ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ
ত্রিপুরায় বাংলাদেশের ভিসা ও কনসু্যলার সেবা বন্ধ ঘোষণা . আগরতলায় হাসপাতালের পর বাংলাদেশিদের জন্য হোটেল-রেস্তোরাঁর দরজা বন্ধ
প্রকাশ | ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করে আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা, ভাঙচুর ও পতাকা পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে ঢাকা।
এদিকে ত্রিপুরায় বাংলাদেশের ভিসা ও কনসু্যলার সেবা স্থগিত করেছে ঢাকা। অন্যদিকে আগরতলায় বাংলাদেশিদের জন্য হাসপাতালের পর হোটেল-রেস্তোরার দরজাও বন্ধ করে দিয়েছে সেদেশের ব্যবসায়ীরা।
ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করা হলে মঙ্গলবার বিকাল পৌনে ৪টার দিকে প্রণয় ভার্মা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যান।
ভারতের আগরতলায় সোমবার বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন প্রাঙ্গণে ঢুকে হামলা চালায় দেশটির কট্টর হিন্দুত্ববাদী কয়েকটি সংগঠন। তারা বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা চালায়। এ ছাড়া মুম্বাইয়ের বাংলাদেশ উপহাইকমিশনের সামনে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) আয়োজনে বিক্ষোভ হয়।
আগরতলার হামলার বিষয়টি পূর্বপরিকল্পিত উলেস্নখ
করে নিন্দা ও কড়া প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, হামলার ঘটনা বাংলাদেশ সরকারকে গভীরভাবে ক্ষুব্ধ করেছে। ঘটনাপ্রবাহ দেখে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে হামলাটি পূর্বপরিকল্পিত। এ ঘটনা কূটনৈতিক সম্পর্কবিষয়ক ভিয়েনা সনদের লঙ্ঘন।
ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনকে নিরাপত্তা দিতে ভারত সরকার ব্যর্থ হয়েছে বলে মন্তব্য করেন অন্তর্র্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। তিনি ভারত সরকারের এই ব্যর্থতার নিন্দা জানান। একইসঙ্গে তিনি বলেছেন, ভারতকে বুঝতে হবে, এটা শেখ হাসিনার বাংলাদেশ নয়।
আমাদের সম্পর্ক বহুমুখী :প্রণয় ভার্মা
এদিকে, ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক বহুমুখী, এখানে কথা বলার অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। এই সম্পর্ককে শুধু একটি মাত্র বিষয়ে সীমাবদ্ধ করা যায় না। এসব কথা বলেছেন ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা। মঙ্গলবার বিকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তলবে হাজির হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।
ঢাকার সেগুনবাগিচায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে হাজির হয়ে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব এম রিয়াজ হামিদুলস্নাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমাদের সম্পর্ক বহুমুখী এবং আমরা অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। একে আমরা শুধু একটিমাত্র বিষয়ে সীমাবদ্ধ করতে পারি না।'
ভারতের হাইকমিশনার বলেন, 'আমরা সত্যিকার অর্থে একটি গঠনমূলক ও স্থিতিশীল সম্পর্ক চাই। এখানে অনেক বিষয় রয়েছে। অনেক বিষয়ে একে অপরের ওপর নির্ভরশীলতা রয়েছে। পরস্পরের ওপর এই নির্ভরশীলতাকে আমরা উভয়ের স্বার্থে কাজে লাগাতে চাই। আমরা আমাদের সহযোগিতা অব্যাহত রাখব, যাতে আমাদের দুই দেশই উপকৃত হয়। এখানে অনেক ইতিবাচক অগ্রগতিও রয়েছে।'
আগরতলায় কনসু্যলার
সেবা বন্ধ
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলার পর সেখানে কনসু্যলার সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তী সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, নিরাপত্তার কারণে আপাতত আগরতলার বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে কনসু্যলার সেবা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ফলে ওই মিশন থেকে বাংলাদেশের ভিসা সেবা বন্ধ থাকবে।
এ ছাড়া উগ্রপন্থীদের বিক্ষোভে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে আগরতলাসহ ভারতে বাংলাদেশের সব মিশনের নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য আগেই দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নোট পাঠানো হয়েছে। সোমবার সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কঠোর প্রতিবাদের সঙ্গে ওই নোট পাঠানো হয় বলে নিশ্চিত করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
আগরতলা মিশনে হামলার ঘটনায় তাৎক্ষণিক দুঃখ প্রকাশ করেছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেই সঙ্গে ঘটনায় জড়িত সাতজনকে আটক এবং নির্লিপ্ততার জন্য পুলিশের চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে। স্মরণ করা যায়, বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় ওই ক্ষোভ-বিক্ষোভের জন্ম। এটাকে সংখ্যালঘু নির্যাতন হিসেবে দেখা হচ্ছে। প্রতিবাদ জানাতে বাংলাদেশের সুতারকান্দি স্থলসীমান্ত দিয়ে উগ্র প্রতিবাদকারীরা বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশের চেষ্টা করার মধ্যেই আগরতলায় হামলার ঘটনা ঘটে।
ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাসে নিরাপত্তা জোরদার
ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাসের প্রবেশ মুখে আগলে রয়েছে সেনাবাহিনীর দুটি সাঁজোয়া যান। তার সামনে রয়েছেন একদল পুলিশ সদস্য। আর প্রবেশপথে ব্যারিকেড দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা।
আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাই কমিশনে হামলার পর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভারতীয় হাই কমিশন ও সহকারী হাই কমিশনগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করার পর মঙ্গলবার এ চিত্র দেখা যায়।
এদিন দুপরে আগরতলার ঘটনার প্রতিবাদে ভারতীয় দূতাবাস ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল একটি সংগঠন। তবে বিকাল পৌনে ৫টা পর্যন্ত দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভকারীদের কেউ যায়নি। তবে ৫টা ১০ মিনিটে এক ব্যক্তি প্রতিবাদ জানাতে যান।
তার ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি হিন্দু থেকে মুসলিম হয়েছেন। তার বাড়ি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া। আগে তার নাম ছিল ননী গোপাল পোদ্দার, এখন তার নাম খান মোহাম্মদ আবু বক্কর সিদ্দিক।
মিনিট দশেক পরে তাকে সরিয়ে দেয় পুলিশ।
দূতাবাসে যাওয়ার রাস্তা ও এর আশপাশে লেকের পাড়ে বিপুল সংখ্যক সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যেদের অবস্থান দেখা গেছে। তাদের সঙ্গে রয়েছে সাঁজোয়া যানসহ (এপিসি) দাঙ্গা দমনের উপকরণ।
সেখানে কর্তব্যরত পুলিশের ডিপেস্নাম্যাটিক সিকিউরিটি বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, তাদের সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকতে বলা হয়েছে। এরপর বদলি ডিউটি আসবে। তাদের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা নিবিড় পর্যবেক্ষণ করছেন।
তিনি বলেন, 'কোনো কিছু ঘটামাত্র যেন আরো ফোর্স পাওয়া যায়, সেই ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।'
চট্টগ্রামে ভারতীয় হাইকমিশনে নিরাপত্তা জোরদার
চট্টগ্রাম বু্যরো জানায়, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলার ঘটনার পর চট্টগ্রাম নগরে ভারতীয় সহকারী হাইকমিশন ও ভারতীয় ভিসা সেন্টারে নিরাপত্তা জোরদার করতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। একইসঙ্গে সহকারী হাইকমিশন ও ভিসা সেন্টারের আশপাশের এলাকায় নজরদারির বৃদ্ধি করেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি)।
মঙ্গলবার দিনভর সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন ছিল। দুপুরে নগরের খুলশী থানার জাকির হোসেন রোডে ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনের সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন থাকতে দেখা যায়। এ সময় সতর্ক অবস্থায় ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এছাড়া নগরের পূর্ব নাসিরাবাদে সিডিএ অ্যাভিনিউয়ের সিটি সেন্টারে ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্রের সামনেও মোতায়েন ছিল অতিরিক্ত পুলিশ। পাশাপাশি এপিবিএনের সদস্যরাও দায়িত্বরত ছিল।
খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, ভারতীয় সহকারী হাইকমিশন ও ভিসা সেন্টার কেন্দ্রিক স্বাভাবিকের তুলনায় সোমবার বিকালে থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে। সহকারী হাইকমিশনার ও ভিসা সেন্টারের সামনে ও এর আশপাশ এলাকায় বাড়তি পুলিশ সদস্য মোতায়ন করা হয়েছে।
আগরতলার সড়কে
বাঁশের বেড়া
স্টাফ রিপোর্টার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরের ওপারে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যেও আগরতলা ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্টের সামনের সড়কে আড়াআড়িভাবে বাঁশের বেড়া দেওয়া হয়েছে। এতে যাত্রী চলাচলে ব্যাঘাত ঘটছে।
মঙ্গলবার সকালে ভারত থেকে আসা একাধিক যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে কি কারণে এ বেড়া দেওয়া হয়েছে সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এর আগে সোমবার কিছু ভারতীয় স্থলবন্দর এলাকায় এসে বিক্ষোভ দেখায়। মঙ্গলবারও তাদের আসার কথা ছিল।
মঙ্গলবার সকাল থেকে এ বন্দর দিয়ে আগরতলায় মাছ রপ্তানি করা হয়। বাংলাদেশের পরিবহণ সেখানকার বন্দর এলাকায় গিয়ে মাছ রেখে আসে। ভারতীয় পরিবহণে এসব মাছ বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়ার কথা। এ ক্ষেত্রে বাঁশের বেড়া অতিক্রম করে কিভাবে মাছ নিয়ে যাওয়া হয় এ নিয়ে চলছে আলোচনা।
একটি সূত্র জানায়, ওপারে বন্দর ও এর আশপাশে অতিরিক্ত বিএসএফ মোতায়েন রয়েছে। এ অবস্থায় বেলা ১১টা থেকে এপারে বিজিবিকেও সতর্কতা অবলম্বন করতে দেখা যায়। এসবের মধ্যেই যাত্রীরা আসছেন।
ভারত থেকে আসা কুমিলস্নার কোম্পানিগঞ্জের উজ্জ্বল দেবনাথ জানান, বন্দরে ঢুকার পথেই সড়কে বাঁশের বেড়া দেওয়া। এটি পার হয়ে আসতে খুব কষ্ট হয়। তবে আসতে কেউ বাঁধা দেননি।
এদিকে মাছ আমদানিতে আগ্রহ থাকলেও ওপারে বাংলাদেশিদের জন্য হোটেল পরিসেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সোমবার ত্রিপুরার হোটেল মালিকদের এক সভা থেকে এ সিদ্ধান্ত নিয়ে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এর আগে আইএলএস নামে একটি হাসপাতাল বাংলাদেশিদেরকে চিকিৎসা সেবা দেবে না বলে ঘোষণা দেয়।
ইসকন নেতা চিন্ময় দাস গ্রেপ্তার ইসু্যতে দু'দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি চলছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তুলে ভারতের ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়মিত বিক্ষোভ হচ্ছে। সেদেশে বাংলাদেশি পতাকা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সর্বশেষ সোমবার ত্রিপুরাস্থ বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনারের আগরতলার কার্যালয়ে হানলা-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ভারতের পক্ষ থেকে অবশ্য দুঃখ প্রকাশ করা হয়।
সীমান্তে প্রস্তুত বিজিবি
দেশের সীমান্তে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি বা অপতৎপরতা রোধে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সম্পূর্ণ প্রস্তুত ও সতর্ক রয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে বিজিবির সদর দপ্তর থেকে এ তথ্য জানানো হয়।
বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানান, দেশের সীমান্তে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি কিংবা অপতৎপরতা রোধে বিজিবি সম্পূর্ণ প্রস্তুত ও সতর্ক রয়েছে।