আদালতের নির্দেশ উপেক্ষিত
'অস্বাস্থ্যকর' বায়ুর বৃত্তে ঢাকা
গড় আয়ু কমছে ৬.৯ বছর অসংক্রামক রোগে মৃতু্য বেড়েছে ১৪%
প্রকাশ | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
বীরেন মুখার্জী
বায়ুদূষণে রাজধানী ঢাকার 'অস্বাস্থ্যকর' অবস্থানের 'তকমা' কিছুতেই দূর হচ্ছে না। বৈশ্বিক দূষণের তালিকায়ও মাঝে মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে উঠে আসছে ঢাকার নাম। বছরের বেশিরভাগ সময়ই ঢাকার বায়ুমান থাকছে ১৫০-এর ওপরে। বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সূচকেও দেখা গেছে ঢাকার বায়ুমানের ভয়াবহ এ পরিস্থিতি। স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার গত ৮ বছরের ঢাকার বায়ুদূষণ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখেছেন, এ সময়ের ২৭০২ দিনে মাত্র ৫৭ দিন নির্মল বাতাস পেয়েছে রাজধানীবাসী। বাকি দিনগুলোর বাতাস 'খুবই অস্বাস্থ্যকর' ও 'বিপজ্জনক' ছিল। এমন পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে জানুয়ারি মাসের শেষ দিন শুক্রবার ছুটির দিনও বায়ুদূষণের তালিকায় বিশ্বের ১২৪ টি দেশের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ছিল চতুর্থ।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুষ্ক মৌসুম এলেই ঢাকা বায়ুমান 'বিপজ্জনক' পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। চলতি জানুয়ারি মাসের ৩১ দিনই ঢাকার বায়ুমান পরিস্থিতি 'অস্বাস্থ্যকর' ছিল। এর মধ্যে কয়েকদিন ছিল 'খুবই অস্বাস্থ্যকর' ও 'বিপজ্জনক'। বায়ুদূষণের ভয়াবহতা দিনে দিনে এতটাই খারাপের দিকে যাচ্ছে যে, তা বারবার উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়াচ্ছে। বায়ুদূষণ রোধে আদালত বারবার নির্দেশনা দিলেও গত দুই বছরে এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান উৎস যানবাহন, অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ, কলকারখানার দূষিত ধোঁয়া আর ইটভাটা হলেও এসব উৎস বন্ধে সরকারি উদ্যোগগুলো মোটেও কার্যকর হচ্ছে না বলে মনে করছেন তারা।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক বায়ুমান প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার বলছে, বাতাসের মান নির্ভর করে ভাসমান সূক্ষ্ণ ধূলিকণার পরিমাণ (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম-১০) এবং অতি সূক্ষ্ণ ধূলিকণার পরিমাণের (পিএম ২.৫) ওপর, যা পরিমাপ করা হয় প্রতি ঘনমিটারে মাইক্রোগ্রাম (পার্টস পার মিলিয়ন-পিপিএম) এককে। দূষণের মাত্রা বুঝতে পিএম ২.৫, পিএম ১০ ছাড়াও সালফার হ পৃষ্ঠা ২ কলাম ২
ডাই অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড ও গ্রাউন্ড লেভেল ওজোনে সৃষ্ট বায়ুদূষণ বিবেচনা করে তৈরি করা হয় এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স বা একিউআই। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স ৫১ থেকে ১০০ হলে তাকে 'মাঝারি' বা 'গ্রহণযোগ্য' মানের বায়ু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১০১ থেকে ১৫০ স্কোরকে 'সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর' ধরা হয়। স্কোর ১৫১ থেকে ২০০ হলে তা 'অস্বাস্থ্যকর' বায়ু। স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে তাকে 'খুবই অস্বাস্থ্যকর' বায়ু ধরা হয়। ৩০১ থেকে তার ওপরের স্কোরকে 'দুর্যোগপূর্ণ' বা 'ঝুঁকিপূর্ণ' ধরা হয়।
সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের (সিআরইএ) গবেষণা মতে, দেশে বায়ুদূষণে প্রতিবছর ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৬ জন মানুষ মারা যাচ্ছেন। তাদের মধ্যে ৫ হাজার ২৫৮ জন শিশু রয়েছে, যা মৃতু্যর ৫ শতাংশ। একই কারণে প্রতিবছর ৯ লাখ ৪৮৫ মায়ের অকাল প্রসব হচ্ছে ও জন্ম নিচ্ছে কম ওজনের প্রায় সাত লাখ শিশু। এমনকি বায়ুদূষণজনিত অ্যাজমা রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর হাসপাতালগুলোর জরুরি বিভাগে সেবা নিচ্ছে ৬ লাখ ৬৮ হাজার ৪৮২ মানুষ। এই দূষণে গড়ে বছরে ২৬ কোটি ৩০ লাখ কর্মদিবস হারাচ্ছে দেশের মানুষ। আর স্টেট অব গেস্নাবাল এয়ার রিপোর্টের পঞ্চম সংস্করণে দেখা গেছে, ২০২১ সালে বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে অন্তত দুই লাখ ৩৬ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
হাইকোর্ট জানুয়ারি মাসের ১২ তারিখ বায়ুদূষণের ভয়াবহতা রোধে সাত দিনের মধ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেন। নির্দেশে উচ্চ আদালতের আগে দেওয়া ৯ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে ২৬ জানুয়ারি প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়। এর আগে ২০২৩ সালে বায়ুদূষণ রোধে আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন না করায় অসন্তোষ প্রকাশ করে হাইকোর্ট বলেন, 'দূষণের মাধ্যমে মানুষকে মেরে ফেলা হচ্ছে। উচ্চ আদালত বায়ুদূষণ রোধে যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন তার ছিটেফোঁটাও বাস্তবায়ন হয়নি। অবৈধ ইটভাটাও বন্ধ করা হয়নি। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা যদি বাস্তবায়ন না করা হয়, পানি ছিটানো না হয় তাহলে আমরা প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তলব করে ব্যাখ্যা চাইব।'
বাস্তবতা হলো, দু'টি সিটি করপোরেশন ঢাকার সড়কে নিয়মিত পানি ছিটালেও বায়ুদূষণ রোধে তা ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা নিজের ব্যর্থতা অন্যের কাঁধে চাপিয়ে দিতে অজুহাত খুঁজছে। আর এমন পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে বুধবার সকালে রাজধানীর ৯ স্থানে ভয়ানক বায়ুদূষণের তথ্য সামনে আসে। বায়ুদূষণের এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে অনতিবিলম্বে জরুরি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন পরিবেশকর্মী ও অধিকারকর্মীরা। ঢাকার বায়ুদূষণের ভয়াবহতার মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর হটলাইন চালু করেছে।
বায়ুদূষণের পরিস্থিতি নিয়মিত তুলে ধরা আইকিউএয়ারের তথ্যে জানা যায়, ২৯ জানুয়ারি রাজধানীর গোড়ানে বায়ুর মান অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ১২২০ স্কোরে ওঠে। শুধু গোড়ান নয়, এদিন ঢাকার ৯ স্থানের বায়ুর মান ৩০০-এর বেশি ছিল। মারাত্মক দূষিত এলাকার মধ্যে ছিল- ইস্টার্ন হাউজিং-২ (৬৭১), ঢাকার মার্কিন দূতাবাস (৪২৪), শান্তা ফোরাম (৪১৬), গুলশান লেক পার্ক (৪০৭), পশ্চিম নাখালপাড়া রোড (৪০৪), গ্রেস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল (৩৫৮), কল্যাণপুর (৩৩৬) ও মহাখালীর আইসিডিডিআরবি (৩১৬)। এছাড়া এদিন বিভাগীয় শহরগুলোর বায়ুর মানও ছিল নাজুক। এর মধ্যে চট্টগ্রামে মান ১৩৭, রাজশাহী ১৯৭ ও খুলনা ১৮০।
তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি ৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের ৯ দফার মধ্যে ঢাকা শহরে মাটি, বালু, বর্জ্য পরিবহন করা ট্রাক ও অন্য গাড়িতে মালপত্র ঢেকে রাখা, নির্মাণাধীন এলাকায় সব নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, সিটি করপোরেশন রাস্তায় পানি ছিটানো, রাস্তা, কালভার্ট, কার্পেটিং, খোঁড়াখুঁড়ির কাজে দরপত্রের শর্ত পালন নিশ্চিত করা, সড়ক পরিবহন আইন অনুসারে গাড়ির চলাচল সময়সীমা নির্ধারণ ও মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি চলাচল বন্ধ করা, পরিবেশগত সনদ ছাড়া চলমান টায়ার ফ্যাক্টরি বন্ধ করা, মার্কেট-দোকানের প্রতিদিনের বর্জ্য ব্যাগে ভরে রাখা এবং বর্জ্য অপসারণ নিশ্চিত করার বিষয়গুলো রয়েছে। এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে আদালত ২০ বারেরও বেশি সংশ্নিষ্ট দপ্তরকে তলব করেছেন। তবু কোনো কাজ হয়নি।
সর্বশেষ ১২ জানুয়ারি এক আদেশে ৯ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নসহ সাত দিনের মধ্যে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) সম্পূরক আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ওই আদেশ দেন।
বেসরকারি সংস্থা ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ কনসোর্টিয়ামের তথ্য অনুযায়ী, বছরের বেশিরভাগ সময় ঢাকার বাতাস বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিস্নউএইচও) নির্মল বায়ুর মানমাত্রার চেয়ে খারাপ থাকে। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে শীতে ঢাকার বাতাস ১৬ গুণ বেশি দূষিত থাকছে।
এদিকে দেশের শহরগুলোর এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) প্রকাশিত হলেও তা আদতে কোনো কাজেই লাগাতে পারছে না সংশ্নিষ্ট দপ্তর। সারা বিশ্বের মধ্যে বায়ুদূষণে ঘুরেফিরেই শীর্ষে উঠে আসছে ঢাকা। ২০১৬ থেকে ২৪ সালের মধ্যে ২০২৩ সাল ছিল সবচেয়ে দূষিত বছর।
নানান গবেষণা অনুযায়ী, বায়ুদূষণের ভয়াবহ হুমকির মুখে রয়েছেন ঢাকাবাসী। এনভায়রনমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, ১৯৮০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সারা বিশ্বে ১৩ কোটি মানুষের অকালমৃতু্য হয়েছে বায়ুদূষণের কারণে। আবহাওয়ার ধরনের কারণে স্ট্রোক, হৃদরোগ ও ফুসফুসের রোগের সঙ্গে ক্যানসারজনিত মৃতু্য ১৪ শতাংশ বেড়েছে বলেও উলেস্নখ করা হয়েছে গবেষণায়।
এদিকে, স্টেট অব গেস্নাবাল এয়ার তাদের ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে বলেছে, বিশ্বব্যাপী শুধু ২০২১ সালেই ৮০ লাখের বেশি মানুষের মৃতু্য হয়েছে বায়ুদূষণের কারণে। বাংলাদেশে এই মৃতু্যর সংখ্যা ২ লাখ ৩৫ হাজার। অথচ করোনার মতো অতিমারিতেও বাংলাদেশে মোট মৃতু্যর সংখ্যা সরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত ২৯ হাজার ৪৯৯। একটা দেশের এত বিপুল মানুষের মৃতু্য যদি হয় বায়ুদূষণের কারণে, তাহলে এটাকে জরুরি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে ঘোষণা করে আশু পদক্ষেপ কেন গ্রহণ করা হচ্ছে না- বিশেষজ্ঞরা এমন প্রশ্ন তুলেছেন।
বায়ুদূষণে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা সবচেয়ে ভয়াবহ। বিশ্বে ২০২১ সালে বায়ুদূষণে ৫ বছরের কম বয়সি ৭ লাখ শিশু মারা গেছে। মানবশিশুর জন্য সবচেয়ে সুরক্ষিত স্থান হলো মায়ের গর্ভ। কিন্তু শিশুদের জন্য বায়ুদূষণ এতটাই ক্ষতিকর হয়ে উঠেছে যে মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থাতেও তারা আক্রান্ত হচ্ছে, যার প্রভাব সারা জীবন এসব শিশুকে বয়ে বেড়াতে হতে পারে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বায়ুদূষণ ভবিষ্যত প্রজন্মের সামর্থ্য নষ্ট করছে।