প্রযুক্তিগত সমন্বয়হীনতা ও দুর্বল মনিটরিংয়ের কারণে বন্ধ হচ্ছে না ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি। কালোবাজারি সিন্ডিকেটে জড়িত রেলওয়ে ও সহজ ডট কমের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা। তাদের কারণেই অনলাইনে চেষ্টা করেও অধিকাংশ সময়ই টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না। বেশি দামে কালোবাজারে হরহামেশাই মিলছে টিকিট। মোবাইল নম্বর ও জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে টিকিট কিনে নিচ্ছে সিন্ডিকেট। ট্রেনের চেকাররা অধিকাংশ সময়ই টিকিটের সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র মিলিয়ে দেখছেন না। এই সুযোগটিকেও কাজে লাগাচ্ছে টিকিট কালোবাজারিরা।
ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনে কথা হয় সায়েদুল ইসলাম নামের এক ছাত্রের সঙ্গে। তিনি রংপুরে অবস্থিত সরকারি কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। বাড়ি গাইবান্ধায়। পারিবারিক কাজে ১৫ দিন আগে ঢাকায় এসেছিলেন। তাকে স্টেশনের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে টিকিট কিনতে দেখা গেল। অথচ তার হাতে স্মার্ট মোবাইল ফোন। টিকিট কেনার পর কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিলে নানা প্রসঙ্গে কথা হয়। এক পর্যায়ে লাইনে দাঁড়িয়ে ট্রেনের টিকিট কেনার কারণ সম্পর্কে জানতে চাই।
তিনি একরাশ হতাশা প্রকাশ করে বলেন, তার মোবাইলে ট্রেনের অনলাইনে টিকিট কেনার অ্যাপস ডাউনলোড করা আছে। তিনি নিয়মিত ট্রেনে যাতায়াত করেন। ভাগ্য অত্যন্ত ভালো হলে অনেক সময় অনলাইনে টিকিট কিনতে পারি। তাও স্বাভাবিক সময়ে। ঈদের আগে বা পারে অনলাইনে টিকিট পাওয়া বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার।
অথচ রেল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, ট্রেনের টিকিট শতভাগ অনলাইনে বিক্রি করা হয়। এসব তথ্য ভুল বা মিথ্যা। তার জানা মতে, মাত্র ৩০ শতাংশ টিকিট অনলাইনে থাকে। আর বাকি ৭০ শতাংশ টিকিটই ম্যানুয়ালি বিক্রি হয়। যেটি আমরা বা আমাদের মতো সাধারণ মানুষ বুঝতেই পারি না। দুই প্রক্রিয়ায় টিকিট বিক্রির অধিকাংশই নিয়ন্ত্রণ করে টিকিট কালোবাজারি সিন্ডিকেট। যে কারণে অনলাইনে আবেদন করা মাত্রই দেখা যায়, টিকিট নেই।
এই শিক্ষার্থীর ভাষ্য, তিনি নিয়মিত ট্রেনে যাতায়াত করেন। শুধু তিনি নন, রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধসহ ওই এলাকার অধিকাংশ মানুষ ট্রেনে যাতায়াত করেন। কারণ তুলনামূলক অনেক সস্তায় যাতায়াত করা যায়। ট্রেনের অগ্রিম টিকিট ১০ দিন আগে ছাড়ে। তিনি আসার আগেও অনলাইনে চেষ্টা করেছেন, পাননি। তাই স্ট্যান্ডিং টিকিট কিনে ঢাকা এসেছিলেন।
তার ভাষ্য, অনলাইনে ট্রেনের টিকিট বিক্রি রীতিমতো তেলেসমাতি কারবার। অনলাইনে টিকিট ছাড়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই টিকিট শেষ হয়ে যায়। যেন টিকিট হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। যাওয়ার সময়ও একই অবস্থা। অনলাইনে টিকিট ছাড়ার পর থেকেই চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোনোভাবেই টিকিট সংগ্রহ করতে পারিনি। যে কারণে বাধ্য হয়ে স্টেশনে এসে স্ট্যান্ডিং টিকিট কিনতে হলো। অর্থাৎ যিনি স্ট্যান্ডিং টিকিট কিনবেন, নিয়মানুযায়ী থাকে গন্তব্য পর্যন্ত দাঁড়িয়ে যেতে হবে। তবে সিট যদি ফাঁকা থাকে সেটি ভিন্ন কথা। লাইনে দাঁড়িয়ে অনেককে টিকিট কিনতে দেখা গেল।
এ ব্যাপারে রেলস্টেশনের ভিআইপি গেটের পাশে রেল সেবা কাউন্টারে যোগাযোগ করা হলে ওই সময়ে দায়িত্বরত কর্মকর্তা ফাইজুল করিম যায়যায়দিনকে বলেন, ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি হওয়ার নূ্যনতম কোনো সুযোগ নেই। কারণ জাতীয় পরিচয়পত্র ও মোবাইল নম্বর দিয়ে ট্রেনের অনলাইনে টিকিট কেনার অ্যাপস ডাউনলোড করতে হয়। এরপর নিয়মানুযায়ী আবেদন করে টিকিট কিনতে হয়। এখন টিকিটের হার্ড কপি কেনার কোনো প্রয়োজন নেই। স্মার্ট ফোনেই টিকিটের কপি চলে যায়। স্টেশনে প্রবেশের সময় চেকাররা টিকিট চেক করেন। সেখানে টিকিট দেখাতে হয়। কারো হার্ড কপি বা কাগজে প্রিন্ট কপি থাকলেও চলে। আবার মোবাইলে টিকিটের ছবি দেখালেও চলে। প্রতিদিন একজন ব্যক্তি ৪টি টিকিট কিনতে পারেন। তবে দিনে একজন ব্যক্তি যেহেতু ২ বার টিকিট কিনতে পারবেন। সে হিসেবে মোট ৮টি টিকিট কিনতে পারেন। এর চেয়ে বেশি টিকিট কেনার কোনো সুযোগ নেই। টিকিট কেনার ক্ষেত্রে পরিচয়পত্র যাচাই করা আবশ্যক। তবে মোবাইল নম্বরের ক্ষেত্রে তেমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যদিও মোবাইল নম্বরটি বৈধ হওয়া আবশ্যক।
রেল সেবা নামের অ্যাপসটির মূল মালিক বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। যদিও অ্যাপসটি দীর্ঘদিন ধরেই পরিচালনা করে আসছে সহজ ডট কমের নামের একটি কোম্পানি। কোম্পানিটির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যায়যায়দিনকে বলেন, ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি অতীতেও ছিল, এখনও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। কারণ প্রযুক্তিগত সমন্বয়হীনতা এবং দুর্বল চেকিং ব্যবস্থার কারণে টিকিট কালোবাজারি রোধ করা সম্ভব নয়। এর সঙ্গে অনলাইনটির এবং রেলওয়ের টিকিট বিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা জড়িত। এদের সঙ্গে কালোবাজারি সিন্ডিকেটের বিশেষ যোগসূত্র আছে।
তিনি জানান, যারা টিকিট কালোবাজারি করে কিনেন, তারা বিভিন্ন মোবাইল নম্বর ব্যবহার করেন। কারণ নম্বরগুলো ভেরিফাই করা হয় না। কালোবাজারিরা এই সুযোগটিকেই বেশি কাজে লাগায়। তারা বিভিন্ন মোবাইল নম্বর দিয়ে অনলাইনে টিকিট ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবেদন করে। অনেক সময় রেলওয়ে অসাধু কর্মকর্তারা কালোবাজারি সিন্ডিকেটের সদস্যরা যেসব মোবাইল নম্বরে আবেদন করে, সেসব নম্বরের বিপরীতে টিকিট ইসু্য করে দেন। আর কালোবাজারি সিন্ডিকেটের সদস্যরা কোন কোন মোবাইল নম্বর থেকে টিকিট কেনার আবেদন করবে, তা আগ থেকেই জানেন টিকিট বিক্রির সঙ্গে জড়িতরা। তারা কালোবাজারি সিন্ডিকেটের মোবাইল নম্বরের বিপরীতে টিকিট ইসু্য করে দেন। আর সাধারণ মানুষ যেসব নম্বর থেকে আবেদন করেন, তা গ্রহণ করেন না।
ওই কর্মকর্তা জানান, কালোবাজারিদের মোবাইল নম্বরের বিপরীতে অনেক সময় অসাধু কর্মকর্তারা অনলাইনে থাকা প্রায় শতভাগ টিকিট ইসু্য করে থাকেন। এরপর যখন কোনো ক্রেতা আবেদন করেন, তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে কম্পিউটার সিস্টেমের মাধ্যমে আবেদনকারীকে টিকিট নেই বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। যেটি আসলে সাধারণ মানুষ বা সাধারণ টিকিট ক্রেতা বুঝতে পারেন না। তারা মনে করেন চাহিদা বেশি থাকায় টিকিট আগেই বিক্রি হয়ে গেছে। এসব টিকিই দ্বিগুণ বা কোনো কোনো সময় তিনগুণ বেশি দামে কালোবাজারে বিক্রি হয়।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আরও জানান, সারা বছরই টিকিট কালোবাজারে বিক্রি হয়। তবে ঈদের সময় কালোবাজারি সিন্ডিকেটের তৎপরতা সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে কোরবানির ঈদে। লাভের অংশ পুরো সিন্ডিকেটের সদস্যরা পদ পদবি অনুযায়ী ভাগ করে নেয়।
ওই কর্মকর্তা জানান, নিয়মানুযায়ী অনলাইনে আবেদন করলে, যিনি আবেদন করবেন বা যার মোবাইল নম্বর বা জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে আবেদন করা হয়, টিকিটগুলো ওই নামেই ইসু্য করা হয়। জন্ম নিবন্ধন দিয়ে টিকিট ইসু্য করার কোনো সিস্টেম নেই। যদিও বাংলাদেশ রেলওয়ের ওয়েবসাইটে জন্ম নিবন্ধনের বিপরীতে টিকিট কেনার সুযোগ রাখা হয়েছে। এমনকি ভ্রমণের সময় জাতীয় পরিচয়পত্র বহন করা বাধ্যতামূলক। যাদের নেই তাদের জন্ম নিবন্ধনের সত্যায়িত অনুলিপি বহন করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, কাগজে-কলমে থাকলেও যেসব শিশু বা কিশোর বা যুবকের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, তারা তাদের পিতা-মাতার ভোটার আইডি কার্ড দিয়ে আবেদন করে টিকিট সংগ্রহ করবে। আবার যাদের পিতা-মাতা নেই, তারা ভাই বা বোনের জাতীয় পরিচয়পত্র ও মোবাইল নম্বর দিয়ে আবেদন করে টিকিট সংগ্রহ করতে পারেন।
তিনি আরও জানান, তবে যার কেউই নেই এমনকি জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, তার ক্ষেত্রে অনলাইনে আবেদন করে টিকিট পাওয়া কঠিন। শুধুমাত্র বৈধ মোবাইল নম্বর দিয়ে তিনি আবেদন করে টিকিট করতে পারেন। ঠিক এই সুযোগটিকেই কাজে লাগায় কালোবাজারি সিন্ডিকেট। এক্ষেত্রে নিয়মানুয়ী তার শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্রের কপি চাওয়া হয়। না থাকলে শেষ ভরসা বৈধ মোবাইল নম্বর।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, ট্রেনের টিকিট কেনার ক্ষেত্রে বহু ফাঁক-ফোকর রয়েছে। মূলত যার পরিচয়পত্রের বিপরীতে টিকিট ইসু্য করা হয়, নিয়মানুযায়ী তারই ভ্রমণ করার কথা। এমনকি তার নামে টিকিট কিনে অন্য কেউ ভ্রমণ করলে, ভ্রমণকারী যার নামে টিকিট কিনেছেন, তিনিই বলে বিবেচিত হবেন। জাতীয় পরিচয়পত্র ও মোবাইল নম্বর কোনো সময়ই রেল বা সহজ ডট কম কর্তৃপক্ষ যাচাই বাছাই করতে যায় না। মূলত ট্রেনে যখন টিকিট চেকিং করা হয়, তখন চেকারের উচিত ভ্রমণকারীর সঙ্গে টিকিটের নামের সঙ্গে জাতীয় পরিপয়পত্র বা জন্ম নিবন্ধনসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় দলিলাদির মিল আছে কিনা তা যাচাই করা। সময় বাঁচানোর জন্য চেকাররা তা করেন না। অনেক সময় ভিড়ের কারণে চেকারদের পক্ষে শতভাগ নিরপেক্ষতার সঙ্গে চেকিং করা সম্ভব হয় না।
তিনি জানান, শুধুমাত্র কোনো পুরুষ যদি নারীর নামে টিকিট কিনে ভ্রমণ করেন, তখন চেকাররা ভ্রমণকারী বা ভ্রমণকারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এক্ষেত্রে ভ্রমণকারী কালোবাজার থেকে টিকিট কিনেলেও বলে থাকেন, তিনি তার আত্মীয়র নামে টিকিট কিনেছেন। অথবা যার নামে টিকিটটি কেনা তিনি তার আত্মীয়। এমনটাই বলে থাকেন। যে কারণে চেকারের পক্ষে তা আর শনাক্ত করা সম্ভব হয় না।
চেকারের মূল কাজই হচ্ছে, বিনা টিকিটে কেউ ভ্রমণ করছেন কিনা, তা নিশ্চিত হওয়া। এটি রেল কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা। অন্যান্য নির্দেশনা থাকলেও তা চেকাররা নানা অজুহাতে পালন করেন না। কার টিকেট কে নিয়ে ভ্রমণ করছেন, তা নিয়ে নূ্যনতম মাথা ঘামান না চেকাররা।
এমন সুযোগে কালোবাজারি সিন্ডিকেটের সদস্যরা তার ও তার মা-বাবা, ভাই, বোন, স্ত্রীদের নামে টিকিট কিনেন। সেইসব টিকিটই বেশি দামে কালোবাজারে বিক্রি হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা জানান, বেনামে টিকিট নিয়ে ভ্রমণের ক্ষেত্রে অনেক বিড়ম্বনা আছে। বিশেষ করে কোনো দুর্ঘটনায় কারো মৃতু্য হলে তাদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। সাধারণত টিকিটের গায়ে যে নাম ও মোবাইল নম্বর থাকে, সেই নম্বরে ট্রেন বা যাত্রীরা বা চেকাররা ফোন করে বিষয়টি ঘটনার বিষয়ে জানান। হতাহত ব্যক্তিদের সম্পর্কে বর্ণনা দেন। সাধারণত এভাবেই হতাহতদের শনাক্ত করা হয়।
তবে যদি এমন হয় যে, কোন কারণে ভ্রমণকারী আহত বা নিহত হন এবং তার সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোন, ট্রেনের টিকিট খুঁজে পাওয়া না যায়, তাহলে তাদের পরিচয় শনাক্ত করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। এজন্য অনেক সময় ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহতদের শনাক্ত করতে ডিএনএ নমুনা পর্যন্ত রেখে দেওয়া হয়। যদিও খুব কমই ঘটে এমন ঘটনা। এসব ক্ষেত্রে কারো লাশ অজ্ঞাত হিসেবে দাফন হওয়াও বিচিত্র কিছুই না। যদিও এমন ঘটনা ঘটার কোনো নজির নেই।
ট্রেনের টিকিট কালোবাজারির বিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশের (রেলওয়ে) ঢাকা বিভাগের পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি বন্ধ করতে হলে অবশ্যই প্রযুক্তিগত সমন্বয় প্রয়োজন। কারণ যে জাতীয় পরিচয়পত্র বা মোবাইল নম্বর দিয়ে টিকিট কেনা হয়, তা যাচাই-বাছাই করা হয় না। অন্যের পরিচয়পত্র বা মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে কোনো অসাধু ব্যক্তি ট্রেনের টিকিট কিনছেন কিনা, তার প্রযুক্তিগতভাবে যাচাই-বাছাই করা হয় না বা তেমন কোনো প্রযুক্তিগত সুযোগও নেই। এমন দুর্বলতাকে কাজে লাগায় কালোবাজারি সিন্ডিকেট। এর মধ্যে মোবাইল নম্বর যাচাই-বাছাইও না করার সুযোগটিকেই সবচেয়ে বেশি কাজে লাগায় কালোবাজারি চক্র। এর সঙ্গে ট্রেন সেবা পরিচালনাকারী সহজ ডট কম ও রেলওয়ে বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তারাও জড়িত।
তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি কালোবাজারে বিক্রির সময় ৭০টি টিকিটসহ কমলাপুর থেকে কালোবাজারি সিন্ডিকেটের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যাদের একজন রেলওয়ের টিকিট বিভাগে কর্মরত ছিলেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে, মূলত মোবাইল নম্বর দিয়েই কালোবাজারে বিক্রির জন্য টিকিট সংগ্রহ করত তারা। টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে রেলওয়ের টিকিট বিভাগ ও সহজ ডট কম নামের অনলাইনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা জড়িত। তাদের যোগসাজশেই দীর্ঘ দিন ধরেই ট্রেনের টিকিট কালোবাজারে বিক্রি হয়ে আসছে। যে কারণে অতীতেও ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি হত। বর্তমানেও হচ্ছে। এমনকি ভবিষ্যতেও হবে তা প্রায় অনেকটাই নিশ্চিত করেই বলা যায়। কারণ সার্বিক সমন্বয় ছাড়া কোনোভাবেই ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি বন্ধ করা সম্ভব না। টিকিট কালোবাজারি বন্ধ করতে পুলিশের পাশাপাশি অন্যান্য সংস্থাও সাইবার মনিটরিং করে যাচ্ছে।
র্
যাবের গোয়েন্দা শাখা সূত্রে জানা গেছে, ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি বন্ধে দীর্ঘ ধরেই চেষ্টা অব্যাহত আছে। তারই ধারাবাহিকতায় গত বছরের ৮ ফেব্রম্নয়ারির্ যাব-৩ ঢাকার কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলস্টেশন এলাকা থেকে রেলের টিকিট কালোবাজারিতে জড়িত চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। যার মধ্যে ছিল চক্রের মূলহোতা উত্তম দাশ (৩২), তার সহযোগী ইলিয়াস (৫৯), শাহ আলম (৩৪) ও খোকন মিয়া (৫৫)। তাদের কাছে ৫৬টি আসনের ৪২টি কালোবাজারি টিকিট, টিকিট কালোবাজারির কাজে ব্যবহৃত মোবাইল ও টিকিট বিক্রির দেড় হাজার টাকা পাওয়া গিয়েছিল। বর্তমানে তারা জামিনে মুক্ত।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চক্রটির পুরো দেশে নেটওয়ার্ক আছে। সারাদেশের ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি চক্র নিয়ন্ত্রণ করে তারা। চক্রের সদস্যরা মোবাইল নম্বর ও জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে অনলাইনে ও ম্যানুয়ালি ট্রেনের টিকিট সংগ্রহ করে। চক্রটির বেশ কয়েকটি ইউনিট আছে। প্রতি ইউনিটের সদস্য সংখ্যা ৭ থেকে ৮ জন। চক্রটি রেলস্টেশনের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ২০১৮ সাল থেকে টিকিট কালোবাজারির ব্যবসা করে আসছে। উত্তম দাশ বহুবার গ্রেপ্তার হলেও জামিনে বেরিয়ে আবারও একই কাজ করছে বলে জানা গেছে। গ্রেপ্তার হওয়া চক্রটির বিরুদ্ধে ৭টি মামলা আছে।
বাহিনীটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মুনিম তকি যায়যায়দিনকে বলেন, অনলাইনে কারসাজির মাধ্যমে বেআইনিভাবে টিকিট বিক্রির দায়ে প্রতিষ্ঠানটির বেশ কয়েক জন ইতোপূর্বে গ্রেপ্তার হয়েছিল। সামনে স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হচ্ছে। স্বাভাবিক কারণেই অনেকেই গ্রামের বাড়িতে যাবেন। বিশেষ করে নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে অনেকেই ট্রেনে ভ্রমণ করে থাকেন। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে অনলাইন নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান ও রেল বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিষয়েও খোঁজ-খবর রাখা হচ্ছে। ট্রেনের টিকিট যাতে কালোবাজারি চক্রের হাতে না যেতে পারে এজন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে সাইবার মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারিও।
এসব বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা বিভাগের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আরিফের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি বন্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। কোনোভাবেই যাতে টিকিট কালোবাজারি না হয়, এজন্য সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। তাদের সমন্বয়ে বিভিন্ন সময় অভিযান চালানো হচ্ছে। অভিযানে টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে জড়িতরা গ্রেপ্তারও হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সামনের দিনগুলোতে, বিশেষ করে রোজা ও ঈদকে সামনে রোজা মনিটরিং ও ট্রেনের ভেতরে টিকিট চেকিং ব্যবস্থা আরও জোরদার করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া রেল সেবা অ্যাপসটি বাংলাদেশ রেলওয়ের নিজস্ব অ্যাপস। তবে অ্যাপসটি পরিচালনার জন্য সহজ ডট কম নামের একটি অনলাইন কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এজন্য কোম্পানিটি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে টিকিট প্রতি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা কমিশন হিসেবে পেয়ে থাকে। কোম্পানির বিরুদ্ধে অনিয়ম বা কালোবাজারে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠলে অবশ্যই আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। প্রয়োজনে তাদের লিজ বাতিল করা হবে। বর্তমানে ট্রেনের টিকিট শতভাগ অনলাইনে বিক্রি করা হচ্ছে। তবে কাউন্টার থেকেও টিকিট কেনার সুযোগ রাখা হয়েছে। কারণ অনেকেই স্মার্টফোন ব্যবহার করেন না। এমনকি কীভাবে টিকিট অনলাইনে কিনতে হয়, তা জানেন না। তাদের সুবিধার্থেই কাউন্টারেও টিকিট বিক্রি অব্যাহত রাখা হয়েছে।