বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘ ১৭ বছর নির্বাসিত থাকার পর দেশে ফেরার পরিকল্পনা করছেন- এমন খবর রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। রোববার একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বেকসুর খালাস পাওয়ার পর এনিয়ে সর্বস্তরে জল্পনা-কল্পনার শাখা প্রশাখা আরও বিস্তীত হয়েছে। দলটির নেতাকর্মীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে 'লিডার আসছেন' এ ধরনের প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তারেক রহমানের দেশে ফেরার প্রক্রিয়া এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। দলটির শীর্ষ নেতারাও বলছেন, তারেক রহমান শিগগিরই দেশে ফিরবেন। আসলে তিনি ঠিক কবে ফিরবেন, সে ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত কোনো দিনক্ষণ পাওয়া যায়নি।
তারেক রহমানের বিরুদ্ধে যে পাঁচটি মামলায় সাজা হয়, তার মধ্যে একটিতে তিনি খালাস পেয়েছেন। বাকি চারটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। দ্রম্নততম সময়ে এসব মামলায় খালাস পেলে আগামী জানুয়ারি-ফেব্রম্নয়ারি নাগাদ তিনি দেশে ফিরতে পারেন বলে বিএনপিতে আলোচনা রয়েছে। তবে তার দেশে ফেরার ইসু্যটি আইনি প্রক্রিয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক বিষয় বলেও দলটির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে।
তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ, মানহানি, নাশকতা, গ্রেনেড হামলা ও দুর্নীতির অভিযোগে ঢাকাসহ দেশব্যাপী ৮০/৮২টির মতো মামলা দায়ের করা হয়েছিল। ওয়ান-ইলেভেনের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এসব মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ১৭টি মামলা হয়। তারেক রহমানের মামলাগুলোর মধ্যে ৬২টির মতো মানহানির মামলা বলে জানান তার আইনজীবীরা।
বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ও তারেক রহমানের আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল জানান, 'বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সব মিলিয়ে ৮০ থেকে ৮২টি মামলা করা হয়েছিল। ৫টি মামলায় তার দন্ড হয়েছে। এর মধ্যে একটিতে খালাস পেয়েছেন। বাকি চারটি আদালতে বিচারাধীন আছে, এখন পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়নি।'
তিনি জানান, 'গত ৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত তারেক রহমান মোট ৩৯টি মামলা বাতিল বা খারিজ কিংবা খালাস পেয়েছেন। এর মধ্যে একটি মামলায় তিনি খালাস পেয়েছেন। আর বাকি ৩৮টির মধ্যে কোনো কোনো মামলা বাতিল হয়েছে, আবার কোনোটি খারিজ হয়েছে।
কায়সার কামাল আরও জানান, 'হাইকোর্টে ৯টি মামলা আইনগতভাবে বাতিল হয়েছে এবং একটি মামলায় (একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা) তারেক রহমান বেকসুর খালাস পান।' বাকিগুলো সংশ্লিষ্ট আদালত (জজ এবং ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট) কর্তৃক বাতিল বা খারিজ হয়েছে। এখন পর্যন্ত তারেক রহমানের কোনো মামলা প্রত্যাহার হয়নি বলে জানান তার এই আইনজীবী।
এক প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, 'তারেক রহমান দেশের প্রচলিত আইন ও আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং সংবিধানের প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল। তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত প্রত্যেকটি মামলা ভিত্তিহীন। তারপরও তিনি আদালতের মাধ্যমে মামলাগুলোর নিষ্পত্তি চান।'
সেনাসমর্থিত ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের সময় ২০০৭ সালের ৭ মার্চ তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরের বছর ৩ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্তি পেয়ে ১১ সেপ্টেম্বর চিকিৎসার জন্য সপরিবারে যুক্তরাজ্য যান। তখন থেকেই তিনি লন্ডনে রয়েছেন। লন্ডনে থাকাকালে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রম্নয়ারিতে তার মা বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে যাওয়ার পর দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন 'সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান' তারেক রহমান। সেখানে থেকেই তিনি দল পরিচালনা করছেন।
বিএনপি নেতারা বলছেন, 'তারেক রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনেই ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের পতন ত্বরান্বিত হয়। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তার দেশে ফেরা খুবই কাঙ্ক্ষিত এবং নেতাকর্মীরা সেদিকেই চেয়ে আছেন।'
জানা গেছে, তারেক রহমানের মামলাগুলো বর্তমানে আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তিনি খালাস পাচ্ছেন। বাকি মামলাগুলো যাতে দ্রম্নত নিষ্পত্তি হয়, সে ব্যাপারে আইনজীবীরা তৎপর রয়েছেন।
বিএনপির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, তারেক রহমান দীর্ঘ সময় ধরে দেশের বাইরে আছেন। এ ক্ষেত্রে তার দেশে ফেরার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান কী, দলের পক্ষ থেকে সেটা জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত প্রভাবশালী দেশগুলোর মনোভাবও জানার চেষ্টা করবে বিএনপি।
দলটি আশা করছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারেক রহমানের দেশে ফেরার ক্ষেত্রে কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনের ক্ষেত্রে তার নেতৃত্ব ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনিই আগামীতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক। বিএনপির দাবি, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ক্ষমতাচু্যত ফ্যাসিবাদী সরকার যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে নানা ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করেছিল, সেটি এখন বিশ্বজুড়ে স্পষ্ট হয়ে গেছে। ফলে তার দেশে ফেরার ক্ষেত্রে আইনি বা রাজনৈতিক বিষয় কোনো ইসু্য হবে না।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান খুব তাড়াতাড়ি দেশে ফিরবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। তিনি বলেন, 'আমি বলব যে, তারেক রহমান আমাদের মধ্যে সহি-সালামতে ফিরে আসবেন খুব তাড়াতাড়ি। এজন্য আলস্নাহ তাআলা তাকে সুস্থ করেছেন, সুস্থ রেখেছেন ও খালাস দিয়েছেন।'
গণতন্ত্রের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে আমরা প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ :তারেক রহমান এদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, 'আমরা গণতন্ত্রের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ সেই গণতন্ত্র যা বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস, আস্থা ও আদর্শকে ধারণ করে।' রোববার এক্সে (সাবেক টুইটার) এক পোস্টে তিনি এসব কথা বলেন।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, 'নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশিরা তাদের নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারেন। এই যাত্রায় আমরা আইনের শাসন, মানবাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে চাই। প্রতিটি নাগরিকের অধিকার ও স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত রাখতে চাই। গড়তে চাই অংশগ্রহণমূলক, সহনশীল এবং আইনের ওপর ভিত্তি করে একটি সমাজ।'
তারেক রহমান বলেন, 'সত্যের সৌন্দর্য হলো- অপপ্রচার এবং ষড়যন্ত্রের উপর তা অনিবার্যভাবে জয়লাভ করে। তা আমাদেরকে এই বিশ্বাস দেয় যে, অবশেষে ন্যায়বিচার ও ন্যায্যতা বিজয়ী হয়। আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অবসান ঘটাতে এবং ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করি- যেখানে রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে কারো জীবন ও কোনো পরিবার ধ্বংস হবে না।'