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্সের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে বায়ুদূষণের অবস্থা এতটাই নাজুক যে, এ কারণে মানুষের গড় আয়ু কমেছে ৬ দশমিক ৯ বছর। অথচ তামাকদ্রব্যের কারণে আয়ু কমেছে এর চেয়েও কম, ১ দশমিক ৬ বছর। বায়ুদূষণের অন্যতম উপাদান পিএম ২ দশমিক ৫ আয়তনে মানুষের চুলের চেয়ে ৩০ গুণ ছোট। তাই সহজেই এগুলো মানুষের ফুসফুস ও রক্তপ্রবাহের মধ্যে ঢুকে পড়ে। আর এটাই ভয়াবহতার অন্যতম কারণ।
বিশেষজ্ঞরা ঢাকার বায়ুদূষণের ৫৮ শতাংশের জন্য দায়ী করেছেন শহরের আশপাশের ইটভাটাগুলোকে। পরিবেশ অধিদপ্তর অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে জানালেও বহু ইটভাটা অনুমোদনবিহীনভাবে চলছে। তা ছাড়া পরিবেশবান্ধব ইটের ব্যবহার নিয়ে নানা আলাপ-আলোচনা হলেও এর প্রচলন তেমন নেই বললেই চলে। নির্মাণকাজে বায়ুদূষণও তাই বেশি। তবে ইটভাটা বন্ধে মাঝেমধ্যে নানা পদক্ষেপের কথা জানা যায়, কিন্তু তাও অত জোরাল নয়।
২০১৫ সালে গৃহীত সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনুযায়ী, ইট তৈরিতে মাটির ব্যবহার ২০২০ সালের মধ্যে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রার পাঁচ বছর পার হলেও এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি চোখে পড়ে না। ইটভাটায় মাটির উপরিভাগ কেটে পোড়ানো হচ্ছে। মাটির পুষ্টি উপাদানের কারণেই ফসল উৎপাদন হয়। আর পুষ্টি থাকে এই উপরিভাগেই, যা গঠনে হাজার বছর সময়ও লাগতে পারে। অথচ কি অবলীলায় নিমেষেই আমরা মাটির উপরিভাগ নষ্ট করছি ইটভাটার চুলিস্নতে পুড়িয়ে! জাতিসংঘের হিসাবমতে, বর্তমান হারে মাটির উপরিভাগ ধ্বংস হতে থাকলে আর ৪৫ থেকে ৬০ বছর পর তা শেষ হয়ে যাবে; অর্থাৎ আমরা আর ফসল ফলাতে পারব না।
অন্যদিকে, ফিটনেসবিহীন গাড়ির কালো ধোঁয়া শহরে বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। কিন্তু এই সমস্যা সমাধানে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। শহর এলাকার বায়ুদূষণ রোধে মেক্সিকো আর চীনের যানবাহন নিয়ন্ত্রণপদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। এ পদ্ধতিতে যানবাহনের লাইসেন্সের নম্বর অনুযায়ী এক দিন পরপর এগুলোকে রাস্তায় নামার অনুমতি দিয়ে বায়ুদূষণ কমানো হয়। এর অর্থনৈতিক ক্ষতি আছে সন্দেহ নেই, কিন্তু মানুষের জীবনের চেয়ে তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না।
প্রতিদিন চলতে-ফিরতে দেখা যায়, রাস্তার পাশে পড়ে আছে নির্মাণকাজের ইট-বালু-সুরকির স্তূপ। সেগুলো গড়িয়ে পড়ছে রাস্তার ওপর। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও স্তূপ করে রাখা মাটিও বায়ুদূষণের বড় উৎস। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন, গণপূর্ত, ওয়াসা, পরিবেশ অধিদপ্তর ইত্যাদি সরকারি সংস্থাগুলো যদি সমন্বয় করে কাজ করত, তাহলে শহরের রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ির কারণে জনদুর্ভোগ যেমন কমত, তেমনি এসব উৎস থেকে দূষণ কমানোও সম্ভব হতো। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এসব ক্ষেত্রে কাউকেই নিয়মনীতির তোয়াক্কা করতে দেখা যায় না। আইন প্রয়োগের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানে কোনো উদ্যোগ পর্যন্ত নেওয়া হয় না।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর জাতীয় বায়ুমান ব্যবস্থাপনা কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। উদ্দেশ্য ছিল দূষণের উৎসগুলো বন্ধ করে বায়ুমানের উন্নতির পাশাপাশি তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করা। বায়ুদূষণ রোধে একটি সমন্বিত টাস্কফোর্সও গঠন করা হয়েছে। কিন্তু কয়েক মাস গত হলেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি চোখে পড়ছে না। এদিকে বায়ুদূষণজনিত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর বা সিটি করপোরেশনের মতো সংস্থা, যারা বায়ুদূষণের উৎসগুলো ঠেকানোর দায়িত্বে রয়েছে, তারা বিভিন্ন সময় বলেছে যে তাদের যথেষ্ট জনবল নেই। এত বড় একটা জনস্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান যদি জনবলের ঘাটতির কারণে আটকে থাকে, তাহলে জনবল কেন বাড়ানো হচ্ছে না? প্রয়োজনে বছরের যে মাসগুলোয় বায়ুদূষণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠে, সে সময়ে অস্থায়ী ভিত্তিতে স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ দিয়েও এর সমাধান করা যায়।
পরিবেশ রক্ষায় দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদ। এ ছাড়া ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনসহ রয়েছে আইন ও বিধিমালা। আবার 'জাতীয় স্বার্থে' পাহাড় কাটা, জলাশয় ভরাট বা রাস্তা বানাতে হাজার হাজার গাছ কাটা হয়ে থাকে। কিন্তু জাতীয় স্বার্থের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা আইনে দেওয়া হয়নি। ফলে গোড়াতেই একটা গলদ রয়েছে। তা ছাড়া যা-ও আইন আছে, তা প্রয়োগের ঘাটতি তো রয়েছেই। জাতিসংঘের পরিবেশ সংক্রান্ত সংস্থা ইউএনইপির হিসাব (২০১৯) অনুযায়ী, পরিবেশ বিষয়ে অনেক আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই যেসব দেশে, বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। আশার কথা যে, সম্প্রতি গাছ কাটা রোধে হাইকোর্ট সংশ্লিষ্টদের অনুমতি নিতে হবে বলে আদেশ দিয়েছেন।
পরিবেশ আদালত আইন ২০১০ অনুযায়ী, প্রতিটি জেলা সদরে পরিবেশ আদালত প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের বাইরে পরিবেশ আদালত নেই। ২০২১ সালের এক হিসেবে দেখা যায়, ঢাকার পরিবেশ আদালতে মোট মামলার মাত্র ৪ দশমিক ১৮ শতাংশ ছিল পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের আওতায়। চট্টগ্রামে এই হার কিছুটা বেশি, ১৩ শতাংশ। এর ব্যাখ্যায় দায়িত্বরত ব্যক্তিরা বলে থাকেন, পরিবেশ অধিদপ্তর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে। তাই পরিবেশ আদালতে মামলা কম যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির সৃষ্টি না হলে পরিবেশ ধ্বংসকারী কর্মকান্ড থামবে না।
বায়ুদূষণ নিয়ে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, 'আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী কোনো এলাকায় পরপর ৩ দিন ৩ ঘণ্টা যদি বায়ুর মানসূচক ৩০০-র বেশি থাকে, তাহলে ওই এলাকায় বায়ুদূষণজনিত স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। এটা আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা পরিবেশ মন্ত্রণালয় কিংবা উভয়ে মিলে নিতে পারে। এই জরুরি অবস্থার সময়ে, বিশেষ করে স্কুল-কলেজগুলো সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা, দূষণকারী শিল্পকারখানা সাময়িকভাবে বন্ধ, যান চলাচলে কঠোরতা জারি এবং স্বাস্থ্যগত সহায়তামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। পরিস্থিতি দেখে আমাদের এখানেও এসব ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।'