মো. জুয়েল (৩০) পেশায় একজন ব্যবসায়ী। হারিয়ে ফেলেছে তার বাম চোখের দৃষ্টিশক্তি। শিকার হয়েছে অত্যাচার আর নির্যাতনের। গুলিতে মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে তার ফুসফুস। বিচারের আশায় মামলা করতে গিয়েও মামলা নেয়নি কেউ। বরং মিলেছে প্রাণনাশের হুমকি। অভিযুক্তরা ছিল ফ্যাসিবাদী সরকারের দোসর। তাদের মূল হোতা আশীষ কুমার নাথ। আওয়ামী লীগ সরকারের ছত্রছায়ায় তারা চাঁদাবাজি, দখলবাজি, লুটতরাজ, মাদক ব্যবসা, হত্যা, গুম, খুনসহ নানা অপরাধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত থেকে সাধারণ মানুষের ক্ষতি করাই ছিল তার মূল কাজ।
দীর্ঘদিন পর বিচারের আশায় দ্বারস্থ হয়েছে আদালতে। গত ২০ নভেম্বর চট্টগ্রামের অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১১ জনের নাম উলেস্নখ করে আরও ২০ থেকে ২৫ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা দায়ের করেছে জুয়েল। যার মামলা নং- ১৩৩১/২০২৪। বিষয়টি বাদীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ লিয়াকত আলী নূর নিশ্চিত করেন।
মামলায় চান্দগাঁও থানা আওয়ামী লীগ নেতা আশীষ কুমার নাথকে প্রধান আসামি হিসেবে উলেস্নখ করা হয়েছে। আশীষ কুমার নাথ সাধুর পাড়ার মৃত উপেন্দ্র কুমার নাথের ছেলে।
এ ছাড়া মামলার বাকি আসামিরা হলেন- চান্দগাঁও থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. শহিদুল আলম, তিনি চান্দগাঁওয়ের পাঠানিয়া গোদার ফজল করিমের ছেলে। চান্দগাঁও থানা আওয়ামী লীগের নেতা নাজিম উদ্দিন, তিনি পূর্ব ষোলশহরের বাদশা চেয়ারম্যান ঘাটার মৃত মুন্সি মিয়ার ছেলে। চান্দগাঁও থানা ছাত্রলীগের সভাপতি নুর নবী শাহেদ, তিনি ৫নং ওয়ার্ড মোহরার বাসিন্দা। চান্দগাঁও আওয়ামী লীগ নেতা নাজমুল আলম নাজু, তিনি জালাল খান চৌধুরী পাড়ার মৃত ছদরুল আলমের ছেলে। সিরাজুল ইসলাম লেদু, তিনি মিন্নাত আলী সওদাগর বাড়ির মৃত মো. আবদুলস্নাহর ছেলে। সুজিত নাথ, তিনি উত্তর চান্দগাঁওর নাথপাড়ার বড়বাড়ির বাবুল নাথের ছেলে। মো. জাফরুল আলম বাপ্পু, তিনি পাঁচলাইশ থানাধীন এলাকার কামাল উদ্দিনের ছেলে। এসএম আবদুল কাদের, তিনি নাজির সড়কের বাসিন্দা মৃত মোবারক হোসেনের ছেলে। মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন, তিনি আফজল মাঝির বাড়ির মৃত কামাল উদ্দিনের ছেলে। মামলায় অজ্ঞাতনামা আর ২০ থেকে ২৫ জনকে আসামি করা হয়। এ ছাড়া মামলার ৭ নম্বর আসামি সুজিত নাথ চন্দগাঁওর প্রদীপ নাথ হত্যা মামলার আসামি সুকলাল নাথের ভাইপো।
