বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সব রাজনৈতিক দল ঐক্যমতে পৌঁছেছে। দেশের অস্তিত্ব, অপপ্রচার ও আগ্রাসন ঠেকাতে দলগুলো সরকারের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করারও প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছেন।
বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা ঐক্যবদ্ধভাবে এমন অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত দেশের অধিকাংশ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর যৌথ বৈঠকে দেশের ক্রান্তিকালে সব বিভেদ ভুলে এক সঙ্গে কাজ করতে একমত হয়েছেন।
পরে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অস্তিত্ব ও মর্যাদার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ থাকার ঘোষণা দিয়েছে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক আদর্শের ভিন্নতা ছিল। তবে সবাই দেশের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ থাকার কথা বলেছেন।
\হবৈঠকের শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছাত্র-জনতার অভু্যত্থানের পর 'মুক্ত স্বাধীন নতুন বাংলাদেশকে' মুছে দিতে 'কল্পকাহিনি' প্রচার করা হচ্ছে মন্তব্য করে রাজনৈতিক দলগুলোকে তা ঠেকাতে এক জোট হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলো তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে একসঙ্গে কাজ করবেন বলে জানান।
চরম রাজনৈতিক সংকটেও গত ১৬ বছরে ডান-বাম-ইসলামপন্থি সব রাজনৈতিক দলকে এক জায়গায় আনার এমন সফল উদ্যোগ দেখা যায়নি। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণে দলগুলো এক এক কাতারে এসেছেন। তবে এলডিপির প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) অলি আহমদ ও মহাসচিব
ড. রেদোয়ান আহমেদের নাম তালিকায় না থাকাতে তারা যমুনায় গিয়েও ফিরে আসেন।
ড. ইউনূসের আহ্বান : ছাত্র-জনতার অভু্যত্থানের পর 'মুক্ত স্বাধীন নতুন বাংলাদেশকে' মুছে দিতে 'কল্পকাহিনি' প্রচার করা হচ্ছে মন্তব্য করে রাজনৈতিক দলগুলোকে তা ঠেকাতে এক জোট হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
বিকালে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে দেশের চলমান পরিস্থিতিতে 'জাতীয় ঐক্য' প্রতিষ্ঠায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের সূচনা বক্তব্যে এ আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশের মুক্তি ও স্বাধীনতা অনেকের কাছে পছন্দ হচ্ছে না মন্তব্য করে প্রায় চার মাস ধরে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দেওয়া মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, নানাভাবে নানা গতিতে এটিকে উল্টে দেওয়ার চেষ্টা গত ৫ আগস্টের পর থেকে কত রকমভাবে যে এসেছে সেটা আপনারা আমার চেয়ে ভালো জানেন। 'অভু্যত্থান যাদের পছন্দ হয়নি তারা' এটা মুছে দিতে চায়।
তিনি রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশে বলেন, 'তারা নতুন নতুন বেশে নতুনভাবে চেষ্টা করেই যাচ্ছে। এখন যে চেষ্টা চলছে সেটার বিশেষ একটা রূপ আছে। সেজন্য বিশেষভাবে আপনাদের ডাকা।'
সংলাপে অংশ নেওয়া বিএনপির প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তার সঙ্গে রয়েছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন।
জামায়াতের পক্ষে দলের আমির শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে রয়েছেন নায়েবে আমির মজিবুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম।
এছাড়া নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশের বিপস্নবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (বাংলাদেশ জাসদ), ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (এনডিএম), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি), গণঅধিকার পরিষদ (জিওপি) নেতারাও সংলাপে ছিলেন।
সংলাপের সূচনা বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা যে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে সেটি ধামাচাপা দিয়ে আরেক বাংলাদেশের কাহিনী রচনার অপচেষ্টা চালানোর কথা তুলে ধরে বলেন, 'এটা যে শুধু এক দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে তাও নয়। বিশেষ বিশেষ বড় বড় দেশের মধ্যে এটা ছড়িয়ে গেছে। আমাদের বিরাট অভু্যত্থানটা তাদের পছন্দ হয়নি, তারা এটা মুছে দিতে চায়, আড়াল করতে চায়। এটাকে নতুন ভঙ্গিতে দুনিয়ার সামনে পেশ করতে চায় যেন- আমাদের এখানে ভয়ঙ্কর ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে সেখান থেকে আমাদের রক্ষা করতে হবে।'
\হবৈঠকের শুরুতে রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশে ইউনূস বলেন, 'সেটা মিথ্যা প্রমাণ করা, বাস্তবকে সেখানে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমাদের সবার এক জোট হতে হবে। এটা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদের কিছু না, জাতি হিসাবে আমাদের অস্তিত্বের বিষয়। নানা দিক থেকে তারা একটা কাল্পনিক বাংলাদেশ তৈরি করেছে দুনিয়ার সামনে, তাদের শক্তি এত বেশি। ক্রমে ক্রমে তারা মানুষকে এটাতে ভেড়াতে পারছে, এই যে নতুন কল্পকাহিনী তারা তৈরি করছে। তা নিয়ে অনেকে সন্দেহও প্রকাশ করেছে- এখানে কি ধরনের সরকার হয়েছে। তাদের কী আমরা বাধা দিয়েছি আসতে? আমরা তাদের বলেছি, আসেন দেখে যান। এখানে কোনো বাধা নাই। কিন্তু তারা ওখান থেকে কল্পকাহিনী বানিয়ে যাচ্ছেন।'
অপপ্রচার ঠেকাতে সবাইকে একজোট হওয়ার পরামর্শ দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, 'এখন আমাদের সারা দুনিয়াকে বলতে হবে আমরা এক। আমরা যে পেয়েছি তা এক যোগে পেয়েছি। কোনো মতভেদের মধ্যে পাইনি। কাউকে ধাক্কাধাক্কি করে পাইনি। যারা আমাদের বুকের ওপর চেপেছিল তাদেরকে আমরা বের করে দিয়েছি। আমরা নিজেরাই উন্মুক্ত হয়েছি। সে জিনিসটা সবার সামনে তুলে ধরা। কীভাবে তুলবো এ ব্যাপারে পরামর্শ সবাই মিলে যেন আমরা এটা করতে পারি। কারণ নতুন বাংলাদেশের যাত্রা পথে এটা একটা মস্তবড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, অস্তিত্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ জিনিস আমাদের মনের ভেতর যেটা আছে সেটা সবার সামনে একত্রিত হয়ে বললে আমাদের শক্তি সমবেত শক্তি হিসাবে আসবে।'
দলগুলোতে ঐকমত্য
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, 'জুলাই-আগস্টে গণঅভু্যত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিদায় করা হয়েছে। আমাদের দেশের বিরুদ্ধে পতিত সরকার বিদেশ থেকে যে ষড়যন্ত্র করছে সেই ফ্যাসিস্ট, পতিত সরকারের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা ও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সব দল ঐকমত্য পোষণ করেছেন।' তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রও দেশের ছাত্র-জনতা সবাই মিলে আমরা মোকাবিলা করব।'
নির্বাচনী রোডম্যাপ প্রকাশ হয়ে গেলে আর ষড়যন্ত্র করার সাহস কেউ পাবে না বলে মনে করেন বিএনপি নেতা।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান যে পরিস্থিতি, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশের ইসু্য তৈরির বিষয়ে বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আমাদের সহযোগিতা চাওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।
বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার জন্য অপচেষ্টা চলছে উলেস্নখ করে ড. মোশাররফ বলেন, 'এই সরকার ওয়াদাবদ্ধ জনগণের অধিকারকে ফিরিয়ে দেওয়ার। তাই আমরা বলেছি অতি দ্রম্নত সংস্কার সাধন করে নির্বাচনের জন্য একটা রোডম্যাপ দেওয়া, যাতে করে জনগণ রোডম্যাপ পেয়ে নির্বাচনমুখী হয়ে গেলে যে সব ষড়যন্ত্র এখন আপনারা দেখতে পাচ্ছেন সে সব ষড়যন্ত্র আর কেউ করার সাহস পাবে না।'
\হবৈঠকের পর জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, 'আমরা কারও পাতা ফাঁদে পা দেব না। কারও কাছে মাথা নত করব না, আবার সীমা লঙ্ঘনও করব না। দুই-একদিনের মধ্যে সুখবর পাবেন আশা করি।'
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, 'দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনো ছাড় নয়। সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে আমরা ঐক্যবদ্ধ। সরকার যাতে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেয়, সেটার জন্য আমরা সহযোগিতা করব।'
জামায়াত আমির বলেন, 'জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে বিজয় এসেছে, চলমান ষড়যন্ত্রও আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করব। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে অপপ্রচারের বিরুদ্ধে লড়তে হবে।'
শফিকুর রহমান বলেন, 'অপপ্রচার মোকাবিলায় আমরা সরকারের সঙ্গে কাজ করব।'
এবি পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সব রাজনৈতিক দল ঐকমত্য।
\হবৈঠকের পর বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন, তারা পতিত সরকারের নিয়োগ প্রাপ্ত, তাদেরকে সরিয়ে বিপস্নবের পক্ষের শক্তিকে নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি প্রস্তাব এসেছে। সংখ্যালঘুর ব্যাপারে একটি জাতীয় কমিশনের গঠনের প্রস্তাব এসেছে। অপপ্রচার প্রতিরোধের রাষ্ট্রীয়ভাবে পাবলিক রিলেশন সেল করার কথা এসেছে। যেখানে বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে প্রকাশ করবে।
সর্বদলীয় সভায় এবি পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু ১ দিন জাতীয় ঐক্যের প্রতীকী সংহতি হিসেবে সর্বস্তরের নাগরিকদের সারাদেশে একযোগে একই সময়ে যার যার অবস্থানে জাতীয় পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদী কর্মসূচির প্রস্তাব দেন। তার এই প্রস্তাবকে অধিকাংশ দলের নেতারা সমর্থন জানান।
বিপস্নবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক দেশের স্বার্থে সবাই ঐকমত্য হয়েছেন বলে জানান।