দেশের চলমান পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করতে ঐকমত্য হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও বিএনপির মধ্যে। বুধবার রাতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে তাদের মধ্যে এই ঐকমত্য হয়েছে। বৈঠক শেষে দুই পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানানো হয়।
সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে দেশের স্থিতিশীলতার স্বার্থে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টা সবাইকে শান্তির বার্তা দিয়ে শান্ত থাকার কথা বলেছেন।
বৈঠকে বিএনপি গত কয়েকদিনের সংগঠিত ঘটনাবলীতে উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে। দলটি মনে করে, এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্টকারীদের প্রতিহত করতে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত রাতে এক বিবৃতিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের পক্ষের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।
সন্ধ্যা ৬টায় মির্জা ফখরুল ইসলামের নেতৃত্বে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সালাহ উদ্দিন আহমেদ যমুনায় প্রবশে করেন। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ছিলেন- উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হাসান আরিফ, আদিলুর রহমান খান ও মাহফুজ আলম।
প্রধান উপদেষ্টার আহ্বান : বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, 'বিএনপি মহাসচিবসহ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক হয়েছে। খুবই সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে বৈঠক হয়েছে। বৈঠকের মূল বার্তা হচ্ছে, আমাদের নিয়ে বেশ কিছু সংঘবদ্ধ অপপ্রচার হচ্ছে। সে বিষয়ে
বৈঠকে বিএনপির তরফ থেকেও একটা জাতীয় ঐক্যের কথা বলা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টাও এই জাতীয় ঐক্যের কথা বলেছেন। জাতির স্থিতিশীলতার জন্য তিনি সবার ঐক্যের কথা বলেছেন। সেটা ছাত্র-জনতা, হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টান সবার কাছে তিনি জাতীয় ঐক্যের বার্তা দিয়েছেন।'
বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে চট্টগ্রামে ইসকনের ঘটনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে কিনা, প্রশ্ন করা হলে প্রেস সচিব বলেন, 'বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ওই্ একই জিনিস সবাই জাতীয় ঐক্যের কথা বলেছেন। প্রধান উপদেষ্টা সবাইকে শান্তির বার্তা দিয়েছেন, সবাইকে শান্ত থাকতে বলেছেন।'
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমাদের তরফ থেকে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ থেকে যেটা পেয়েছি, সেখানে মোট ৩৩ জন জনকে গ্রেপ্তার করা হযেছে। এর মধ্যে ছয়জন হচ্ছে- যাদের ভিডিও ফুটেজ দেখে শনাক্ত করা হয়েছে, তাদের সাসপেক্ট হিসেবে ধরা হচ্ছে। আর ২১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারা ভেন্ডালিজমে, পুলিশের সঙ্গে মারামারি করার কারণে ধরা হয়েছে। আর ছয়জনকে ধরা হয়েছে, তারা আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের সদস্য। তারা ককটেলসহ ধরা পড়েছে।'
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে গত কয়েকদিনের সংগঠিত ঘটনাবলীতে উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। দ্রম্নত সমস্যা সমাধানে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, 'চলমান সংকট নিরসনে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। আমাদের সামনে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা জন্য বিশেষ করে, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, তাদের প্রতিহত করার জন্য আমাদের অবশ্যই জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।'
বিএনপি মহাসচিব বলেন, 'দেশের চলমান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে কথা বলেছি। বিশেষ করে কয়েক দিন ধরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছি। আমরা আশা করেছি, প্রধান উপদেষ্টা তার পরিষদ নিয়ে দ্রম্নত এসব বিষয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধান করবেন। দেশে যেন কোনো এ রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়।'
তিনি বলেন, 'আমাদের সামনে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেই চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলা করার জন্য, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, যারা এর স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে চায়, তাদের প্রতিরোধ বা প্রতিহত করার জন্য আমাদের অবশ্যই একটা জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।'
তিনি বলেন, 'আজকে আমাদের আসার মূল উদ্দেশ্য ছিল যে, সাম্প্রতিককালের উদ্ভুত পরিস্থিতি বিশেষ করে গত কয়েক দিন ধরে যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, ইসকন পরিস্থিতি, ছাত্রদের কয়েকটি কলেজের সমস্যা- এ বিষয়গুলো নিয়ে দলের পক্ষ থেকে যে উদ্বেগ, সেটা প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছি। আমরা আশা করেছি, প্রধান উপদেষ্টা তার উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে অতিদ্রম্নত সব সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের ব্যবস্থা করবেন। দেশে যেন কোনো রকমের অবস্থা সৃষ্টি না হয়। নইলে বর্তমান অবস্থার মধ্য দিয়ে বিভাজন সৃষ্টি হবে।'
জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, 'আমরা বলে এসেছি, এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হচ্ছে- জাতীয় ঐক্য। আমাদের সামনে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য বিশেষ করে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়ায় অথবা দেশের স্থিতিশীলতা যারা বিনষ্ট করতে চায়, তাদের প্রতিহত করার জন্য, প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের অবশ্যই একটা জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।' তিনি বলেন, সামগ্রিকভাবে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করার জন্য আমরা আহ্বান জানিয়েছি।
তিনি বলেন, 'একই সঙ্গে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে জনগণের দুর্ভোগ হচ্ছে। আমরা টিসিবির ট্রাক বৃদ্ধির কথা বলেছি। কৃষিতে সার বিতরণের সমস্যা নিরসনের কথা বলেছি। এখনো প্রশাসন বিভাগ ফ্যাসিবাদের দোসররা নিয়ন্ত্রণ করছে। সে জন্য জনগণের পক্ষে যারা আছেন, তাদের নিয়ে আসার কথা বলেছি।
শিল্পে উৎপাদনের জন্য স্বাভাবিক অবস্থা সচল রাখার বিষয় উলেস্নখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, শ্রমিকরা যাতে বেতন পান, সেটা বলেছি। প্রয়োজনে ঋণ দেওয়ার কথা বলেছি। একই সঙ্গে এখনো যেসব ইউনিয়ন পরিষদ বহাল আছে, সেগুলো ভেঙে দেওয়ার কথা বলেছি। বেশির ভাগই জবরদস্তির নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছে। যেহেতু সিটি করপোরেশন, উপজেলা ও পৌরসভা ভেঙে দেওয়া হয়েছে, সে জন্য ইউনিয়ন পরিষদও ভেঙে দিতে বলেছি।'
মির্জা ফখরুল বলেন, 'ট্রেড বডি ও ইউনিয়নগুলো পুনরায় নির্বাচনের মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে গঠনের কথা বলেছি। পাশাপাশি সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে যত দ্রম্নত সম্ভব নির্বাচনের রোডম্যাপ দেওয়ার কথা বলেছি। এ ছাড়া বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে আমাদের বিরুদ্ধে যেসব মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো প্রত্যাহারের কথা বলেছি।
বৈঠক সূত্র জানায়, এবারের বৈঠকে বিএনপি নেতাদের প্রায় সবাই হার্ডলাইনে বক্তব্য রেখেছেন। সেসব বক্তব্যের মধ্যে সহিংসতা, নির্বাচন, সংস্কারসহ সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমে ধীরগতির সমালোচনা ছিল। এর মধ্যে একজন নেতা বলেন, পুরান ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক দিন আগে ঘোষণা দিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। তাদের ওই ঘোষণার পরও কেনো সরকার তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। আরেকজন নেতা নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণায় সরকারের প্রধান বাধা কোথায়, তা জানতে চান। দেশি-বিদেশি নানান চক্রান্তের মধ্যে সরকার কেনো সংস্কার কার্যক্রমসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক রদবদলে ধীরগতি, সে বিষয়েও কয়েকজন নেতা উস্মা প্রকাশ করেন বলে জানা গেছে।
বৈঠকে নেতারা বলেছেন, দেশকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরিয়ে নিতে যত দেরি হবে, দেশকে নির্বাচনের দিকে নিয়ে যেতে যত দেরি হবে, তত মব জাস্টিসের নামে মব কালচার চলতে থাকবে। এতে জনমানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশ-বিদেশে গণ-অভু্যত্থানের সুফল নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হতে পারে। তারা বলেন, ছাত্র-জনতার গণ-অভু্যত্থান কয়েক মাস হলো। এখনো যদি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হয়, জনগণ যদি নিরাপত্তা শঙ্কায় থাকে, তাহলে গণ-অভু্যত্থানের সুফল পাওয়া যাবে না। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও কঠোর ভূমিকায় থাকতে হবে।