মামলার এজাহারে বলা হয়, গত ৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের অবৈধ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন দুপুর ১২টায় চান্দগাঁও থানাধীন পাঠানিয়া গোদাস্থ এরশাদ উলস্ন্যাহ গামেন্টসের সামনে জুয়েল দোকানে যাওয়ার সময় আসামিরা আগ্নেয়াস্ত্র, কিরিস, রাম দা, লাঠি, এসএস পাইপ, লোহার রড দিয়ে তার ওপর আক্রমণ করে। মামলার প্রধান আসামি আশীষ কুমার নাথের নেতৃত্বে লোকজনদের ছত্রভঙ্গ করা হয়। মামলার এক নম্বর আসামি থেকে চার নম্বর আসামিরা হাত বোমাসদৃশ বস্তু নিক্ষেপ করে।
মামলার এক নম্বর আসামি আশীষ কুমার নাথের হাতে থাকা আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি ছুড়লে বাদীর বাম হাতের কবজির নিচে কার্তুজের স্পিলিন্টার ঢুকে রক্তাক্ত ও জখম হয়। কার্তুজের স্পিলিন্টারের আঘাতে মাটিতে লুটে পড়ে। আসামিদের হাতে থাকা লোহার রড দিয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে জুয়েলের মাথায় বাড়ি মেরে মারাত্মক জখম করে। মামলার ৭ নম্বর আসামি সুজিত নাথ লোহার রড দিয়ে বাদীর বামহাতে আঘাতের মাধ্যমে হাড়ভাঙা জখম করে। আসামিদের আগ্নেয়াস্ত্রের দিয়ে বাদীকে হত্যার উদ্দেশে গুলি ছুড়লে বুকের বামপাশে লেগে ফুসফুসে মারাত্মক আঘাত হয়। এ ছাড়া আসামিদের বিরুদ্ধে ঘটনার বিষয়ে মামলা মোকদ্দমা করলে বাদীকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়।
মামলার বাদী জুয়েল যায়যায়দিনকে বলেন, 'নির্বাচনের দিন মামলার প্রধান আসামি আশীষ কুমার নাথের নেতৃত্বে আমার ওপর হামলা করা হয়। আমাকে কিরিস, রাম দা, লাঠি, এসএস পাইপ, লোহার রড দিয়ে মারা হয়। আশীষ আমাকে বিএনপির কর্মী বলে গালিগালাজ করে আক্রমণ চালায়। আশীষ বোমা মেরে ওইদিন ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। আমাকে হত্যার উদ্দেশে গুলি করলে বামচোখে কার্তুজের স্পিলিন্টার ঢুকে রক্তাক্ত হয়ে জখম হয়। আমার চোখের দৃষ্টি চিরতরে নষ্ট হয়ে গেছে।'
মামলার বাদী জুয়েল আরও বলেন, 'আমি চিকিৎসা শেষে থানায় মামলা করতে গেলে আসামিরা ফ্যাসিবাদী সরকারের দোসর হওয়ায় থানা কর্তৃপক্ষ মামলা গ্রহণ করে নাই। আদালতে মামলা করতে চাইলে আমাকে প্রাণনাশের হুমকি প্রদান করা হয়। দীর্ঘদিন মামলা করা থেকে বিরত রাখা হয়।'
বাদীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ লিয়াকত আলী নূর যায়যায়দিনকে বলেন, 'আমার বাদীকে দীর্ঘদিন মামলা করা থেকে বিরত রাখে আসামিরা। থানায় মামলা করতে গিয়েও মামলা করতে পারে নাই। আদালতে মামলা করতে চাইলে বাদীকে প্রাণনাশের হুমকি প্রদান করা হয়। এখন আদালতে মামলা হয়েছে। আমরা চাই পুলিশ যেন দ্রম্নত আসামিদের গ্রেপ্তার করে।'
মামলার বিষয়ে জানতে চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আফতাব উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'থানায় প্রতিদিন অনেক মামলা হচ্ছে। পরে যোগাযোগ করেন, নথিপত্র দেখে বলতে হবে।'
তবে বাদীর পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় মামলাটি নথিভুক্ত হয়েছে বলে জানানো হয়।