শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২ বৈশাখ ১৪৩২
সক্রিয় ষড়যন্ত্রকারী চক্র

অস্থিরতায় পাচারকৃত কালো টাকা!

সাখাওয়াত হোসেন
  ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
অস্থিরতায় পাচারকৃত কালো টাকা!
অস্থিরতায় পাচারকৃত কালো টাকা!

পরিকল্পিতভাবে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির অপচেষ্টা চলছে। এর অংশ হিসেবে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় নানা ইসু্যতে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য উসকে দেওয়ার চেষ্টা করছে সংঘবদ্ধ ষড়যন্ত্রকারী চক্র। এ অপতৎপরতায় ব্যয় নির্বাহের জন্য নানা কৌশলে মাঠপর্যায়ে অর্থের জোগান দেওয়া হচ্ছে। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর এমন তথ্য বেরিয়ে আসার পর সরকার নড়েচড়ে বসেছে। সব ধরনের সন্দেহজনক লেনদেন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে অর্থ জোগানদাতা মূলহোতাদের চিহ্নিত করতে আর্থিক গোয়েন্দারা তৎপর হয়ে উঠেছে। এ অর্থের উৎস খুঁজতে নিবিড় অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে গোয়েন্দারা ধারণা করছেন, বিভিন্ন সময়ে পাচারকৃত কালো টাকা-ই 'ষড়যন্ত্র মিশনে' বিনিয়োগ করা হচ্ছে। সদ্য ক্ষমতাচু্যত রাজনৈতিক দলের গডফাদাররাই এর নেপথ্যে মদত দিচ্ছে।

এদিকে, সরকারকে চাপে ফেলতে ও দেশকে অস্থিতিশীল করতে ক্ষমতাচু্যত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দেশ থেকে পাচার করা অর্থের একটি অংশ এখন আবার রেমিট্যান্সের আদলে দেশে ফিরে আসছে কিনা- নতুন করে সে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাই বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউসের মাধ্যমে দেশে এখন রেমিট্যান্স পাঠাতে হলে অর্থের উৎস জানানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

তবে, আর্থিক গোয়েন্দাদের অনেকেই মনে করেন, বিদেশে পাচার হওয়া কিছু অর্থ দেশে ফিরলেও তা ব্যাংকিং চ্যানেলে আসার কথা নয়। এ অর্থ হয়তো হুন্ডির মাধ্যমেই আসছে। যে কারণে তা শনাক্ত করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া, এ চ্যানেলে আসা অর্থ পুরোটাই দেশ থেকে পাচার করা কালো টাকা কিনা- তা নির্ধারণ করাও অসম্ভব। তবে দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য বিশেষ গোষ্ঠীর অর্থায়নের বিষয়টি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে আসছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার পদমর্যদার একজন কর্মকর্তা জানান, রাজনৈতিক ক্যাডার ও আন্ডারওয়ার্ল্ডের লোকজনের কাছে বিভিন্ন চ্যানেলে মোটা অংকের অর্থ আসার তথ্য তারাও পেয়েছেন। তবে কে বা কারা কীভাবে এ অর্থের জোগান দিচ্ছে, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ এখনো তারা জোগাড় করতে পারেননি।

রাজধানীর মিরপুর-পলস্নবী এলাকার আওয়ামী লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের দুইজন থানা পর্যায়ের নেতা গোপন চ্যানেলে অর্থপ্রাপ্তির কথা স্বীকার করলেও তা দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য ব্যয় করা হচ্ছে না বলে দাবি করেন। ওই দুই নেতার দাবি, পরিস্থিতিগত কারণে তাদের প্রথম সারির নেতারা প্রায় সবাই আত্মগোপনে আছেন। কেউ কেউ বিদেশে পালিয়ে গেছেন। তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচু্যত হওয়ার পর মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা চরম দুর্দশায় পড়েছেন। তাই নেতারা তাদের কিছু অর্থ সহায়তা পাঠাচ্ছেন। মানবিক কারণে তারা এ অর্থ পাঠাচ্ছেন বলে দাবি ওই দুই নেতারা।

তবে সবুজবাগ থানা আওয়ামী লীগের একজন নেতার দাবি, কর্মীদের অনেকের কাছে গোপন চ্যানেলে টাকা আসার কথা শুনেছেন। কিন্তু এখনো তার হাতে এ ধরনের কোনো অর্থ এসে পৌঁছায়নি। ওই নেতার ভাষ্য, এ নিয়ে কিছুটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন। কর্মীরা অনেকেই মনে করছেন, তিনি টাকা পেয়ে তা আত্মসাৎ করেছেন। তাই তিনি সবাইকে এড়িয়ে চলছেন। কর্মীদের দুঃসময়ে এ ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য সংগঠনে নতুন করে ফাটল ধরাচ্ছে বলে দাবি করেন থানা পর্যায়ের ওই নেতা।

রাজধানীর আরও কয়েকটি ওয়ার্ড ও থানা পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতা একই সুরে কথা বললেও গোয়েন্দারা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের ভাষ্য, সব নেতার কাছে টাকা না পৌঁছালেও দেশ ও দেশের বাইরে থেকে যে মোটা অংকের অর্থ সরবরাহ করা হয়েছে- এ তথ্য পুরোপুরি ভুয়া নয়। যার বেশ কিছু তথ্য-প্রমাণ তারা হাতেনাতে পেয়েছেন। যাদের এ অর্থের জোগান দেওয়া হয়েছে, তাদের বেশ কয়েকজন গোয়েন্দাদের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর বিষয়টি স্বীকারও করেছেন।

সংশ্লিষ্টদের দাবি, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে নানা অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে যেসব ব্যবসায়ী-শিল্পপতি ও রাজনৈতিক নেতা শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, তারা নিজেদের অবস্থান ধরে রাখার জন্য তাদের কালো টাকার একটি অংশ ব্যয় করছেন। এরই মধ্যে তারা বেশ কয়েকটি শিল্প গ্রম্নপের এ ধরনের অপতৎপরতায় সম্পৃক্ত থাকার তথ্য পেয়েছেন। এসব বিষয় এখন গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। ওই শিল্প গ্রম্নপগুলোকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। এছাড়া, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নানামুখী অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে 'আঙুল ফুলে কলাগাছ' হওয়া বেশ কিছু রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী তাদের পাচারকৃত কালো টাকা ফিরিয়ে আনছেন। আর এ কারণেই হয়ত রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে।

তবে আর্থিক গোয়েন্দারা কেউ কেউ এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তাদের ধারণা, সম্প্রতি সময়ে ডলারের দাম বেড়েছে। রেমিট্যান্সের বিপরীতে সরকারি খাতের আড়াই শতাংশ এবং ব্যাংকগুলোর নিজস্ব উৎস থেকে আড়াই শতাংশসহ মোট ৫ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। বিগত সরকারের সময়ে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবণতা বাড়লেও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তা কমেছে। মূলত এসব কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে।

কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কিছু দিনের মধ্যেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেখা দেয়। একে কেন্দ্র করে দেশে-বিদেশে চলে নানা অপপ্রচার। বিভিন্ন শিল্পকারখানায় দেখা দেয় শ্রমিক অসন্তোষ। এতে উৎপাদন কর্মকান্ডে ব্যাঘাত ঘটে। এছাড়া, নানা খাতে দাবির নামে আন্দোলনও শুরু হয়। পাশাপাশি বিচ্ছিন্নভাবে চলে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। এসব কর্মকান্ড পরিচালনা করতে নানা উৎস থেকে অর্থের জোগান আসছে। যার অন্যতম হচ্ছে রেমিট্যান্সের একটি অংশ।

ক্ষমতাচু্যত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সরকারের পক্ষের লোকজন নানাভাবে দেশ থেকে টাকা পাচার করেছে। ওইসব টাকার একটি অংশ সরকারের নীতিনির্ধারকদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ওইসব অর্থ এখন রেমিট্যান্সের আদলে দেশে পাঠানো হচ্ছে। যেগুলো দেশের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর প্রাথমিক তদন্তে সত্যতা মিলেছে। এসব কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা ইসু্যতে একটি চক্র পরিকল্পিতভাবে শুরু করে অস্থিরতা- যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকারকে চাপে ফেলানো।

বিভিন্ন সংস্থার তদন্তে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবে মাত্রাতিরিক্ত রেমিট্যান্সের অর্থ এসেছে। এগুলো নগদ তুলে নেওয়া হয়েছে। যার সঠিক হিসাব মিলছে না। পুরো ঘটনাটিই সন্দেহজনক বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ধরনের কিছু ব্যাংক হিসাবের লেনদেন সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, দেশে যে রেমিট্যান্স আসে তার একটি উলেস্নখযোগ্য অংশ আসছে হুন্ডির মাধ্যমে। বর্তমানে হুন্ডির বড় অঙ্কের টাকা স্থানান্তরের ক্ষেত্রে ঝুঁকি রয়েছে। যে কারণে সন্দেহজনক লেনদেনের ক্ষেত্রেও এখন ব্যাংক হিসাব ব্যবহৃত হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, আর্থিক গোয়েন্দাদের দেওয়া তথ্যের সূত্র ধরে সম্প্রতি একটি সার্কুলার জারি করা হয়েছে। এতে বলা হয়, বিদেশ থেকে প্রবাসীরা যে কোনো অঙ্কের রেমিট্যান্স দেশে পাঠাতে তার বিপরীতে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোতে আয়ের উৎস জানাতে হবে এবং এক্সচেঞ্জ হাউস তা সংরক্ষণ করবে। প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে তা জানাতে হবে। অর্থাৎ কোনো গ্রাহকের রেমিট্যান্সের বিপরীতে সন্দেহজনক লেনদেনের ঘটনা চিহ্নিত হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওইসব কাগজপত্র তলব করতে পারবে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও দুটি তথ্য জানাতে বলেছে।

এগুলো হচ্ছে, গ্রাহক যে মুদ্রায়ই রেমিট্যান্স পাঠাক না কেন, ওই মুদ্রার সঙ্গে টাকার বিনিময় হারের পরিপ্রেক্ষিতে প্রেরিত রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাংলাদেশি মুদ্রায় কত তার পরিমাণ উলেস্নখ করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট মুদ্রার সঙ্গে টাকার বিনিময় হার কত ধরা হয়েছে তারও উলেস্নখ করতে হবে। একই সঙ্গে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোর সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কাছে নিরাপত্তা জামানতের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে