মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার, কীটনাশক ও সংবেদনশীল হাইব্রিড বীজ ব্যবহারের কারণে ভালো নেই মাটির স্বাস্থ্য। জমির মাটি হয়ে গেছে বিবর্ণ, অনুর্বর। মাটির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। বিষয়টা মায়ের সঙ্গে শিশুর সম্পর্কের মতো। মায়ের স্বাস্থ্য ভালো থাকলে শিশুর স্বাস্থ্য ভালো থাকে। প্রকৃতির এই অমূল্য সম্পদ মাটিরূপী মায়ের স্বাস্থ্য দিনের পর দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এতে ভয়ানক ঝুঁকিতে পড়েছে দেশের ফসলি জমি। অদূর ভবিষ্যতে ফসল উৎপাদনে বড় ধাক্কা খেতে পারে বাংলাদেশ। নানা কারণে আয়তনে ছোট দেশটির মাটি ভয়ংকর মৃতু্য ঝুঁকিতে পড়েছে, এখন মাটির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধিই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। বিপুল জনসংখ্যার খাদ্যচাহিদা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ কোটি টন। আগামী ২০ বছরে ক্রমবর্ধমান এই জনসংখ্যার খাদ্যচাহিদা পূরণে প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণের বেশি করতে হবে। দেশে নিট ফসলি জমি ৭৯ লাখ ৪৭ হাজার হেক্টর, যা আগামী দিনের খাদ্য উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট নয়। নতুন ঘরবাড়ি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও রাস্তাঘাট তৈরি, নদীভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধিসহ অন্যান্য কাজে আবাদযোগ্য জমি বছরে প্রায় ৭৯ হাজার হেক্টর কমে যাচ্ছে। এ রকম এক পরিস্থিতিতে ক্রমাগত ফসল ফলানোর কারণে এবং মাটিকে যথাযথভাবে ব্যবহার না করায় উবর্রতাশক্তি নষ্ট হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ইটভাটার জন্য মাটির উপরিভাগের উর্বর অংশ তুলে নেওয়া ছাড়াও মাটির টেকসই ব্যবস্থাপনার অভাবে ফসলের পুষ্টি উপাদানের ঘাটতির ফলে মাটি এখন ভয়ংকর হুমকির মুখে রয়েছে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে আজ ৫ ডিসেম্বর, বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও যথাযথ মর্যাদায় দিবসটি পালিত হবে। তবে দেশের বর্তমান পরিস্থিতির কারণে এবার সারা দেশে দিবসটি উদযাপিত হবে না। শুধু ঢাকার খামারবাড়িতে এ উপলক্ষে
র্
যালি, আলোচনাসভা হবে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে 'মাটির পরিচর্যা:পরিমাপ,পরীক্ষণ, পরিচাললন'।
কৃষিবিদ অধ্যাপক ড. সামসুল হুদা বলেন, মাটি বা মৃত্তিকা হলো পৃথিবীর উপরিভাগের নরম আবরণ যা পরিবেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মাটি হচ্ছে কৃষির মূল ভিত্তি। উর্বর মাটি না হলে ভালো ফসল পাওয়া যায় না। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিকভাবেই মাটিতে জৈব পদার্থের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে দেশের মোট আবাদি জমির ৭৯ ভাগেই মারাত্মক জৈব ঘাটতি তৈরি হয়েছে। মাটিতেই পাঁচ শতাংশ জৈব উপাদান থাকার কথা থাকলেও তা এক শতাংশেরও নীচে নেমে গেছে। জমির উর্বরা শক্তি কমে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে- একই জমিতে বছরে একাধিক বার ফসল চাষ এবং মাত্রারিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার। এতে ভেঙ্গে পড়ছে মাটির স্বাস্থ্য। এ ধারা চলতে থাকলে আগামী ১০০ বছরের মধ্যে চাষযোগ্য কোনো জমি থাকবে না।
বিশ্ব ব্যাংকের কৃষি পরামর্শক কৃষিবিদ ডক্টর শহীদুল ইসলাম বলেন, সাধারণত ৪৫ শতাংশ খনিজ বা মাটির কণা, ৫ শতাংশ জৈব এবং ২৫ শতাংশ করে পানি ও বাতাস থাকা মাটিকে সুষম মাটি বলা হয়। একটি আদর্শ জমিতে জৈব পদার্থের মাত্রা ৩.৫ শতাংশ থাকা অতি প্রয়োজনীয় হলেও এ বাংলাদেশের বেশির ভাগ জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ এক দশমিক ১৭ শতাংশ এবং কিছু কিছু জমিতে এর পরিমাণ ১ শতাংশের চেয়েও কম। এর মধ্যে ৫৪ লাখ হেক্টর জমিতে ফসফরাস, ২৬ দশমিক ৩০ লাখ হেক্টর জমিতে পটাশিয়াম, ৩৩ দশমিক ৩০ লাখ আট হাজার হেক্টর জমিতে গন্ধক, ২৭ দশমিক ৭ লাখ হেক্টর জমিতে দস্তা সার, ২৩ দশমিক ৯ লাখ হেক্টর জমিতে বোরন সারের অভাব রয়েছে। এছাড়া অনেক জমিতে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের অভাব বাড়ছে।
মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) গবেষণা বলছে, এক দশকের ব্যবধানে দেশের আবাদি জমিতে গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ উলেস্নখযোগ্য হারে কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে ক্ষতিক্ষর নাইট্রোজেন ভূগর্ভস্থ হয়ে পানিতে মিশে যাচ্ছে, তা মানুষের স্বাস্থ্যের ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিশুদের মৃতু্যঝুঁকি বাড়ছে। আবার ফসফরাস বেশি দেয়া হচ্ছে, যা বৃষ্টির পানিতে বা বন্যায় খালের পানিতে মিশে যায়। ফলে প্রায়ই মাছ মারা যেতে দেখা যায়। বাড়ছে মাটির অম্স্নত্ব (এসিডিটি)। অনেক স্থানের মাটি হয়ে যাচ্ছে বন্ধ্যা (পতিত হচ্ছে জমি)। অথচ মানুষের মাথাপিছু ক্যালোরির এক বিরাট অংশ আসে মাটিতে উৎপাদিত বিভিন্ন প্রকারের শস্য থেকে। অনেক আমিষ জাতীয় খাবারের উৎস (গরু, ভেড়া, ছাগল, মাছ, সবজি) পরোক্ষভাবে মাটির ওপরই নিভর্রশীল। হিসাব করে দেখা গেছে, মাথাপিছু ক্যালোরির প্রায় ৯৫ শতাংশ প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে মাটি থেকে আসে।
মাটিতে উদ্ভিদের বেঁচে থাকা এবং জীবনচক্র সম্পূর্ণ করতে ১৭টি পুষ্টি উপাদান অবশ্যই প্রয়োজন। এসব পুষ্টি উপাদান হলো:কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, সালফার, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, জিংক, কপার, মলিবডেনাম, বোরন, ক্লোরিন ও কোবাল্ট। কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন আলোর উপস্থিতিতে গাছ বায়ু থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড সংগ্রহ করে পানির সাহায্যে খাদ্য তৈরি করে। বাকিগুলো শিকড়ের সাহায্যে মাটি থেকে গ্রহণ করে থাকে।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে সব ধরনের বিশেষ করে আবাদি, বনভূমি, নদী, লেক, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, সুন্দরবন ইত্যাদি এলাকা মিলিয়ে জমির পরিমাণ ১ কোটি ৪৭ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে ফসফরাস ঘাটতিযুক্ত এলাকার পরিমাণ ৬৬ লাখ হেক্টর, যা মোট জমির প্রায় ৪৫ শতাংশ। অন্যদিকে পটাশিয়ামের ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৫২ লাখ ৭০ হাজার বা ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশে। সালফারের ঘাটতি রয়েছে ৬৫ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর বা ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ এলাকায়। এর বাইরে বোরনের ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৫১ লাখ ১০ হাজার হেক্টরে মোট জমির ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ। জৈব পদাথের্র ঘাটতি রয়েছে ১ কোটি ১৬ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর যা মোট জমির প্রায় ৭৮ দশমিক ৯০ শতাংশে। এছাড়া অনেক জমিতে রয়েছে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়ামের অভাব।
সম্প্রতি প্রভাবশালী সাময়িকী ফোর্বস লিখেছে, পুষ্টিকর ফসল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন ভালো ও সুস্থ মাটি। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ৩৮ শতাংশ ভূপৃষ্ঠ কৃষিকাজের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসেবে মাটি নষ্ট হওয়াকে পরিবেশ ও কৃষির জন্য বড় ধরনের হুমকি বলে অভিহিত করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক হারুন আর রশিদ বলেন, মাত্রাতিরিক্ত সার ব্যবহারের কারণে মাটিতে উপকারী অণুজীব দ্রম্নত হ্রাস পাচ্ছে। অতিরিক্ত সার ব্যবহারের পরও কিছু গাছের বৃদ্ধি হচ্ছে না বলে জানান তিনি। সারা বছর ক্রমাগত কৃষি কাজের কারণে মাটি বিশ্রাম পাচ্ছে না। সেইঙ্গে উচ্চ ফলনশীল ফসল উৎপাদনের কারণে মাটির ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে। মাটির স্বাস্থ্যের ওপর নির্ভর করে আমাদের খাদ্য উৎপাদন।
বিশ্ববাংকের কৃষি বিষয়ক পরামর্শক কৃষিবিদ ডক্টর নজরুল ইসলাম বলেন, উর্বরা শক্তি ফিরিয়ে আনতে চাষে ভিন্নতা আনতে হবে। একবার ধান করলে পরের বছর ডাল জাতীয় ফসল করতে হবে। আবার দুই ফসল উৎপাদনের পর জমিকে বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। জৈব পদার্থের উৎস্য বাড়াতে হবে। মাটির প্রতি যত্নশীল না হলে আগামীর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। মাটির উর্বরতা ও উৎপাদনশীলতা বজায় রেখে অধিক ফসল উৎপাদন করতে হবে। মাটিতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার পরিহার না করে সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগের মাধ্যমে মাটির সুস্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষা করতে হবে। অধিক উৎপাদন পেতে হলে মাটির উবর্রা শক্তি বজায় রাখতে হবে। জৈব পদার্থ হচ্ছে মাটির প্রাণ। মানবদেহে রক্তের গুরুত্ব যেমন অপরিসীম, মাটিতে জৈব পদার্থের গুরুত্বই তেমন। তাই বিভিন্ন জৈব সার যেমন গোবর, খামারজাত সার, কম্পোস্ট, বসতবাড়ির আশপাশের পচা আবর্জনা সার, খৈল, সবুজ সার, ছাই, খড়-নাড়া, কচুরিপানা, পচাপাতা ইত্যাদি ব্যবহারের মাধ্যমে মাটিকে জৈব পদার্থে সমৃদ্ধ করে উর্বরাশক্তি বৃদ্ধি করতে হবে।