঁড়ে বিদু্যতের তারও
ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে হাতুড়ি দিয়ে কংক্রিটের বিম ভেঙে রড বের করা হচ্ছে। ছবিটি শুক্রবার তোলা -সংগৃহীত

অর্ধেকের বেশি গুঁড়িয়ে দেওয়া ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িটি ঘিরে তৃতীয় দিনেও রয়েছে উৎসুক জনতার ভিড়। শুক্রবার বাড়িটি ভারী কোনো যন্ত্র দিয়ে ভাঙা না হলেও হাতুড়িপেটা করে ইট খুলে, হ্যাকসো বেস্নড দিয়ে রড কেটে নিয়ে যাচ্ছে যে যার মতো।

ভারতে পালিয়ে থাকা শেখ হাসিনার ক্ষমতাচু্যতির ছয় মাস পূর্তির দিনে 'বুলডোজার মিছিল' কর্মসূচি থেকে এই ভাঙচুর শুরু হয়।

বুধবার রাতে একটি ক্রেন ও দু'টি এক্সকাভেটর দিয়ে শেখ মুজিব ও ঐতিহাসিক অনেক ঘটনার সাক্ষী বাড়িটি ভাঙা শুরু হয়। পরদিন বৃহস্পতিবারও সকালে একটি এক্সকাভেটর দিয়ে চলে বাড়ি ভাঙা। সেদিন সকাল সাড়ে ১০টার পর একমাত্র এক্সকাভেটরটি সরিয়ে নেওয়ার পর আর কোনো ভারী যন্ত্রপাতি আনা হয়নি।

বৃহস্পতিবার দিনভর সেখানে লুটপাটের পর শুক্রবারও ভবন দু'টির ভাঙা স্তূপ থেকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে রড বের করে কেটে নিয়ে যেতে দেখা গেছে।

কেউ এখনো ভবনের দাঁড়িয়ে থাকা অংশেই রোডের খোঁজে চালাচ্ছেন হাতুড়ি। আবার কেউ ফাঁকা অংশের মাটি খুড়ে বের করছেন বৈদু্যতিক তার।

কেরানীগঞ্জ থেকে ৫ জনের একটি দল এসে ভাঙা স্তূপ থেকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে রড বের করে জমা করছিলেন। এদের একজন তাজুল ইসলাম জানালেন, খবর পেয়ে শুক্রবারই এসেছেন রড নিতে।

তিনি বলেন, 'সকাল থেইকা আইসা খোলা শুরু করছি। যতক্ষণ পারি খুলি, এরপরে ভাঙারির দোকানে নিয়া বেইচা দিমু।'

মোহাম্মদপুর থেকে এসে ভবনের আরেক পাশে ভাঙা স্তূপ থেকে রড কাটতে থাকা দেলোয়ার বলেন, 'সবাই নিতাছে, আমিও নিই। কালকেও কিছু নিয়া রাখছি। আজকে যা পারি একলগে কইরা বেচমু।'

একদল যুবককে মাটি খুঁড়তে দেখে জানতে চাইলে জালাল নামের একজন বলেন, 'কারেন্টের তার আছে, ওইগুলা বাইর করমু। তারের মেলা দাম পাওন যায়।'

এদিনও বাড়িটি ঘিরে উৎসুক জনতার ভিড়, যারা ঘুরেফিরে দেখছিলেন। কেউ কেউ ছবি তুলছেন। পাশের রাস্তা দিয়ে যেতেও অনেকে বাড়িটির সামনে এসে খানিকটা দাঁড়াচ্ছেন, কেউ ছবি তুলছিলেন।

কয়েক বন্ধু নিয়ে উত্তরা থেকে দেখতে আসা শামীম আহমেদ নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, 'আমরা স্বৈরাচারের পরিণতি কী হয় সেটা দেখতে আসছি। কয়েকমাসের ব্যবধানে কী জায়গাটা কী হয়ে গেল। মাটির সঙ্গে মিশে গেল সব। আশা করছি, ভবিষ্যতে সবাই এ থেকে শিক্ষা নেবে।'

