রাজনৈতিক ও শ্রমিক অস্থিরতা, ব্যাংক ঋণের সুদের হার বৃদ্ধির কারণে নতুন বিনিয়োগে 'অনীহা', সব মিলিয়ে সময়টা ভালো ঠেকছে না পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের। এই পরিস্থিতিতে সরকারি উন্নয়ন ব্যয় বাড়াতে না পারলে অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা করছেন তিনি।
সোমবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি- একনেকের সভা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন।
উপদেষ্টা বলেন, 'রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে, বিশৃঙ্খলার কারণে বেসরকারি খাতে উৎপাদন যা আছে সেখানে স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে। গার্মেন্ট খাতে স্থবিরতা আছে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ নাই-ই। তার ওপর সুদের হার অনেক বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে করে উদ্যোক্তারা উৎসাহিত হচ্ছেন না নতুন বিনিয়োগের ব্যাপারে। সেক্ষেত্রে বেসরকারি খাতে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না, অন্যদিকে সরকারি উন্নয়ন ব্যয়ও যদি না বাড়ে তাহলে তো অর্থনীতির মন্দা অবস্থা তৈরি হবে।'
এই পরিস্থিতিতে সরকার কী করবে- এই প্রশ্নে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, এর জন্য নতুন 'উদ্ভাবনী ও মানব সম্পদের উন্নয়নের জন্য দ্রম্নত সময়ের মধ্যে নতুন প্রকল্প তৈরি'র কথা চিন্তা করছে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার।
এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলে সব উপদেষ্টাকে চিঠি দেবেন বলেও জানান তিনি। প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতি কাটিয়ে বাস্তবায়ন বাড়ানোতেও দেবেন তাগিদ। প্রকল্পকে 'দুর্নীতিমুক্ত' রাখতে চেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলেও প্রতিশ্রম্নতি দেন উপদেষ্টা।
বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না হলে প্রবৃদ্ধির কী হবে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, 'এক বছর বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না হলেও অনেক প্রবৃদ্ধি হতে পারে।'
উন্নয়ন বাজেট ছোট হচ্ছে
আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি-এডিপির আকার ছেঁটে ফেলার সিদ্ধান্তও জানান ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন,
'আমরা প্রথমদিকেই বলছিলাম, প্রতি বছরই বাজেটের থেকে কম বাস্তবায়ন হয়। এবার উন্নয়ন বাজেটটাই ছোট করব নানা কারণে। যে প্রকল্পগুলো ছিল, যেগুলো নতুন করে প্রস্তাব করা হয়েছে তার অনেকগুলোই বাদ দিতে হয়েছে। সেগুলোর অনেক তো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এবং সেগুলো ব্যয় অনুযায়ী সুফল বয়ে আনবে সেটা আমাদের মনে হয়নি। এগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে।'
ছোট হলে সেটি কী আকারের হবে সে প্রশ্নে তিনি বলেন, 'আমরা তো এই বছর এখনো পরিকল্পনা করিনি বাজেটের আকার কী হবে। সাধারণত সংশোধিত বাজেট তো ডিসেম্বরের দিকেই হয়।'
চলতি বছর প্রথম চার মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার গত ১৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম হওয়ার বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, 'এটা আমাদের বাজেট না। আগের সরকারের বাজেট।'
চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা দূর করতে প্রকল্প
একনেক বৈঠকে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে ৫ হাজার ১৫২ কোটি টাকার প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্র্বর্তী সরকার গত ৮ আগস্ট দায়িত্ব গ্রহণের পর এটিই সরকারের নেওয়া সবচেয়ে বড় প্রকল্প।
অন্তর্র্বর্তী সরকারের শপথের পর এটি তৃতীয় একনেক বৈঠক। দ্বিতীয় বৈঠকে কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পের মেয়াদ তিন বছর বাড়িয়ে ব্যয় ৬ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা বাড়ায় অন্তর্র্বর্তী সরকার।
টাকার অঙ্কে বেশি হলেও প্রকল্পটি ছিল আওয়ামী লীগ আমলের। সেই হিসাবে চট্টগ্রামেরটিই বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় প্রকল্প।
বৈঠকপরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, 'অনেক কিছু ঘেঁটে একটা নতুন প্রকল্প হচ্ছে। এটা আমাদের সময়ে নতুন শুরু হচ্ছে কিন্তু খুব দীর্ঘমেয়াদি। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু করে ২০৩২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। পৃথিবীর একমাত্র জায়গা যেখানে দোতলাতে বন্যা হয়, ফ্লাইওভারেও বন্যা হয়। উপরে হয়, নিচেও হয়। তাই এই প্রকল্প জরুরি।'
অতীতের পানি নিষ্কাশনের আগের প্রকল্পগুলোর কোনোটাই 'সফল হয়নি' মত দিয়ে তিনি বলেন, 'চট্টগ্রামের পানি নিষ্কাশন সমস্যা শুধু একটা প্রকল্প দিয়ে যাবে না।'
আট বছর মেয়াদি এ প্রকল্পে জাইকা ৪ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা ও সরকার ৯৬৯ কোটি টাকা অর্থায়ন করবে। উপদেষ্টা বলেন, 'জাপানি ঋণ খুবই ভালো। এগুলো খুবই দীর্ঘমেয়াদি এবং কম সুদে দেওয়া হয়।' জাপানের ঋণ 'প্রায়ই অনুদানের মতো' বলে তার ভাষ্য।
আরও যেসব প্রকল্পের অনুমোদন
বৈঠকে আরও চারটি প্রকল্পের অনুমোদন দেয় একনেক। এগুলো হলো- খুলনার মোংলা বন্দরে আধুনিক বর্জ্য ও নিঃসৃত তেল অপসারণ ব্যবস্থাপনা; বিদু্যৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের 'পূর্বাঞ্চলীয় গ্রিড নেটওয়ার্কের পরিবর্ধন এবং ক্ষমতা বর্ধন'; শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের 'ক্যাপাসিটি বিল্ডিং অব ইউনিভার্সিটিজ ইন বাংলাদেশ টু প্রমোট ইয়ুথ এন্টারপ্রেনারশিপ' এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের 'ইমার্জেন্সি মাল্টি-সেক্টর রোহিঙ্গা ক্রাইসিস রেসপন্স প্রজেক্ট (২য় সংশোধিত)'।
ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াই বেড়েছে আরও দুই প্রকল্পের মেয়াদ। এর মধ্যে রয়েছে-র্ যাব সদর দপ্তর নির্মাণ এবং স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) ফায়ারিং রেঞ্জের আধুনিকায়ন (১ম সংশোধিত)।