ঢাকা মহানগর এলাকার সড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চলাচল তিন দিনের মধ্যে বন্ধ বা বিধিনিষেধ আরোপ করতে হাইকোর্টের আদেশে এক মাসের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আদেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত।
হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে সরকারপক্ষের করা আবেদনের শুনানি নিয়ে সোমবার আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি মো. রেজাউল হক এ আদেশ দেন। ফলে ঢাকা মহানগর এলাকার সড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা আপাতত চলাচল করতে পারবে বলছেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবী।
এর আগে এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ১৯ নভেম্বর হাইকোর্ট রুলসহ আদেশ দেন। আদেশে ঢাকা মহানগর এলাকার সড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চলাচল তিন দিনের মধ্যে বন্ধ বা বিধিনিষেধ আরোপ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, ঢাকার জেলা প্রশাসক, দুই সিটি করপোরেশনের প্রশাসক, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারসহ বিবাদীদের প্রতি এ নির্দেশ দেওয়া হয়।
এই আদেশ স্থগিত চেয়ে সরকারপক্ষ রোববার আপিল বিভাগে আবেদনটি করে। এই আবেদনটি এদিন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে শুনানির জন্য ওঠে। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। রিট আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী এইচ এম সানজীদ সিদ্দিকী।
এদিকে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের বিক্ষোভে অচল হয়ে পড়েছিল রাজধানী ঢাকা। বেশ কিছুদিন ধরে বিক্ষোভ চললেও ইতোপূর্বে এতটা ভোগান্তি হয়নি। ঢাকার প্রবেশ মুখগুলো এবং আগারগাঁও চৌরাস্তা মোড়সহ শহরের বিভিন্ন রাস্তা বন্ধ করে বিক্ষোভ করেছেন রিকশাচালকরা। ঢাকার মূল সড়ক ছাড়া সব সড়কে রিকশা চলাচলে বাধা নেই।
বিক্ষোভকারীদের দাবি, ঢাকায় মূল সড়কে নয়, পাড়া-মহলস্নায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলার অনুমতি দিতে হবে। বন্ধ করতে হবে নানা ধরনের হয়রানি। পুলিশ প্রশাসনের আশ্বাসে বিকাল ৪টায় রাস্তা থেকে সরে যান বিক্ষোভকারীরা। প্রায় ৬ ঘণ্টা পর স্বাভাবিক হয় ঢাকার রাস্তায় যানবাহন চলাচল।
এদিকে, সোমবার সকাল
সাড়ে ১০টায় আগারগাঁও বাংলাদেশ বেতার পর্যন্ত যানজট লেগে থাকতে দেখা গেছে। পরে জানা যায়, আগারগাঁও চৌরাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা। আশপাশের প্রতিটি রাস্তায় শত শত যানবাহন আটকে থাকতে দেখা যায়। অনেকটা পথ ঘুরে নির্বাচন কমিশনের ভেতর দিয়ে আগারগাঁও চৌরাস্তা পৌঁছানো সম্ভব হয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সেখানে আগারগাঁও শিশু হাসপাতাল থেকে মহাখালীগামী ও মিরপুর থেকে গুলিস্থানগামী সড়ক বন্ধ করে দিয়েছেন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা। তারা রাস্তার এক প্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত রশি টানিয়ে দিয়েছেন। রশির সঙ্গে বেঁধে দিয়েছেন লাল কাপড়। আর চৌরাস্তার মোড়ের মাঝখানে অবস্থান নিয়ে ব্যানার হাতে বিক্ষোভ করছেন তারা।
অন্যদিকে রাস্তার আশপাশে থাকা পুলিশের কাঁটাতারের বেরিক্যাড টেনে নিয়ে রাস্তার মাঝ বরাবর ফেলে রেখেছেন। এছাড়া আশপাশ থেকে ভারী সিমেন্টের বস্নক এনে পুরো রাস্তাজুড়ে রেখে দিয়েছেন। এতে করে কোনো যানবাহন যেমন ঢুকতে পারছে না, তেমনি বেরও হতে পারছে না। শুধুমাত্র জরুরি সেবায় নিয়োজিত অ্যাম্বুলেন্স, সংবাদপত্র ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যানবাহন চলতে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া অন্য কোনো ধরনের যানবাহন চলতে দেওয়া হয়নি।
সোমবার দুপুর ১২টা নাগাদ আগারগাঁও চৌরাস্তা থেকে যানজট মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর হয়ে পলস্নবী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। আর আশপাশের লিংক সড়কগুলোতে যানজটে আটকা পড়ে শত শত যানবাহন। একই অবস্থা আগারগাঁও থেকে গাবতলী ও আমিনবাজার পর্যন্ত। কোনো ধরনের যানবাহন চলতে দেননি বিক্ষোভকারীরা। শুধু কিছু মোটরসাইকেল ও রোগী বহনকারী কয়েকটি সিএনজি যাতায়াত করতে পেরেছে। বিক্ষোভকারীরা হ্যান্ডমাইক দিয়ে আশপাশের সব রাস্তা বন্ধ করে দিতে নির্দেশ দিচ্ছিলেন। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আশপাশের কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদেরও যোগ দিতে দেখা গেছে। যদিও তারা আধা ঘণ্টার মতো অবস্থান করেই চলে গেছেন।
বিক্ষোভকারীদের একজন আলাউদ্দিন যায়যায়দিনকে বলেন, আমার বয়স এখন ৫৫ বছর। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের জোরও কমে গেছে। আগে প্যাডেল চালিত রিকশাই চালাতাম। কিন্তু এখন আর শরীরে কুলায় না। তাই ব্যাটারিচালিত রিকশা চালাই। যাত্রীরাও ব্যাটারিচালিত রিকশায় চড়তেই বেশি পছন্দ করেন। কারণ দ্রম্নত সময়ের মধ্যে গন্তব্যে যাওয়া যায়। আবার দ্রম্নত গতিতে চলায় দিনে মোটামুটি পায়ে চালিত রিকশার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ টাকা বেশি রোজগার করা সম্ভব হয়।
তিনি বলেন, গত কয়েক দিন ধরে আন্দোলন চলছে। এক পয়সা রোজগার নাই। সংসার চালানোর টাকা নেই। তাই বিক্ষোভ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। আমাদের সরকার যেন অন্তত পাড়া-মহলস্নার গলিতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানোর অনুমতি দেয়। ঢাকার ২২টি ভিআইপি সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানো যাবে না। সেটি আমরাও মানি। তারপরেও কিছু চালক আছে, না বুঝেই হুটহাট ওইসব সড়কে চলে যায়।
বিক্ষোভকারীদের আরেকজন আলীম যায়যায়দিনকে বলেন, আমরা সকাল ৮টা থেকে আগারগাঁও চৌরাস্তা মোড়ে অবস্থান করছি। আমাদের একটাই দাবি, ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানোর অনুমতি চাই। অন্যথায় আমাদের পরিবার পথে বসবে। একইসঙ্গে পুলিশের হয়রানি বন্ধ করতেও সরকারের প্রতি অনুরোধ করছি।
তিনি জানান, ঢাকায় অন্তত ১৩ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা চলছে। এর সঙ্গে অন্তত ৫০ লাখ লোকের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান এমনকি বেঁচে থাকা নির্ভর করছে। এছাড়া এসব যানবাহন সংশ্লিষ্ট আরও অন্তত ১০ লাখ মানুষ নানাভাবে জড়িত।
বিক্ষোভকারীরা জানান, শুধু আগারগাঁও না, ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকরা বিক্ষোভ করছেন। তার মধ্যে আছে আমিনবাজার, গাবতলী, মোহাম্মদপুর চার রাস্তা মোড়, বছিলা ব্রিজ সংলগ্ন এলাকা, মিরপুর-১০, ১, ১১, পলস্নবী, ভাষানটেক, কাফরুল, মিরপুর শাহ আলী (রা.) মাজার, মাজারের পেছনে দিয়াবাড়ি সড়কের তিন রাস্তা মোড়, যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, শ্যামপুর, পোস্তগোলা, পুরান ঢাকার ঠাটারিবাজার, কলতাবাজার, লক্ষ্ণীবাজার, রায় সাহেব বাজার মোড়, টিকাটুলী, যাত্রাবাড়ী, সদরঘাট, বুড়িগঙ্গা সেতু-২-এর মুখে (কেরানীগঞ্জ যাওয়ার রাস্তায়), উত্তরার আজমপুর, উত্তরখান, দক্ষিণখান, আব্দুলস্নাহপুর মোড়সহ ঢাকার যেসব এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলে, প্রতিটি এলাকায় বিক্ষোভ করছেন যানবাহনটির চালকরা।
বিকাল ৫টার দিকে বিক্ষোভকারী আলাউদ্দিন যায়যায়দিনকে বলেন, প্রশাসনের তরফ থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের অনুমতি দিয়েছে। তবে কোনোভাবেই মূল সড়কে উঠতে পারবে না। মূল সড়কে উঠলে পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবে। আপাতত পাড়া-মহলস্নার গলির রাস্তায় রিকশা চলাচল করতে পারবে। পুলিশ প্রশাসনের এমন আশ্বাসের প্রেক্ষিতে বিকাল ৪টার দিকে তারা বিক্ষোভ করা থেকে বিরত থাকেন। রাস্তা ছেড়ে দেন। এরপর থেকেই রাস্তায় যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক : এদিকে, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী আন্দোলনরত রিকশাচালকদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে ব্যটারিচালিত রিকশাচালক মালিক, গ্যারেজ মালিক ও রিকশা-ভ্যান-ইজিবাইক শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় রিকশা-ভ্যানে চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে ইউনিয়ন নেতারা অভিযোগ করলে শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, আপনারা পাড়া-মহলস্নায় কমিটি করেন। সেখানে আমার থানার ওসি থাকবে। যদি কোনো ওসি আপত্তি করেন, তবে তাকে সাসপেন্ড করা হবে। আমি চাঁদাবাজির বিপক্ষে। চাঁদাবাজির ঘটনায় যদি আমার বাহিনীর কেউ জড়িত থাকে, তবে সেটা আমার নজরে আনেন।
তিনি আরও বলেন, মামলাযোগ্য কোনো ঘটনায় যদি ডিএমপির কোনো থানার ওসি মামলা না নেয় বা টালবাহানা করে তবে সেটা আমাকে জানান। আমি ওই ওসিকে সরিয়ে দেব। বিকালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ এক মাসের জন্য স্থগিত করলে পুলিশের তরফ থেকে বলা হয়, ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা আপাতত চলাচল করতে পারবে। তবে কোনোভাবেই মূল সড়কে রিকশা চলতে পারবে না। পাড়া-মহলস্নার গলির রাস্তায় রিকশা চলাচলে কোনো বাধার সৃষ্টি করবে না পুলিশ।