তৌহিদ হোসেন নামের একজন বলেন, 'এই যে লাখ লাখ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, হাজার হাজার কোটি টাকা বানাইছে একেকজন, তারা আজ কই? শেখ মুজিবুরে মারল, কেউ আসলোনা, শেখ হাসিনা পালায়ে গেল, কেউ আসলোনা। আজকে শেখ মুজিবের বাড়ি গুঁড়িয়ে দিল, তাও কেউ আসে নাই। তাইলে এত এত দলবাজি, দুর্নীতি, ক্ষমতার বড়াই কীসের জন্য? কেউ বোঝে না জনগণের ক্ষমতার চাইতে বড় কিছু নাই।'

শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় দুই সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন ধানমন্ডির বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী আব্দুস সামাদ ভূঁইয়া। তিনি বলেন, 'যখন জাদুঘর ছিল, তখন একবার ছেলেদের নিয়ে আসছিলাম। কাল থেকেই ছেলেরা বলতেছিল, বাড়িটা ভেঙে দিচ্ছে, দেখতে আসবে। এজন্য নিয়ে আসলাম। সবকিছু নতুন করে গড়া সম্ভব, কিন্তু কিছু ইতিহাস, কিছু স্মৃতি হাজার কোটি টাকা দিলেও আবার গড়া সম্ভব না।'

এর আগে, বৃহস্পতিবার দিনভর এ ভবনে ভাঙচুর ও লুটপাটের পর বিকালবেলায় সেখানে গরু জবাই করে বিরিয়ানি রান্নার পর রাতে জেয়াফতের আয়োজন করা হয়। এ ঘটনার রেশ ছড়িয়েছে দেশজুড়েও। বুধবার রাতের পর বৃহস্পতিবার দিনভর জেলায় জেলায় বঙ্গবন্ধু ও শেখ পরিবারের নামে থাকা ভাস্কর্য ও মু্যরালসহ বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুর করা হয়েছে। খুলে ফেলা হয়েছে তাদের নামে থাকা নামফলক।

ভাঙচুরের পর আগুন দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘরে। অনেক জেলায় দলীয় কার্যালয়ে দেওয়া হয়েছে আগুন।

শেখ সেলিমের বনানীর বাড়িতে আগুন

এদিকে, ক্ষমতাচু্যত শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই শেখ ফজলুল করিম সেলিমের (শেখ সেলিম) ঢাকার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বৃহস্পতিবার রাত দেড়টার দিকে বনানীতে এই আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।

আগুন নেভাতে আসেনি ফায়ার সার্ভিস। সেই আগুন যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, সেজন্য পানির পাইপ দিয়ে তা নেভান স্থানীয়রা।

শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টায় ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিনতলা থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। আগে থেকেই লুটের শিকার বাড়িটির দরজা-জানালা খুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

তৃতীয় তলাটি আগুনে পুড়ে কালো হয়ে গেছে। একটি কক্ষে তখনো আগুন জ্বলছে। বাড়িটিতে কোনো আসবাবপত্র নেই। কেবল কিছু ছবি, অ্যালবাম আর কাগজপত্র এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে।

পাশের একটি বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ কর্মী সাইফুল ইসলাম বলেন, ৫ আগস্টের পর বাড়িটিতে কয়েক দফায় লুট হয়েছে। সেখানে এখন কোনো আসবাবপত্র নেই। বৃহস্পতিবার রাতে হঠাৎই বাড়িটির তিনতলায় আগুন দেখা যায়।

আগুন বাড়তে থাকলে পেছনের বাড়িতে আগুন ছড়ানোর শঙ্কা দেখা দেয় জানিয়ে সাইফুল বলেন, 'দুই বাড়ির মধ্যে মাত্র কয়েক হাত দূরত্ব। পরে ওই বাড়ির লোকেরা আতঙ্কে নেমে আসেন। আশপাশের বাড়ির কর্মীরা মিলে পাইপ দিয়ে পানি মেরে আগুন নেভান।'

ফায়ার সার্ভিসের ডিউটি অফিসার লিমা খানম শুক্রবার বলেন, 'আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা না পাওয়ায় আমাদের গাড়ি যেতে পারেনি।'

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ সেলিমকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। গোপালগঞ্জ-২ আসনের সাবেক এ সাংসদ ও তার পরিবারের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে