বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির পর্যবেক্ষণ

আ'লীগ শাসনামলে উন্নয়ন বাজেটের ৪০% লুটপাট

'দেশের ৮৫ শতাংশ সম্পদ ভোগ করছে ১০% মানুষ' 'চামচা পুঁজিবাদ থেকে চোরতন্ত্রে পরিণত হয়েছিল দেশ'
যাযাদি ডেস্ক
  ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
আ'লীগ শাসনামলে উন্নয়ন বাজেটের ৪০% লুটপাট
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে সোমবার শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য -সংগৃহীত

আওয়ামী লীগ সরকারের টানা দেড় দশকের শাসনামলে উন্নয়ন বাজেটের ৪০ শতাংশ অর্থই 'তছরুপ' বা 'লুটপাট' হয়েছে। এ অর্থ থেকে প্রতি বছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার বা এক লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা বিদেশে 'পাচার' হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে ওই সময়কালে উন্নয়নকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে অন্তত ২৮ রকম উপায়ে দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে।

দেশের অর্থনীতির হালচাল জানার জন্য গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির পর্যবেক্ষণে এসব তথ্য উঠে এসেছে। রোববার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রায় ৪০০ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্র তুলে দেন কমিটির প্রধান অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সোমবার সেই প্রতিবেদনের বিষয়ে জানাতে রাজধানীর শেরেবাংলানগরের জাতীয় অর্থনৈতিক কমিটির (এনইসি) সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে আসেন কমিটির সদস্যরা।

কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে 'অতিরঞ্জিত তথ্যের ভিত্তিতে একটা উন্নয়ন আখ্যান' তৈরি করা হয়েছে যার আড়ালে দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও স্বল্পসংখ্যক মানুষের হাতে অধিক পরিমাণ সম্পদ কুক্ষিগত হয়েছে।

শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, 'সব মিলিয়ে এখন দেশের ১০ শতাংশ মানুষ ৮৫ শতাংশ সম্পদ ভোগ করছে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে প্রতিটি খাতে লুটপাট ও দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে। আমাদের কাজ চোর ধরা নয়, আমরা চুরির বর্ণনা দিয়েছি।'

'বাংলাদেশের অর্থনীতির শ্বেতপত্র: একটি উন্নয়ন আখ্যানের ব্যবচ্ছেদ' শিরোনামের খসড়া শ্বেতপত্রটি অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়ার পর তা শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির ফেসবুকে প্রকাশ করা হয়।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচু্যত হলে দায়িত্বে আসা অন্তর্র্বর্তী সরকার দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে এ কমিটি গঠন করে। অর্থনীতিবিদ

দেবপ্রিয়ের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ২৮ আগস্ট কমিটি হওয়ার পরপরই কাজে নেমে পড়ে কমিটি।

এই সময়ের মধ্যে ১৮টি বৈঠক, ২১টি পলিসি কনসালটেশন, ১৫টি কারিগরি কমিটির বৈঠক এবং তিনটি গণশুনানির আয়োজন করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এসব কাজ করার জন্য অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয়র নেতৃত্বে গঠিত কমিটি কোনো ভাতা নেয়নি, এমনকি বৈঠক বাবদ সম্মানীও কমিটির সদস্যরা নেননি। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নির্দেশনার আলোকে কমিটির সদস্যদের নিজেই নির্বাচিত করেছেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

কমিটি মনে করছে, প্রচলিত বাজার অনুযায়ী এই ধরনের একটি গবেষণাকাজের জন্য ২৫ কোটি টাকা খরচ হতে পারত।

প্রথাগত গবেষণা পদ্ধতির বাইরে গিয়ে এই গবেষণা করা হয়েছে। গবেষকরা নিজস্ব অর্জিত জ্ঞান এখানে ব্যবহার করেছেন। পাশাপাশি দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করা হয়েছে।

দেবপ্রিয় বলেন, 'চামচা পুঁজিবাদ থেকে চোরতন্ত্রে পরিণত হয়েছিল পুরো কাঠামো। এর উৎস ২০১৮ সালের নির্বাচন। পরবর্তী সময়ে যে ভোট হয়েছে সেখানে স্বচ্ছতার জায়গা নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকারের জবাবদিহিতা নষ্ট করা হয়েছে। জাতিসংঘ এখনো মনে করছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে কোনো বাধা নেই।'

শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান বলেন, 'গত ১৫ বছরে দুর্নীতি বা অনিয়ম যাই বলেন এর পেছনে রয়েছে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং উর্দিপরা ও উর্দিছাড়া আমলাগোষ্ঠী। বিগত তিনটি নির্বাচন এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। স্থানীয় সরকার ও সামাজিক শক্তি দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে। নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম এমনকি বিদেশিরাও এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। বিদেশিরা অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় প্রশংসা করে সরকারকে সুরক্ষা দিয়েছে।'

তিনি বলেন, 'এখন সংস্কার কাজের জন্য দেশে অর্থনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলার স্থিতিশীলতা দরকার। সরকার গত তিন মাসে অর্থনীতি ঠিক করার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তার একটি বিস্তারিত বিবরণ জনসম্মুখে দিতে হবে। আগামী ছয় মাসে যেসব পদক্ষেপ সরকার নেবে বলে মনে করছে তারও একটা পরিকল্পনা হাজির করতে হবে। আগামী ছয় মাসে মূল্যস্ফীতি, মুদ্রার মান, সুদহার কোনটা কোথায় থাকবে তার একটা ধারণা সরকারকে দিতে হবে।'

দেবপ্রিয় বলেন, 'বর্তমান সরকার সীমিতকালীন সরকার হলেও এর সিদ্ধান্তগুলোর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান, শিক্ষার মান, স্বাস্থ্যসেবা এসব খাতে একটি মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা এ সরকারকে দিতে হবে। সেটা দুই বছর মেয়াদি পরিকল্পনা হলেও হতে পারে।'

সংবাদ সম্মেলনে কমিটির সদস্য ড. এ কে এনামুল হক বলেন, 'দেশের উন্নয়ন প্রকল্পে মোট ব্যয়ের ৪০ শতাংশ ব্যয় তছরুপ বা লুটপাট করা হয়েছে। এটা এককভাবে ঘটেনি। সব পক্ষ মিলে ধাপে ধাপে কাজটি করেছে।'

ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'অনেক মেগা প্রকল্পই হয়তো প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ঠিকাদারের কথা অনুযায়ী কয়েকগুণ ব্যয় বাড়িয়ে সেই টাকা পাচার করা হয়েছে। অর্থ পাচারের হিসাব বের করা বেশ কঠিন। তবে আমি একটি আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অবলম্বন করে পাচারের হিসাবটা এনেছি।'

ড. ইমরান মতিন বলেন, 'দরিদ্রের যে উন্নতির কথা বলা হয়েছে, সেটা অর্থবহ নয়। কারণ যারা দারিদ্র্যসীমার উপরে আছে, তারা যদি দুই দিন কাজ করতে না পারে, দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। টোকা দিলেই পড়ে যাবে এই ধরনের একটা ন্যারেটিভ দাঁড় করানো হয়েছে।'

অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, 'দ্রম্নত বিদু্যৎ সরবরাহ আইন দুর্নীতির রাজপথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। সংকট মোকাবিলার জন্য প্রথমে বলা হলেও পরে ব্যাপকভাবে এর ব্যবহার হয়েছে। নিজস্ব জ্বালানি উৎপাদনের প্রচেষ্টা বাদ দিয়ে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির চেষ্টা করা হয়েছে। অর্থাৎ নীতি প্রণয়ন করে দুর্নীতি করা হয়েছে।'

অন্যদের মধ্যে কমিটির সদস্য অধ্যাপক সেলিম রায়হান, অধ্যাপক আবু ইউসুফ, তাসনীম সিদ্দিকী ও অধ্যাপক শারমিন্দ নীলর্মিও সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন।

দুর্নীতি হয়েছে ২৮ উপায়ে

সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যে উন্নয়নের বয়ান দেওয়া হয়েছিল তা কেবল দেশে নয়, বিদেশেও প্রশংসা কুড়িয়েছে। তবে বাংলাদশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র কমিটি মনে করে, শেখ হাসিনার সরকার হরেক রকম পদ্ধতিতে দুর্নীতি করে দেশ থেকে অর্থ পাচার করেছে। উন্নয়নের ওই বয়ানকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে অন্তত ২৮ রকম উপায়ে দুর্নীতি সংঘটনের তথ্য খুঁজে পেয়েছে কমিটি।

শ্বেতপত্র কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেড় দশক ধরে দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। প্রতি বছর পাচার করা অর্থের পরিমাণ ছিল গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার।

যেসব পদ্ধতিতে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ শাসনামলে দুর্নীতি হয়েছে তার একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে শ্বেতপত্র কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে। এ পদ্ধতিগুলো হলো-

১. ব্যাংক খাতের ঋণ কেলেঙ্কারি ২. ব্যাংক অধিগ্রহণ ৩. অবৈধভাবে অর্থ পাচার ৪. রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেওয়া অলাভজনক প্রকল্প ৫. প্রকল্পের খরচ বৃদ্ধি ৬. প্রকল্প অনুমোদনের পর ব্যয় বৃদ্ধি ৭. প্রতিযোগিতাবিহীন দরপত্র প্রক্রিয়া ৮. অপ্রয়োজনীয় ও দুর্বল প্রকল্প ৯. নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি ১০. ভূমি ও সম্পদের অবৈধ অধিগ্রহণ ১১. ভূমি অধিগ্রহণের অর্থের অপব্যবহার ১২. চুক্তিমূল্য বাড়িয়ে কাজ দেওয়া ১৩. প্রকল্পের সম্পদের অপব্যবহার ১৫. রাষ্ট্রীয় তহবিলের ভুল বরাদ্দ ১৬. অভিজাতদের কর অব্যাহতি ১৭. সরবরাহ চেইনের বিকৃতি ১৮. ইনসাইডার ইনফরমেশন বা ভেতরের তথ্য আদান-প্রদান ১৯. সংঘবদ্ধ দুর্নীতি ২০. চাঁদাবাজিভিত্তিক দুর্নীতি ২১. একচেটিয়া ব্যবস্থার মাধ্যমে দুর্নীতি ২২. আগেই তথ্য লেনদেনের মাধ্যমে দুর্নীতি ২৩. তথ্য গোপন করার মাধ্যমে দুর্নীতি ২৪. নিষ্ক্রিয়তার মাধ্যমে দুর্নীতি ২৫. কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতির জন্য দুর্নীতি ২৬. কমিশনের ভাগবাঁটোয়ারা ২৭. রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়া ২৮. আইন প্রণয়ন।

শ্বেতপত্র কমিটির সদস্যরা দেখতে পেয়েছেন যে দুর্নীতির কারণে সবচেয়ে বেশি লুটপাটের শিকার হয়েছে ব্যাংক খাত। এরপর রয়েছে ভৌত অবকাঠামো খাত এবং জ্বালানি ও বিদু্যৎ। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) হলো আরেকটি খাত যা দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে