'অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য' নির্বাচন দেওয়ার প্রতিশ্রম্নতি দিয়ে নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন বলেছেন, 'সবার সহযোগিতা নিয়ে আমরা এই জাতিকে একটা অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন উপহার দেব।'
রোববার শপথ গ্রহণ শেষে সুপ্রিম কোর্ট থেকে বের হওয়ার সময় মূল ভবনের প্রবেশপথে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, 'ফার্স্ট অব অল শপথ নিয়েছি। শপথের সম্মানটা রাখতে চাই। শপথ সমুন্নত রাখতে চাই। আমি এটাকে নিজের জীবনের বড় অপরচুনিটি হিসেবে দেখছি এই দায়িত্বটাকে। অপরচুনিটি টু সার্ভ দ্য নেশন। দেশের মানুষ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। তারা অবাধ ও নিরপেক্ষ একটা নির্বাচনের জন্য অনেক সংগ্রাম করেছে। অনেক আন্দোলন করেছে বিগত বছরগুলোয় এবং অনেকে রক্ত দিয়েছে। আমি তাদের একটা অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ। এ জন্য সর্বোচ্চটুকু করব।'
সিইসি সাংবাদিকদের বলেন, 'সবাই মিলে, আপনাদের সবার সহযোগিতা নিয়েই কিন্তু (নির্বাচন) করতে হবে। আমরা একা পারব না। আপনাদের সহযোগিতা লাগবে। দেশবাসীর সহযোগিতা লাগবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা লাগবে। সবার সহযোগিতা নিয়ে আমরা এই জাতিকে একটা অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন দেব।'
এক প্রশ্নের জবাবে
নাসির উদ্দীন বলেন, 'সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া। একটা নির্বাচন করতে গেলে কিছু প্রয়োজনীয় সংস্কার তো লাগবেই। উদাহরণ, এখন নানা রকম কথা হচ্ছে। কেউ প্রোপরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন, আবার কেউ বলে আগের সিস্টেমে ইলেকশন। সংবিধানে যদি এটা ফয়সালা না হয়, আমরা নির্বাচনটা করব কীভাবে? নির্বাচন করতে গেলে নতুন প্রজন্ম, যারা ভোট দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে বছরের পর বছর, তাদের তো ভোটার তালিকায় আনতে হবে। ভোটার তালিকা করতে হবে। ...কোথায় কোথায় সংস্কার দরকার হবে, ইন্টারভেনশন দরকার হবে, সেটি পাব, যেহেতু নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের জন্য একটা কমিশন কাজ করছে। পরামর্শ আসুক, আমরা দেখি কোনটা কোনটা গ্রহণযোগ্য হয়। যেগুলো গ্রহণযোগ্য হবে, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে আমাদের।'
সংবিধান সংস্কার কমিশন কাজ করছে উলেস্নখ করে সিইসি বলেন, 'তারাও সংবিধানের বিষয়ে সাজেশন দেবেন। ...আমি ও আমার টিম সংবিধানের প্রোডাক্ট। সংবিধান যদি ঠিক না হয়, তাহলে আমাদের যাত্রা এলোপাতাড়ি হয়ে যাবে। সুতরাং এ কার্যক্রমও শেষ হোক। সব সুপারিশ আসুক। বেশিদিন তো নেই। উনারা তো বলছেন, ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়েছে। অতি অল্প সময়, আপনারা আশ্বস্ত থাকুন।'
এবারের মতো সুযোগ আগে ছিল না বলে উলেস্নখ করেন নাসির উদ্দীন। তিনি বলেন, 'শুধু আমরা নই, রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন করবে। তারা ১৫ থেকে ১৬ বছর ধরে বলে আসছে তারা ভোটের অধিকার চায়, অবাধে ভোট দিতে চায়। সুতরাং তাদের সঙ্গে পাব। তাদের ডিমান্ডটা বাস্তবায়নে আমরা সহযোগিতা করব। সুতরাং আমাদের কোনো অসুবিধা নেই। তারাও জাতির কাছে ওয়াদাবদ্ধ।'
কবে নির্বাচন দেবেন- এমন প্রশ্নে সিইসি বলেন, 'দিনক্ষণ দিয়ে তো এখন বলা যাবে না। কিছু সংস্কার, যেগুলো দরকার আছে, সেগুলো করে...আগে আমি দায়িত্বটা নিই, একটু বুঝে নিই, কাজকর্মটা বুঝে নিই। আমাকে একটু বুঝতে তো দেবেন, ভাই।'
এর আগে, রোববার দুপুর দেড়টায় সুপ্রিম কোর্ট জাজেজ লাউঞ্জে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ প্রথমে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীনকে শপথ পড়ান। এরপর চার নির্বাচন কমিশনারকে শপথবাক্য পাঠ করান তিনি।
শপথ নেওয়া চার নির্বাচন কমিশনার হলেন- সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ আবদুর /////রহমানেল মাসুদ, সাবেক যুগ্ম সচিব তহমিদা আহ্?মদ ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল ফজল মো. সানাউলস্নাহ।
ক্ষমতার পালাবদলের পর এমন একসময়ে নাসির কমিশন দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে, যখন রাষ্ট্র সংস্কার করে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২-এর অধীনের নতুন ইসি গঠনে ৩১ অক্টোবর সার্চ কমিটি গঠন করা হয়। আইনে বেঁধে দেওয়া যোগ্যতা, অযোগ্যতা অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও সুনাম বিবেচনা করে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য ১৫ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে ১০ জনের নাম জমা দেয় এই কমিটি।
সার্চ কমিটি প্রস্তাবিত তালিকা থেকে বৃহস্পতিবার একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং চারজনকে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। তাদের মেয়াদ পাঁচ বছর।
ক্ষমতার পালাবদলে পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তরফে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলোর 'নূ্যনতম ঐকমত্যের' ওপর নির্ভর করছে নির্বাচনের টাইমলাইন।'
সর্বশেষ এ বছরের ৭ জানুয়ারি তাদের অধীনেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়েছিল। বিএনপি ও সমমনাদের বর্জনের মধ্যে গত জানুয়ারিতে সেই নির্বাচনে জিতে টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। তার আট মাসের মাথায় গণ-অভু্যত্থানে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনের অবসান হয়।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে গঠিত কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত ৫ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করে। দেড় মাস ধরে শূন্য থাকার পর এ এম এম নাসির উদ্দীন নেতৃত্বাধীন ইসি নিয়োগ পেয়ে পূর্ণ হলো নির্বাচন কমিশন।
সিইসি যারা: দেশে এর আগে ১৩ জন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং ৩১ জন নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাদের অধিকাংশই নাসির উদ্দীনের মতো অবসরপ্রাপ্ত আমলা।
এবার নিয়ে টানা পঞ্চমবার সিইসি পদে নিয়োগ পেলেন সাবেক সচিব, যার শুরু হয়েছিল এ টি এম শামসুল হুদার মাধ্যমে। শামসুল হুদার আগের কমিশনে একজন বিচারক থাকলেও তার আগে আবার ছিলেন আমলা।
১৯৭২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে ছিলেন বিচারপতিরা। এরপর ইসিতে শুরু হয় সাবেক আমলাদের নেতৃত্ব। মাঝখানে ২০০৫ সালে এক বছর সাত মাস একজন বিচারপতি ছাড়া গত প্রায় তিন দশক সাবেক আমলারাই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
এ এম এম নাসির উদ্দীন: ২৪ নভেম্বর থেকে...। কাজী হাবিবুল আউয়াল: ২৭ ফেব্রম্নয়ারি ২০২২ থেকে ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪। কে এম নূরুল হুদা: ১৫ ফেব্রম্নয়ারি ২০১৭ থেকে ১৪ ফেব্রম্নয়ারি ২০২২। কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ: ৯ ফেব্রম্নয়ারি ২০১২ থেকে ৯ ফেব্রম্নয়ারি ২০১৭। এ টি এম শামসুল হুদা: ৫ ফেব্রম্নয়ারি ২০০৭ থেকে ৫ ফেব্রম্নয়ারি। বিচারপতি এম এ আজিজ: ২৩ মে ২০০৫ থেকে ২১ জানুয়ারি ২০০৭। এম এ সাইদ: ২৩ মে ২০০০ থেকে ২২ মে ২০০৫। মোহাম্মদ আবু হেনা: ৯ এপ্রিল ১৯৯৬ থেকে ৮ মে ২০০০। বিচারপতি এ কে এম সাদেক: ২৭ এপ্রিল ১৯৯৫ থেকে ৬ এপ্রিল ১৯৯৬। বিচারপতি আব্দুর রউফ: ২৫ ডিসেম্বর ১৯৯০ থেকে ১৮ এপ্রিল ১৯৯৫। বিচারপতি সুলতান হোসেন খান: ১৭ ফেব্রম্নয়ারি ১৯৯০ থেকে ২৪ ডিসেম্বর ১৯৯০। বিচারপতি চৌধুরী এ টি এম মাসউদ: ১৭ ফেব্রম্নয়ারি ১৯৮৫ থেকে ১৭ ফেব্রম্নয়ারি ১৯৯০। বিচারপতি এ কে এম নুরুল ইসলাম: ৮ জুলাই ১৯৭৭ থেকে ১৭ ফেব্রম্নয়ারি ১৯৮৫। বিচারপতি মো. ইদ্রিস: ৭ জুলাই ১৯৭২ থেকে ৭ জুলাই ১৯৭৭
সিইসির দায়িত্বে বিচারপতিদের মধ্যে মো. ইদ্রিস ও এ টি এম মাসউদ এবং সাবেক আমলাদের মধে?্য এম এ সাঈদ, শামসুল হুদা, কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ ও নূরুল হুদা পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করতে পেরেছেন।