আগস্ট-অক্টোবরে মবের কারণে মৃতু্য ৬৮ :আসক

মব ভায়োলেন্স, সতর্ক পুলিশ

প্রকাশ | ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
দেশে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা গত কয়েক মাসে বেড়েছে। চলতি বছরের ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর দীর্ঘদিন বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হওয়ার দাবি করে সংঘবদ্ধ জনতার হামলা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনকি দেশ ছেড়ে পালাতে গিয়ে সীমান্তে ধরা পড়া অনেক রাজনৈতিক নেতাকর্মীর ওপরও চলছে এই 'মব ভায়োলেন্স'। এসব ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রে মৃতু্যর ঘটনাও ঘটেছে। আইন বিশ্লেষকরা বলছেন, এ প্রবণতা রোধ করতে ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে গত কয়েক মাসের তুলনায় মবে মৃতু্য কমে এসেছে উলেস্নখ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এরকম ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য মাঠ পুলিশকে সতর্ক থাকতে নানা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ২০২০ সালে রাজধানীর বাড্ডায় একটি স্কুলে মেয়ের ভর্তির বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে গণপিটুনিতে প্রাণ হারান তাসলিমা বেগম ওরফে রেণু। ছেলেধরা গুজব ছড়িয়ে আশপাশ থেকে কয়েকশ' মানুষ স্কুল প্রাঙ্গণে ঢুকে তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। 'উত্তেজিত জনতা'র (মব) আক্রোশের শিকার হয়ে এরকম মৃতু্যর খবর পত্রিকার পাতায় পাওয়া যায় প্রায়ই। তবে, গত কয়েক মাসে এই হার বেড়েছে। ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশে এই গণপিটুনি ও মবের কারণে মৃতু্যর ঘটনা আগেও ঘটেছে কিন্তু এবারের ঘটনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিত ভিন্ন। আগে কথিত চোর-ডাকাত, অপ্রীতিকর হয়রানির অভিযোগ এনে গণপিটুনি দেওয়ার ঘটনা বেশি দেখা গেলেও এবার মিশ্র কারণ উপস্থিত। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) গত তিন মাসের তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট থেকে অক্টোবর এই তিন মাসে মবের কারণে মৃতু্য ঘটেছে ৬৮ জনের। এর মধ্যে সেপ্টেম্বরে সবচেয়ে বেশি, ২৮ জন। এর আগে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মবে মৃতু্য ঘটেছে ৩২ জনের। এ বছর জুলাইয়ে কোনো মব নথিবদ্ধ হয়নি। এর আগে ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের তথ্য বলছে, সে বছর মবে ৫১ জনের মৃতু্য ঘটেছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ মৃতু্য ঢাকায়, ২৫ জন, তারপর চট্টগ্রামে ১৭ জন। রংপুরে কোনো মবের ঘটনা নথিবদ্ধ হয়নি। অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিশ্লেষণে গত তিন মাসের হিসাব বলছে, এই তিন মাসে একটি মাত্র গুমের ঘটনা ঘটেছে। রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ৩৫টি, যাতে আহত হয়েছেন ১ হাজার ৪২৪ জন। সাংবাদিক হয়রানির ঘটনা ঘটেছে ২৫৫টি। এদিকে শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ১২০, শিশু হত্যা ৮৬। এবং সেটাও সবচেয়ে বেশি ঘটেছে সেপ্টেম্বরে। চলতি নভেম্বরের ১৪ তারিখে অনুষ্ঠিত 'জুলাই গণঅভু্যত্থান, অন্তর্ভুক্তি এবং ন্যায়বিচার: জনপরিসরে গণতন্ত্র' শীর্ষক এক সেমিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা উলেস্নখ করেছেন, 'শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়ার পরবর্তী তিন মাস 'মবের মুলস্নুক মনে হয়েছে। এ সময়টাতে দেশের অধিকাংশ লোক নিজেদের মজলুম বলে অনুভব করছেন। অন্তর্র্বর্তী সরকারে যারা আছেন তারা চেষ্টা করছেন সংস্কার করার। তাই তাদের সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে এখনই মন্তব্য করা ঠিক হবে না।' আসক বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে নিহতের পরিসংখ্যান তৈরি করেছে। 'আমরা বলতে পারি না প্রকৃত সংখ্যা আসলে কত। কারণ শুরুতে থানায় নথিভুক্ত করার বিষয়ও ছিল না' উলেস্নখ করে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, 'আমার মনে হয় ওই সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় না থাকায় ঘটনাগুলো বেড়েছে। মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার সাহস করেছে এবং নিজেই বিচার করতে চেয়েছে।' তিনি বলেন, 'মব ভায়োলেন্স (দলবদ্ধ সহিংসতা) কেবল মৃতু্যর কারণ হচ্ছে তা নয়, এসময় সিদ্ধান্ত পরিবর্তনেরও কারণ হিসেবে আমরা দেখেছি। সেগুলো সুনির্দিষ্টভাবে বিশ্লেষণ করা জরুরি।' মব ভায়োলেন্স কমে আসছে উলেস্নখ করে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর সম্প্রতি একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, 'মব কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। আসামি যেই হোক সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে যেসব ঘটনা ঘটেছে, পুলিশ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি চট্টগ্রামের যে ঘটনা ঘটেছে সাম্প্রতিক সময়ে, আমরা পুলিশের পক্ষ থেকে ত্বরিত ব্যবস্থা নিয়েছি। এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে সেজন্য মাঠ পর্যায়ে প্যাট্রোল বাড়ানোসহ বেশকিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।' তিনি আরও বলেন, 'আমরা গণমাধ্যমের মাধ্যমে জনগণকে বার্তা দিতে চাই, যেখানে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হবে, আইন নিজের হাতে তুলে না নিয়ে আমাদের জানান, আমরা ত্বরিত ব্যবস্থা নেব। অপরাধী যেই হোক না কেন, আইনি প্রক্রিয়ায় তার বিচার সম্পাদন হতে হবে। আমরা নজরদারি বাড়িয়েছি। তাই গত কয়েক মাসের চেয়ে মব এখন কমতে শুরু করেছে।'