বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা

গণ-অভু্যত্থান বইমেলায় নতুন তাৎপর্য নিয়ে সামনে এসেছে

অর্ধশতাব্দী পর এই মহাবিস্ফোরণ গণ-অভু্যত্থান হয়ে আমাদের পাল্টে দিল, নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় গ্রথিত করে দিয়ে গেল। একুশ আমাদের মূল সত্তার পরিচয়
যাযাদি রিপোর্ট
  ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
গণ-অভু্যত্থান বইমেলায় নতুন তাৎপর্য নিয়ে সামনে এসেছে
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শনিবার বিকালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অমর একুশে বইমেলা উদ্বোধন শেষে বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন -স্টার মেইল

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এবার গণ-অভু্যত্থান বইমেলায় নতুন তাৎপর্য নিয়ে আমাদের সামনে এসেছে। এবারের একুশের প্রেক্ষিত আমাদের নতুন দিগন্তে প্রতিস্থাপিত করেছে। একুশে মানেই আত্মপরিচয়ের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়া, অবিরাম সংগ্রাম। বরকত, সালাম, রফিক, জব্বারের বুকের রক্তে যে অঙ্গীকার মাখা ছিল, তাতে ছিল জুলাই অভু্যত্থানকে নিশ্চিত করার মহাবিস্ফোরক শক্তি।

শনিবার বিকাল তিনটায় রাজধানীর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে মাসব্যাপী একুশে বইমেলার উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

বায়ান্নর ভাষা অন্দোলনে শহীদদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, 'অর্ধশতাব্দী পর এই মহাবিস্ফোরণ গণ-অভু্যত্থান হয়ে আমাদের পাল্টে দিল, নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় গ্রথিত করে দিয়ে গেল। ১৭ কোটি মানুষের প্রতিজনের সত্তায় এই প্রত্যয় গভীরভাবে গ্রথিত হলো। একুশ আমাদের মূল সত্তার পরিচয়। একুশ আমাদের দৃঢ়বন্ধন, যা সব কিছুর ঊর্ধ্বে। এই জন্য আমরা শহীদ মিনারে ছুটে যাই। সেখানে জাতীয় ঐক্য খুঁজে পাই। একুশ আমাদের পথ দেখায়। জুলাই অভু্যত্থান জাতিকে এক ঐতিহাসিক গভীরতায় ঐক্যবদ্ধ করে দিয়েছে। যার কারণে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং মানবিক দিক থেকে বিধ্বস্ত এক দেশকে নতুন করে তৈরি করার সাহস খুঁজে পেয়েছি।'

নোবেলজয়ী অধ্যাপক তার ভাষণে জুলাই গণ-অভু্যত্থানে ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে বলেন, 'গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক অভু্যত্থানের মধ্য দিয়ে জাতির ঘাড়ে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে চেপে থাকা স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটেছে। আমাদের সাহসী তরুণদের এই অভূতপূর্ব আত্মত্যাগ বিশ্বকে চমকে দিয়েছে। এই বিজয়ের মাধ্যমে এসেছে "নতুন বাংলাদেশ" গড়ার ইস্পাত কঠোর প্রতিজ্ঞা।'

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, 'আমাদের তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরীরা রাস্তার দেয়ালে দেয়ালে তাদের স্বপ্নগুলো, তাদের আকাঙ্ক্ষাগুলো, তাদের দাবিগুলো অবিশ্বাস্য দৃঢ়তায় এঁকে দিয়েছে। আমাদের রাস্তার দেয়াল এখন ঐতিহাসিক দলিলে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। এগুলোর স্থান এখন জাদুঘরে হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।'

বাংলা একাডেমির বইমেলা জাতীয় জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে বলে উলেস্নখ করে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, 'ক্রমে ক্রমে এর গুণগত ও আয়োজনগত বিবর্তন হতেই থাকবে। বইমেলায় হাজির করার জন্য লেখক-লেখিকারা সারা বছর প্রস্তুতি নিতে থাকেন যথাসময়ে নিজ নিজ বই সমাপ্ত করার জন্য। প্রকাশকরা অনেক আয়োজন করেন নিজেদের বইগুলো যথাসময়ে হাজির করার জন্য। গুণগত প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করার জন্য এবং আগ্রহ বাড়ানোর জন্য প্রতিবছর বিষয়ভিত্তিক সেরা লেখক স্বীকৃতির আয়োজন করলে লেখকরা এই স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য এবং সেরা লেখকদের সেরা প্রকাশক পাওয়ার ব্যাপারে অনেক সহায়ক হবে।'

এর আগে জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে বইমেলা উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। বরাবরের মতো এবারো রেওয়াজ মেনে বইমেলার সূচনা সঙ্গীত হিসেবে পরিবেশন করা হয় 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি' গানটি। সুর সপ্তকের শিল্পীরা জাতীয় সঙ্গীত ও সূচনা সঙ্গীত পরিবেশন করেন।

শুরুতে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাই গণ-অভু্যত্থানে শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি আবুল কাসেম ফজলুল হক।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির প্রকাশিত বিভিন্ন বই প্রধান উপদেষ্টাকে উপহার দেওয়া হয়। প্রধান উপদেষ্টা বইমেলার উদ্বোধনী স্মারকে স্বাক্ষর করেন।

এর আগে বইমেলার উদ্বোধন মঞ্চে প্রধান উপদেষ্টা সাত লেখকের হাতে তুলে দেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। পুরস্কারপ্রাপ্তরা হলেন- কবিতায় মাসুদ খান, নাটক ও নাট্যসাহিত্যে শুভাশিস সিনহা, প্রবন্ধ/গদ্যে সলিমুলস্নাহ খান, অনুবাদে জি এইচ হাবীব, গবেষণায় মুহম্মদ শাহজাহান মিয়া, বিজ্ঞানে রেজাউর রহমান ও ফোকলোরে সৈয়দ জামিল আহমেদ।

ভাষার মাসের প্রথম দিনে প্রধান উপদেষ্টার উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে পর্দা উঠল বইপ্রেমী মানুষের প্রাণের মেলার, অপেক্ষা ঘুচল লেখক-প্রকাশক আর পাঠকের। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এবারের মেলার প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে- 'জুলাই গণ-অভু্যত্থান : নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ'।

সেইসঙ্গে মেলার রঙ, প্রতিপাদ্য আর দৃশ্যপটেও এসেছে পরিবর্তন। আর গণআন্দোলনের স্মৃতি স্মরণে আছে 'জুলাই চত্বর'। বইমেলা সেজেছে লাল-কালো আর সাদা রঙে। ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বিপস্নব, শোক আর আশার প্রদীপ।

বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিকাল ৩টার দিকে বাংলা একাডেমিতে প্রবেশ করেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয়। ফেরদৌস আরার পরিচালনায় পরিবেশন করা হয় অমর একুশের গান।

পরে ফিতা কেটে বইমেলা উদ্বোধন করে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের বিভিন্ন স্টল পরিদর্শন করেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।

সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, বাংলা একাডেমির সভাপতি আবুল কাসেম ফজলুল হক, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম এ সময় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ছিলেন।

প্রধান উপদেষ্টা বাংলা একাডেমি চত্বর ত্যাগ করার পর সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় মেলা প্রাঙ্গণ। দর্শনার্থীদের কেউ কেউ প্রবেশ করেন মেলার মাঠে। বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার কর্মীদের দেখা যায় স্টল গোছাতে।

বেড়েছে পরিসর

ভাষার মাস ফেব্রম্নয়ারিজুড়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে চলবে মেলা। এবার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বেড়েছে শতাধিক, বেড়েছে আয়তনও। বইমেলার সদস্য সচিব সরকার আমিনের ভাষ্য, 'অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ও আয়তনের দিক থেকে এবার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বইমেলা হচ্ছে। শতাধিক নতুন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অংশ নিচ্ছে।'

বইয়ের মান বিবেচনায় নিয়েই নতুন প্রকাশনী সংস্থাকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে জানান বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। তিনি বলেন, 'এবার অনেক নতুন প্রকাশনী মেলায় যুক্ত হয়েছে। আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক মনোভাব নিয়ে তাদের বরাদ্দ দিয়েছি এবং মান বিবেচনায় নতুন প্রকাশনীকে স্টল দেওয়া হয়েছে।'

এবারের বইমেলায় ৭০৮টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ১ হাজার ৮৪ ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গত বছর প্রতিষ্ঠান ছিল ৬৪২টি, আর ইউনিট ছিল ৯৪৬টি। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ৯৯টি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৬০৯টি প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এবার মোট প্যাভিলিয়নের সংখ্যা ৩৭টি, যার মধ্যে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে থাকছে ৩৬টি। গত বছরও প্যাভিলিয়নের সংখ্যা ৩৭টি ছিল। লিটল ম্যাগাজিন চত্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্মুক্ত মঞ্চের কাছাকাছি গাছতলায় করা হয়েছে। সেখানে ১৩০টি লিটলম্যাগকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শিশু চত্বরে ৭৪টি প্রতিষ্ঠানকে ১২০ ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গত বছর শিশু চত্বরে ৬৮টি প্রতিষ্ঠানকে ১০৯ ইউনিট দেওয়া হয়েছিল।

প্রতিদিন বিকাল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে সেমিনার ও সন্ধ্যায় থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ৮ ফেব্রম্নয়ারি ও ১৫ ফেব্রম্নয়ারি ছাড়া প্রতি শুক্র ও শনিবার মেলায় সকাল ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত থাকবে 'শিশুপ্রহর'। অমর একুশ উদযাপনের অংশ হিসেবে শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি ও সঙ্গীত প্রতিযোগিতা থাকছে। উদ্যানে থাকবে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা।

২৮ ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মেলা খোলা থাকবে। রাত সাড়ে ৮টার পর নতুন করে কেউ মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে পারবেন না। ছুটির দিন বইমেলা চলবে বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। একুশে ফেব্রম্নয়ারি শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে মেলা শুরু হবে সকাল ৮টায়, চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত।

চট্টগ্রামে বইমেলার উদ্বোধন

চট্টগ্রাম বু্যরো জানায়, শনিবার বিকাল ৩টায় নগরের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের জিমনেশিয়াম মাঠে মেলার উদ্বোধন করেন অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহায়ন, গণপূর্ত ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। এসময় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন উপস্থিত ছিলেন।

এবারের মেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার জন্য প্রদর্শনীর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে জানিয়ে মেয়র শাহাদাত হোসেন বলেন, 'শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এ আয়োজনে সবাইকে সম্পৃক্ত করে এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের অনেকেই মুঠোফোন ও মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছে। সময়, অর্থ, স্বাস্থ্য সবাই শেষ করছে এর পেছনে। এতে তারা প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বই অন্যতম বন্ধু, যা তাদের মুঠোফোন ও মাদকের আসক্তি থেকে বের করে সৃজনশীল মেধাবী প্রজন্ম হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।'

মেলায় প্রকাশকরা জানায়, চট্টগ্রামের মানুষ সবসময় মেলাবান্ধব। এখানে মেলা হলে পাঠক ও দর্শনার্থীদের সাড়া থাকে। তবে বর্তমানে আকাশ সংস্কৃতি এবং মোবাইলের বহুমাত্রিক ব্যবহারের কারণে পাঠকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।

তারা জানান, চট্টগ্রামের এই মেলা পাঠক ও প্রকাশকদের জন্য বড় একটি সুযোগ। তবে বইয়ের দাম বৃদ্ধির কারণে ক্রেতাদের সংখ্যা কিছুটা কম হতে পারে। তরুণ প্রজন্মকে বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করতে শিক্ষক ও অভিভাবকদের বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে।

এবার বইমেলায় ১ লাখ বর্গফুটের বেশি আয়তনের জিমনেসিয়াম মাঠে সর্বমোট ১৪০টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের শীর্ষ প্রকাশনা সংস্থাসহ ১৪০টি স্টল নিয়ে আয়োজন থাকছে মেলায়। এর মধ্যে ঢাকার প্রকাশনা সংস্থা ৪৪টি, চট্টগ্রামের ৭৪টি, ডাবল স্টল রয়েছে ৩৩টি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে