বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২

আনন্দ হঠাৎ বিষাদে পরিণত

পিকনিকের বাস বিদু্যতায়িত, গাজীপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থীর মৃতু্য
গাজীপুর ও শ্রীপুর (গাজীপুর) প্রতিনিধি
  ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
আনন্দ হঠাৎ বিষাদে পরিণত
জোবায়ের আলম, মোস্তাকিম রহমান ও মোজাম্মেল হোসেন

গাজীপুরের শ্রীপুরে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির শিক্ষার্থীদের বহনকারী পিকনিকের বাস বিদু্যতায়িত হয়ে তিন শিক্ষার্থীর মৃতু্য হয়েছে। এ ঘটনায় আরও অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের উদয়খালী গ্রামের চায়না কারখানার সামনে এ ঘটনা ঘটে। এদিকে তিন ছাত্রের মৃতু্যর ঘটনায় পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, 'তদন্ত করার পর বলা যাবে এটি দুর্ঘটনা কিনা।'

অন্যদিকে, শনিবার দুপুরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ ঘটনায় নিহত ও আহতদের দেখতে গিয়ে বলেন, এটি অত্যন্ত মর্র্মান্তিক দুর্ঘটনা। রাস্তায় বের হলে যদি এরকম হয়, তাহলে এ দায়িত্বটা কার আপনরাই ভালো বুঝেন। আমি আসলে কাউকে সরাসরি দায়ী করতে চাই না। ছাত্ররা বাইরে যাবে এটাই স্বাভাবিক, পিকনিকে যাবে তাও স্বাভাবিক। একটা ছেলে গাড়িতে বসে বা দাঁড়িয়ে থেকেও যদি তার জীবনের নিরাপত্তা না থাকে, তাহলে কি করবে? এটা তো এমন দুর্ঘটনা না যে মুখোমুখি সংঘর্ষ কিংবা বাসটা উল্টে পড়ে গিয়েছে। সে গাড়িতেই আছে কিন্তু বিদু্যতায়িত হয়ে মারা গেছে, তাহলে বুঝতেই পারছেন দায়দায়িত্ব কার। আরও যেন এভাবে প্রাণ না যায়, ভবিষ্যতে রাস্তা-ঘাট যেন ক্লিয়ার থাকে তার যেন যথেষ্ট উচ্চতায় থাকে এবং সেগুলো যেন লিকেজ না থাকে কর্তৃপক্ষকে নজর রাখতে হবে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওই সড়কের পাশের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বৈদু্যতিক তারে বাসটির স্পর্শ লেগে তিন শিক্ষার্থী নিহত হন। তারা হলেন- জোবায়ের আলম সাকিব (২২), মোস্তাকিম রহমান মাহিন (২২) ও মোজাম্মেল হোসেন নাঈম (২৪)। তারা সবাই গাজীপুরের

বোর্ড বাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

স্থানীয় বাসিন্দা আফসার উদ্দিন (৭০) বলেন, 'বিআরটিসির ছয়টি দোতলা বাস এবং তিনটি মাইক্রোবাস নিয়ে উত্তর পেলাইদ গ্রামের মাটির মায়া রিসোর্টে পিকনিকে আসেন ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির ৪৬০ জন শিক্ষার্থী। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামীণ আঞ্চলিক সড়ক ধরে রিসোর্টের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল। এর মধ্যে একটি বাস উদয়খালী গ্রামে সড়কের পাশ দিয়ে যাওয়া হাই ভোল্টেজের লাইনে বিদু্যতায়িত হয়। এ সময় তিন ছাত্র বিদু্যৎস্পৃষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলে মারা যায়।'

প্রত্যক্ষদর্শী শামীম আহমেদ, রুবেল মিয়া ও জাকির হোসন জানান, পিকনিকে আসা পাঁচটি বাস রিসোর্টে চলে যায়। কিন্তু সব শেষের বাসটি সড়কের পাশের বিদু্যতের লাইনে লেগে গেলে পুরো বাস বিদু্যতায়িত হয়। এ সময় বাস থেকে ধোঁয়া বের হতে থাকে। ছাত্ররা চিৎকার শুরু করলে তা শুনে তারা বাসের কাছে যান। এ সময় তিনজন ছাত্র বাস থেকে নেমে বের হওয়ার চেষ্টা করলেও যেতে না পেরে একজনের মৃতু্য হয়। অন্য দুইজনকে শুকনা বাঁশ দিয়ে আঘাত করে শরীর পৃথক করা হয়।

এছাড়া আহতদের শরীরের বিভিন্ন অংশ বিদু্যতায়িত হয়ে কারো হাত, কারো পা, কারো মুখ ঝলসে গেছে।

পিকনিকে আসা কয়েকজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিযোগ করেন, গ্রামীণ আঞ্চলিক এক লেনে সড়কে, যেখানে মিনিবাস চলাই কঠিন, সেখানে কী করে বিআরটিসির ডাবল ডেকার বাস প্রবেশ করানো হলো? পিকনিক স্পট বুক করার আগে সড়কে ডাবল ডেকার বাস প্রবেশ করবে কিনা জানা দরকার ছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এসব বিষয় চিন্তাতেই আনেননি।

রিসোর্ট কর্তৃপক্ষও বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজকদের জানায়নি। তাই এ ঘটনার দায় বিশ্ববিদ্যালয় ও রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারেন না, বলেন শিক্ষার্থীরা।

স্থানীয়রা জানান, পলস্নী বিদু্যতের তারটি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে ছিল। পলস্নী বিদু্যৎ যদি তারটি খোলা না রেখে কভার তার ব্যবহার করত, তাহলে এতবড় দুর্ঘটনা ঘটত না।

ময়মনসিংহ পলস্নী বিদু্যৎ সমিতি-২ এর উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) খন্দকার মাহমুদুল হাসান বলেন, 'ওই লাইনটি ১১ হাজার ভোল্টেজের ছিল। একটি বাসকে সাইড দিতে গিয়ে দোতলা বাসটি একটু হেলে পড়ায় লাইনে লেগে বিদু্যতায়িত হয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে।'

শ্রীপুর থানার ওসি জয়নাল আবেদীন মন্ডল জানান, আহতদের উদ্ধার করে ময়মনসিংহ মেডিকেল হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।

গাজীপুরের জেলা প্রশাসক নাফিসা আরেফীন বলেন, 'এ ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সালমা আক্তারকে প্রধান করে ৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তের পর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

কমিটির সদস্যরা হলেন- উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ব্যারিস্টার সজিব আহমেদ, শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি জয়নাল আবেদীন ও ময়মনসিংহ পলস্নী বিদু্যৎ সমিতি-২ এর ডিজিএম আনোয়ারুল আলম। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও ৫ সদস্যবিশিষ্ট পৃথক একটি কমিটি গঠন করেছে।

মৃতু্যর দায় কার, প্রশ্ন ভিসির

শনিবার দুপুরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহত এবং নিহতদের দেখতে এসে তিন শিক্ষার্থীর মৃতু্যর দায় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন উপাচার্য অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম খান।

তিনি বলেন, 'এটি অত্যন্ত মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। রাস্তায় বের হলে যদি এরকম হয়, তাহলে এ দায়িত্বটা কার? আমি আসলে কাউকে সরাসরি দায়ী করতে চাই না। ছাত্ররা বাইরে যাবে এটাই স্বাভাবিক, পিকনিকে যাবে তাও স্বাভাবিক। একটা ছেলে গাড়িতে বসে বা দাঁড়িয়ে থেকেও যদি তার জীবনের নিরাপত্তা না থাকে, তাহলে কি করবে? এটা তো এমন দুর্ঘটনা না যে মুখোমুখি সংঘর্ষ কিংবা বাসটা উল্টে পড়ে গিয়েছে। সে গাড়িতেই আছে কিন্তু বিদু্যতায়িত হয়ে মারা গেছে, তাহলে বুঝতেই পারছেন দায়দায়িত্ব কার। আরও যেন এভাবে প্রাণ না যায় ভবিষ্যতে রাস্তা-ঘাট যেন ক্লিয়ার থাকে, তার যেন যথেষ্ট উচ্চতায় থাকে এবং সেগুলো যেন লিকেজ না থাকে কর্তৃপক্ষকে নজর রাখতে হবে।'

সরু সড়কে দ্বিতল বাস চলার অনুমতি ছিল কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ভিসি আরও বলেন, 'যারা পিকনিকের আয়োজন করেছে তারা কেন দ্বিতল বাস নিল এবং সে রাস্তায় তা চলাচলে অনুমতি ছিল কি না তা আমার জানা নেই। এটা তো ভালো জানার কথা বিআরটিসির, কারণ তারা বাস ভাড়া দেয়। বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হবে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে