শেরপুর জেলা বিএনপির কমিটি গঠন নিয়ে মাসুদের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়

প্রকাশ | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

জাহাঙ্গীর আলম
নানা অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২২ জানুয়ারি শেরপুর জেলা বিএনপির আংশিক আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। এরপরেই নতুন কমিটির গঠনকে কেন্দ্র করে পদ প্রত্যাশী ও তাদের অনুসারীদের পাল্টাপাল্টি অভিযোগে স্থানীয় রাজনীতি এখন সরগরম। দলের একাধিক নেতার বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন গণাধ্যমে চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ এনে প্রচার প্রচারণা শুরু হয়েছে। শীর্ষ পদ প্রত্যাশী প্রায় অর্ধডজন নেতার বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযোগ সামনে এলেও সম্ভাবনা বেশি থাকার পরও শেরপুর জেলা যুবদলের সভাপতি শফিকুল ইসলাম মাসুদের বিরুদ্ধে উঠেছে অভিযোগের পাহাড়। মাসুদ ও তার অনুসারী এবং জাতীয় পর্যায়ে তার পরিচিতদের দাবি, গত ১৭ বছর জেল জুলুম নির্যাতনের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে থাকা মাসুদকে ঠেকাতে তার প্রতিপক্ষ নগ্ন অপ্রচার চালাচ্ছে। দলের তৃণমূল নেতাকর্মীরা মনে করে, বিএনপির কমিটি গঠন নিয়ে মাসুদসহ দলীয় নেতাদের চরিত্র হনন করে অপপ্রচার করায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিএনপি। মাসুদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ:শফিকুল ইসলাম মাসুদের বিরুদ্ধে নানা অন্যায়, অনিয়ম, অপকর্ম ও দুর্নীতির অভিযোগ করেছে তার প্রতিপক্ষ নেতাদের অনুসারীরা। গুরুতর অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, আওয়ামী পরিবারের সন্তান, জামালপুর ব্রিজের ১০০ গজের ভেতরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, কাঁচা বাজার দখল, গরুর হাট দখল ও চাঁদাবাজিসহ আরও নানা অন্যায় ও অনিয়মের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আরও অভিযোগ রয়েছে, তিনি গরিব, নিরীহ ও স্থানীয় কৃষকদের কৃষিজমি অবৈধভাবে দখল করেছেন। ভুক্তভোগীরা কোথাও ন্যায়বিচার পাওয়ার সাহস পাচ্ছেন না এই বিএনপি নেতার ভয়ে। এছাড়া মাসুদ যুবদল ও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও আদর্শিকভাবে আওয়ামী লীগ ঘরানার। তার পিতা আব্দুল লতিফ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে রিলিফ চেয়ারম্যান ছিলেন। মাসুদের দুই ভাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া তার আপন চাচাতো ভাই আকবর চেয়ারম্যান ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ২৪-এর গণঅভু্যত্থানের সময় সরাসরি হামলাকারী ছিলেন। পরে হত্যা মামলার আসামি হয়ে পলাতক রয়েছেন। এর বাইরে শফিকুল ইসলাম মাসুদ ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। বিএনপির এই নেতা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা না চালিয়ে তার চাচাতো ভাই আকবর চেয়ারম্যানের জন্য তিনবার নৌকা প্রতীকের প্রচারণা করেছেন এবং তার অনুসারীদেরও বিএনপির প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন। এছাড়া আওয়ামী লীগের জেলা ও উপজেলার বিভিন্ন নেতাকর্মীদের আশ্রয় দিচ্ছেন এবং আওয়ামী লীগের হত্যা মামলার আসামিদের মামলা থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় বিএনপির এক নেতা বলেন, 'শফিকুল ইসলাম মাসুদ আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিয়েছেন। তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সুসম্পর্ক রয়েছে এবং বর্তমানে তিনি তাদের আশ্রয় দিচ্ছেন। এছাড়া বিএনপির বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উপস্থিত রাখছেন। এভাবে চলতে থাকলে বিএনপির জন্য এটি অত্যন্ত ক্ষতিকর হবে।' জেলা বিএনপির এক নেতা বলেন, 'শফিকুল ইসলাম মাসুদের জনসম্পৃক্ততা নেই। তিনি একের পর এক বিতর্কিত কর্মকান্ড করে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করছেন। তিনি বিএনপির ভেতরে গ্রম্নপিং সৃষ্টি করছেন এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের পুনর্বাসনের চেষ্টা চালাচ্ছেন।' এইসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, 'কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে শেরপুর জেলা বিএনপির রাজনীতি নিয়ে নানাভাবে প্রচার প্রপাগান্ডা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কারা এমন অভিযোগ করা করছে তা সবাই জানে। কিন্তু তাদের নাম বলতে চাইনা শুধু দলের বদনামের বিষয় চিন্তা করে। শুধু বলতে চাই আংশিক যে কমিটিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে তা শুধু অভিযোগের ভিত্তিতে নয়। কেন্দ্র অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এজন্য যাদের অভিযোগ তদন্তে প্রমানিত তাদের করা অভিযোগ নিয়ে দুঃশ্চিন্তার কিছু নেই। কারণ, আমার বিরুদ্ধে করা সব অভিযোগ তদন্ত করেই কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নিবে।' জামালপুর ব্রিজের ১০০ গজের ভেতরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন অভিযোগ প্রসঙ্গে মাসুদ বলেন, 'এটি সরকারী কাজ। এই কাজ তো আমি পাইনি। কিভাবে আমি বালু উত্তোলন করবো? কৃষকের জমি, কাঁচা বাজার, গরুর হাট দখল ও চাঁদাবাজি'র সঙ্গে কোন সম্পৃক্তরা নেই আমার। এসব মিথ্যা অভিযোগ।' আওয়ামী পরিবারের সন্তানের পুনর্বাসনের অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, 'আমার আত্বীয় স্বজনের মধ্যে যারা আওয়ামী লীগ করত তারাই আমার বিরুদ্ধে আরো বেশি মামলা দিয়েছে। আমার চাচাতো ভাই আকবর চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আমাকে সবচেয়ে বেশি নাজেহাল করেছে। তাদের সঙ্গে মিলে কোনো ধরনের কার্যক্রম পরিচালনার প্রশ্নই আসে না। আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসরদের জনগণ ক্ষমা করবে না। আমরাও ক্ষমা করবো না। ' আপনার জনসম্পৃক্ততা নেই এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, 'আওয়ামীগ আমলের নির্বাচনে প্রতিন্দ্বন্দ্বিতা করে স্থানীয় নির্বাচনে আমি ৬০ হাজার ভোট পেয়েছিলাম। জনসম্পৃক্ততা না থাকলে কারচুপির নির্বাচনে এত ভোট পাওয়া যায়?' ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগে যোগদানের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'ছাত্রদলের রাজনীতি দিয়ে শুরু করে ৩৩ বছর ধরে বিএনপি করছি। এর চেয়ে মিথ্যা অভিযোগ আর কি হতে পারে?' শেরপুর জেলার বিএনপি ও অঙ্গ দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বিগত ১৬ বছর শেরপুর জেলা বিএনপির হাতে গোনা কিছু নেতা আন্দোলন সংগ্রামে কর্মীদের আগলে রেখে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের জুলুম হয়রানী ও নির্যাতন উপেক্ষা করে আন্দোলন সংগ্রাম করেন। মাসুদ তাদের মধ্যে অন্যতম। এজন্য মাসুদসহ জেলা বিএনপির পদে প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীদের হেয় করতে নানাভাবে অপপ্রচার ও প্রোপাগান্ডা শুরু হয়েছে। ফলে ক্ষতিগস্ত হচ্ছে জেলা বিএনপিও। এর প্রভাব আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও পড়তে পারে বলে অনেকেই মনে করেন। এরই সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে ফ্যাসিষ্ট আওয়ামীগোষ্টী। মাসুদ ছাড়াও জেলা বিএনপির শীর্স পদেও জন্য আলোচনায় জেলার সাবেক সভাপতি মাহমুদুল হক রুবেল এমপি, সাবেক আহ্বায়ক আলহাজ্ব মো: হযরত আলী, সাবেক যুগ্ম-আহ্বায়ক আওয়াল চৌধুরী, সদস্য সচিব এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শেরপুর সরকারি কলেজের জিএস ফজলুর রহমান তারা, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আক্রামুজ্জামান রাহাত, সাবেক যুগ্ম সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমকে মোরাদুজ্জামান ও শেরপুর শহর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবু রায়হান রুপনের নামেও অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ রয়েছে। প্রসঙ্গত, শেরপুর জেলা বিএনপির মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি গতবছর ৩ নভেম্বর বিলুপ্ত করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি আংশিক আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব মো. হযরত আলীকে আহ্বায়ক, সাবেক সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আওয়াল চৌধুরীকে যুগ্ম-আহ্বায়ক ও সহসভপাতি আলহাজ্ব মো. সিরাজুল ইসলামকে সদস্য সচিব করা হয়। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানাভাবে প্রচার প্রপাগান্ডা শুরু হওয়ার কারণে হঠাৎ করে গত ২ জানুয়ারি বিএনপির হাই কমান্ড জেলা বিএনপির আংশিক আহ্বায়ক কমিটি স্থগিত ঘোষণা করে। ফলে দলের ভিতরে-বাহিরে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইতে শুরু করে। দলের একাধিক নেতার বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন গনমাধ্যমে চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ এনে প্রচার প্রচারণা শুরু হয়। এ ঘটনায় কেন্দ্রীয় কমিটি তদন্ত করার জন্য একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করে দেয়। কমিটি বিষয়টি তদন্ত করে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে প্রতিবদন জমা দেয়। এ অবস্থায় মাত্র ২০ দিনের মাথায় গত ২২ জানুয়ারি স্থগিত আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।