বন্ধ হচ্ছে আউটসোর্সিং নিয়োগ
তথ্য গোপন করে কোটিপতি হয়েছে ১৩ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান
প্রশাসনিক জটিলতা এড়াতে এ পদ্ধতিতে জনবল নিয়োগ বন্ধ করছে সরকার
প্রকাশ | ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
এমএইচ সৈকত
নানা জটিলতার কারণে নতুন সব উন্নয়ন প্রকল্পে আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় জনবল নিয়োগ পরিহার করতে বলেছে পরিকল্পনা কমিশন। কারণ আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগপ্রাপ্তরা চাকরির শেষদিকে এসে রাজস্বভুক্ত হওয়ার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেন। এমনকি আদালত পর্যন্ত গড়ানোর রেকর্ডও রয়েছে। প্রশাসনিক জটিলতা এড়াতে এ পদ্ধতিতে জনবল নিয়োগ বন্ধ করছে সরকার।
তথ্যমতে, আউটসোর্সিং নীতিমালা (ঠিকাদারের মাধ্যমে নিয়োগ প্রথা)-২০১৮, আমলারা নীতিনির্ধারকদের যেভাবে বুঝিয়েছেন সেভাবেই চলেছে। ভালো-মন্দ খতিয়ে দেখা হয়নি। আউটসোর্সিং নীতিমালা করার সময়ই বলা হয়েছে এটি টিকবে না। কর্মচারীকে অভুক্ত রেখে সরকারের সাশ্রয় করার নীতি প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তাছাড়া সরকার যেখানে মধ্যস্বত্বভোগীদের যন্ত্রণা থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্তি দিতে চায় সেখানে কে নতুন করে মধ্যস্বত্বভোগীদের সুযোগ করে দিয়েছে সে প্রশ্নও উঠবে। আমলারা সেই সময়ের সরকার প্রধানকে বুঝিয়েছিলেন, সরকারের খরচ কমাতে হবে এবং সেবার মান বাড়াতে হবে। এ কারণে আউটসোর্সিং পদ্ধতি উপযোগী।
এদিকে, সম্প্রতি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের 'ইউনিয়ন পর্যায়ে মৎস্য চাষ প্রযুক্তি সেবা সম্প্রসারণ' প্রকল্পের আওতায় আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় নিয়োগের জন্য প্রস্তাবিত ২৫৩ জন জনবল বাদ দিয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের অর্গানোগ্রামভুক্ত নিজস্ব জনবল দিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়েছে। শুধু এই প্রকল্প নয়, এই মন্ত্রণালয়ের নতুন কোনো প্রকল্পেই আউটসোর্সিং রাখা হবে না। তবে টেকনিক্যাল কিছু লোক রাখা হবে অস্থায়ী ভিত্তিতে।
এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ
মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) মো. তোফাজ্জেল হোসেন বলেন, 'পুনর্গঠিত প্রকল্পে আউটসোর্সিং সব জনবল বাদ দেওয়া হবে। এখন থেকে প্রকল্পের আওতায়
জনবল নিয়োগ যথাসম্ভব পরিহার করা হবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে মৎস্য অধিদপ্তরের অর্গানোগ্রামভুক্ত নিজস্ব জনবল দিয়ে। প্রয়োজনে অর্গানোগ্রামভুক্ত শূন্য পদগুলো পূরণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'অনেকে না বুঝে আউটসোর্সিং থেকে রাজস্বে যেতে চান, যা বাস্তবে সম্ভব নয়। আউটসোর্সিংয়ে লোক নেওয়া ঝামেলা। এসব জনবল মাঝ বয়সে যাবে কোথায়। তাই আমরা নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমাদের মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রকল্পে আর আউটসোর্সিং থাকবে না। দরকার হলে আমাদের শূন্যপদ পূরণ করব।'
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সচিবালয়ে ১৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় সেবা গ্রহণ নীতিমালা ২০১৮-এর আলোকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে জনবল সরবরাহ করে আসছে। তাদের মধ্যে প্রাণ-আরএফএল ছাড়া বাকি ১৩টি প্রতিষ্ঠান নিম্ন আয়ের মানুষের অর্থ নয়ছয় করে নিজেদের পকেট ভারী করছে। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- ইস্টার্ন এন্টারপ্রাইজ, কণা কারিগর, প্রায়ন্তী এন্টারপ্রাইজ, শুভ্রা ট্রেডার্স, ইকবাল এন্টারপ্রাইজ, ইউনিভার্সেল এন্টারপ্রাইজ, মান বাংলাদেশ, ক্রিয়েটিভ এন্টারপ্রাইজ, আজিজ অ্যান্ড কোং, রশিদ এন্টারপ্রাইজ, ড্যাফোডিল এন্টারপ্রাইজ, রিমন এন্টারপ্রাইজ এবং ধলেশ্বরী এন্টারপ্রাইজ। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা ছিলেন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের আশীর্বাদপুষ্ট। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পরও তারা বহাল তবিয়তে রয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, কোনো কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মচারীদের পদ ভেদে প্রতি মাসে জনপ্রতি ২ হাজার ৯১০, ৩ হাজার ৯১০ এবং ৫ হাজার টাকা করে কম বেতন দিচ্ছে। এভাবে চার শতাধিক কর্মচারীকে বঞ্চিত করে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। যার পরিমাণ বছরে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। হাতিয়ে নেওয়া এসব টাকার একটি অংশ টেন্ডার পেতে সহায়তাকারী গণপূর্তের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ও বিভিন্ন খাতে ব্যয় হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর এসব অপকর্ম নিয়ে গত ২১ আগস্ট অন্তর্র্বর্তী সরকারের গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টার কাছে একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন ভুক্তভোগীরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন সচিব মো. নবীরুল ইসলামকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেন উপদেষ্টা। দ্রম্নত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার কথা বলা হয় তাকে। এই নির্দেশনার পর একজন অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক ও যুগ্ম সচিবকে সদস্য সচিব করে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। এরই মধ্যে অনেক সময় পেরিয়ে গেলেও কোনো প্রতিবেদন জমা পড়েনি। তবে অভিযোগ দায়ের করার কারণে বেশ কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কর্মীদের নানা রকম হুমকি দিচ্ছে বলে জানা গেছে।
নীতিমালা অনুযায়ী জনবল সরবরাহের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো মোট জনবলের বেতনের ওপর ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে অতিরিক্ত অর্থ পায়। এরপরও নিম্ন আয়ের শ্রমিকদের প্রাপ্য বেতন থেকে আরও একটি অংশ কেটে নিচ্ছে ঠিকাদাররা। এই অতিরিক্ত টাকা বিভিন্ন খাতে খরচ করতে হয় বলে কর্মীদের সাফাই গাওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। চাকরি হারানোর ভয়ে তারা শেষ পর্যন্ত ঠিকাদারের এসব অনিয়ম জেনেশুনেই সহ্য করে যান।
এদিকে, বাড়তি কাজের জন্য অতিরিক্ত টাকা দেওয়ার নিয়মও মানছে না সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় সেবা গ্রহণ নীতিমালা ২০১৮-এর ৭-এর (১)-এ বলা রয়েছে- 'সেবা প্রদানকারী অতিরিক্ত সময় সেবাদানে নিয়োজিত থাকলে চুক্তি অনুযায়ী অতিরিক্ত সেবা মূল্য প্রদেয় হবে।' যদিও ওভারটাইম করার পরও কর্মচারীরা নীতিমালা অনুযায়ী কোনো পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না। এ খাত থেকেও ঠিকাদাররা প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা পকেটস্থ করছেন। ঈদ কিংবা পূজা পার্বণেও কোনো ভাতা পান না এই কর্মীরা।
অন্যদিকে, নিয়ম অনুযায়ী কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করার কথা। এসব টেন্ডারের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিতে হবে। সেক্ষেত্রেও নেওয়া হয় অভিনব কৌশল। দেশের শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিকগুলোয় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের কথা থাকলেও নামসর্বস্ব কিছু পত্রিকায় এসব বিজ্ঞাপন দিয়ে এককভাবে টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। এভাবে বিগত সময় নিয়ম না মেনে বছরের পর বছর নির্দিষ্ট কিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানই ঘুরে-ফিরে চুক্তি নবায়ন করে চলেছে। এ চক্রের বাইরে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে জনবল সরবরাহের নজির নেই। কিন্তু এ পদ্ধতিতে একজন কর্মচারী ঈদের সময় বোনাস পাবেন না, বছর শেষে তার বেতন বাড়বে না, তিন বছর পর চাকরি থাকবে না এসব অসুবিধার কথা আড়াল করা হয়েছে। এই অমানবিক আউটসোর্সিংয়ের চাকরি নিতে গিয়েও চাকরিপ্রার্থীদের মাথাপিছু ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাদের। কারণ তারাই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আউটসোর্সিংয়ের আওতায় জনবল সরবরাহ করতেন। সেই আউটসোর্সিং কর্মচারীরা এখন রাজপথে মিছিল করছেন। তাদের ঘুষ দিয়ে চাকরি নেওয়ার দুর্দশার কাহিনী বলে বেড়াচ্ছেন।
উন্নয়ন প্রকল্পের জনবল নির্ধারণ সংক্রান্ত আন্তমন্ত্রণালয় কমিটির সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নোত্তর পর্যায়ে কোনো জনবল সুপারিশ করা হয় না। এ ছাড়া প্রকল্পের জনবলের কোনো পদ রাজস্ব খাতে স্থানান্তর হবে না, শর্ত থাকে।
পরিকল্পনা কমিশন জানায়, নতুন সব প্রকল্পে আউটসোর্সিং জনবল পরিহার করতে হবে। সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে নিজস্ব জনবল দিয়ে। এখন থেকে প্রকল্পের আওতায় নতুন জনবল নিয়োগ যথাসম্ভব পরিহার করতে হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, এখন থেকে প্রকল্পের আওতায় আউটসোর্সিং জনবল পরিহার করতে হবে। না বুঝে আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগপ্রাপ্তরা রাজস্বে যেতে চান, যা সম্ভব নয়। একটি প্রকল্প নির্দিষ্ট মেয়াদে বাস্তবায়ন হয়। অনন্তকালের জন্য আমরা আউটসোর্সিং থেকে রাজস্বে আনতে পারি না। তাহলে পড়ালেখা বাদ দিয়ে সবাই আউটসোর্সিংয়ে প্রবেশ করবে। এতে যারা পড়ালেখা করে পরীক্ষা দিয়ে সরকারি চাকরি পেয়ে রাজস্বে এসেছেন তাদের সঙ্গে আউটসোর্সিং জনবলের সঙ্গে বৈরিতা তৈরি হবে। এসব ঝামেলা এড়াতেই এখন থেকে নতুন প্রকল্পে আউটসোর্সিং জনবল দেওয়া হবে না।'
আউটসোর্সিং থেকে একজন কর্মী রেভিনিউয়ে আসতে পারবে কি? এমন প্রশ্নের জবাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগ) মো. আব্দুর রউফ বলেন, 'এমন নজির নেই। সরকার যদি সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে ভিন্ন কথা। তবে এমন কোনো নজির নেই। জনপ্রশাসনের আওতার বাইরে এটা করার সুযোগ নেই। আদালতের আদেশের মাধ্যমে এলে ভিন্ন কথা।'
ঠিকাদারদের অনিয়ম খতিয়ে দেখতে গত ১৮ সেপ্টেম্বর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। প্রশাসন অনুবিভাগ-২-এর অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক এবং একই শাখার যুগ্ম সচিবকে সদস্য সচিব করে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। তবে এ কমিটির কাছ থেকে এখনও প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। নেওয়া হয়নি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো সাময়িক পদক্ষেপও। এ বিষয়ে কমিটির আহ্বায়ক শাকিলা জেরিন আহমেদ বলেন, এটা নিয়ে কাজ চলছে। নথিপত্র দেখে বলতে হবে প্রতিবেদনের অগ্রগতি কতদূর।
সরকারি সব দপ্তর-অধিদপ্তরে নিয়োজিত আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় সেবাগ্রহণ নীতিমালা (ঠিকাদারের মাধ্যমে নিয়োগ প্রথা)-২০১৮ বাতিল করে কর্মরত আউটসোর্সিং কর্মচারীদের বহাল রাখা ও বয়স শিথিল করে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে চাকরি জাতীয়করণের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ আউটসোর্সিং কর্মচারী কল্যাণ পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটি। আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ও শাহবাগে মিটিং-মিছিলও করেছেন।
এখনো বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরের আউটসোর্সিং কর্মকর্তারা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এটা নিয়ে বিপাকে সংশ্লিষ্ট বিভাগ। তাই নতুন প্রকল্পে আউটসোর্সিংয়ের কোনো খাত রাখা হচ্ছে না। এমনকি কিছু প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।