শুল্ক ফাঁকি দিয়ে দেশ-বিদেশি সিগারেটের ব্যবসা পুরনো হলেও গত কয়েক মাসে এর পরিধি কয়েকগুণ বেড়েছে। আগে তা রাজধানীর নির্দিষ্ট কিছু পয়েন্টে ও দোকানে বিক্রি হলেও এখন বিক্রি হচ্ছে প্রায় সবখানেই। প্রচলিত সিগারেটের তুলনায় দামে কম মানে ভালো হওয়ায় বেড়েছে এর চাহিদাও। আর শুল্ক ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে আসা এসব সিগারেটে বছরের অন্তত কয়েক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
এদিকে প্রকাশ্যে অবৈধভাবে আসা এসব সিগারেট বিক্রি হলেও কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোকে। অন্যদিকে দেশে ঢোকা এসব সিগারেটের মাত্র ৫-১০ শতাংশ ধরা পড়ছে কাস্টমসের হাতে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও এর প্রভাবে নিয়ন্ত্রণকারী বিভিন্ন সংস্থার কর্ম তৎপরতা পর্যাপ্ত না থাকায় বাজারে এসব সিগারেটের ব্যবসা অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এমনকি এর প্রভাবে বৈধ সিগারেটের ব্যবসায় পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব।
বিক্রেতারা বলছেন, আগের এসব সিগারেটের সরবরাহ নিয়মিত ছিল না তাই ক্রেতাও ছিল কম। কিন্তু এখন নিয়মিত সরবরাহ থাকায় ক্রেতা বেড়েছে কয়েকগুণ। অন্যদিকে কম দামের কারণে এই তামাক পণ্যের ব্যবহার ও ব্যবহারের প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। যা দেশে তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার কমানোর যে লক্ষ্যমাত্রা, তা বাস্তবায়ন অসম্ভব করে তুলছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমনিতে অন্যান্য দেশের তুলানায় বাংলাদেশের সিগারেটের দাম অনেক কম। ফলে ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েইে চলছে। দেখা গেছে গত ৫ বছর যে হারে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে সে তুলনায় সিগারেটের দাম বাড়েনি। এ অবস্থায় বিদেশি সিগারেটের বাহারি ব্যবসা আশঙ্কাজনক হারে বাড়িয়ে তুলছে। নারী থেকে শুরু করে স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের তামাক গ্রহণে আকৃষ্ট করছে। যা ভবিষৎ জনস্বাস্থ্য বড় হুমকির মুখে ফেলবে।
মূলত দেশের রাজস্ব আয়ের বড় একটি অংশই আসে সরাসরি সিগারেট কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে। তাই এই আয় ধরে রাখতে সিগারেটের দাম অন্যদেশের তুলনায় তেমন একটা বাড়েনি। এমনকি প্রতিবছর
বাজেটের আগে তীব্র সমালোচনা ও বিভিন্ন মহলের দাবি সত্ত্বেও সিগারেটের দাম খুব একটা বাড়ানো হয় না অথচ প্রকাশ্যে রাজধানীসহ সারাদেশে অবৈধ এসব সিগারেটে কোটি টাকার বাণিজ্য চলছে।
জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি হলেও গত অর্থবছরে এই খাত থেকে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছে, যা মোট রাজস্বের প্রায় ১২ শতাংশ। দেখা গেছে সিগারেট রাজস্ব আয়ের অন্যতম উৎস হওয়ায় তামাকপণ্য নিয়ন্ত্রণে ক্ষেত্রে কিছু ছাড় দিয়ে থাকে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার সিগারেট বিক্রেতারা জানান, আগে ৫-১০ শতাংশ মানুষ এসব বিদেশি সিগারেট কিনলেও এখন এই সংখ্যা ২৫-৩০ শতাংশে পৌঁছেছে। এমনকি যারা ধূমপান ছেড়ে দিয়েছিলেন তারাও এখন কম নিকটিনের বিভিন্ন বিদেশি সিগারেট কিনছেন। এ ছাড়া নারী ধূমপায়ীদের প্রায় ৮০ শতাংশই এসব সিগারেটের ক্রেতা। এমনকি স্কুল শিক্ষার্থীরা (ছেলে-মেয়ে উভয়ই) বাসায় ফেরার সময় সিগারেটের প্যাকেট কিনে নিয়ে যান।
মূলত বিদেশি সিগারেট আমদানিতে শুল্ক-কর প্রায় ৬০০ শতাংশ। দেখা গেছ এই সিগারেট বৈধ পথে আমদানি করা হলে ২০ শলকার ওরিসের প্যাকেটের দাম পড়বে ৮০০ টাকা। কিন্তু এই সিগারেট টং দোকানে বিক্রি হচ্ছে প্রতি প্যাকেট মাত্র ১৭০-১৮০ টাকার মধ্যে। যার পাইকারি মূল্য মাত্র ১৪০-১৫০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি প্যাকেটে খুচরা বিক্রেতার ব্যবসা ২০ টাকার বেশি।
শুধু ওরিস নয়, শুল্ককর না দিয়েই ইউরোপ-মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সিগারেট অবাধে বিক্রি হচ্ছে দেশের বাজারে। এসসে, মন্ড, ডানহিল ও ট্রিপল ফাইভের মতো বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো এখন দেশে বাজারে বেশ জনপ্রিয়। প্রতিদিন রাজধানীতেই এসব সিগারেটে লাখ টাকার বেচা-কেনা হলে এনবিআরের কাছে এর রেকর্ড নেই, কারণ এগুলো অবৈধ পথে এসেছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের তথ্যমতে, কেবল কূটনীতিকদের ব্যবহারের জন্য কূটনৈতিক বন্ডের মাধ্যমে কিছু বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। তবে বাণিজ্যিকভাবে এসব সিগারেট আমদানির কোনো রেকর্ড নেই। তবে সিনথেটিক ফাইবার, সুইট কর্ন, অথবা শিল্পের অন্য কাঁচামালের কনটেইনারের আড়ালে এবং দেশে আসা ফ্লাইটের যাত্রীদের ব্যাগেজে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে দেশের বাজারে প্রবেশ করছে অবৈধ এসব সিগারেট।
এনবিআরের তথ্যমতে, সরকারের মোট রাজস্বের ১২ শতাংশই আসে তামাক খাত থেকে, তাই এই খাতে শুল্ক ও কর ফাঁকির যেকোনো ঘটনায় কাস্টমসের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ। মাঝেমধ্যেই তারা চোরাচালান ও মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে আনা বিদেশি সিগারেটের চালানও আটক করা হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে পরিমাণ সিগারেট অবৈধপথে দেশে আসে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে সামান্যই ধরা পড়ে।
২০২৪ সালের অক্সফোর্ড ইকোনমিক্সের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে অবৈধ সিগারেটের ব্যবহার বা ভোগের পরিমাণ ২০১৫-১৬ অর্থবছরের চেয়ে পাঁচগুণ বেড়েছে। এর ফলে সরকারের রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। ২০১৫-১৫ অর্থবছরে অবৈধ সিগারেটের বাজার অংশীদারত্ব এক শতাংশের কম থাকলেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে ৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। তবে চলতি বছর বিশেষ করে গত কয়েক মাসে এই হার ৩-৪ গুণ বেড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড- এনবিআরের সাবেক সদস্য মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, দেশে যে পরিমাণ অবৈধ সিগারেট মিস ডিক্লারেশনে (মিথ্যা ঘোষণায়) আসছে, এর খুবই সামান্যই ধরা পড়ছে। মূলত আমদানিকারক, তার সিএন্ডএফ এজেন্ট, বন্দরের দায়িত্বে থাকা লোকজন এবং কাস্টমসের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজসে এটা হচ্ছে। তিনি বলেন, সিগারেট আমদানির ক্ষেত্রে যে পরিমাণ শুল্ককর, এতে বৈধভাবে আনার সুযোগ কম। এ কারণেই অবৈধভাবে আসছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওরিস, এসসে, মন্ড, ডানহিল ও ট্রিপল ফাইভ ব্র্যান্ডের সিগারেট দেশে উৎপাদনের অনুমোদন নেয়নি কোনো কোম্পানি। ফলে এগুলো বৈধভাবে তৈরির সুযোগ নেই। কিন্তু, সময় সময় চালান আটকের ঘটনা সত্ত্বেও এসব সিগারেট দেদারসে বিক্রি হচ্ছে। বিশেষ করে স্স্নিম সিগারেটের উচ্চ চাহিদার কারণে এসব সিগারেট ব্যাপকভাবে দেশে আসছে।
এদিকে বিদেশি সিগারেটের প্রভাবে কমেছে বৈধ সিগারেটের ব্যবসা। এনবিআরের তথ্য বলছে, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত আট মাসে স্থানীয় কোম্পানিগুলোর প্রিমিয়াম ও হাই সেগমেন্টের সিগারেট বিক্রি কমেছে যথাক্রমে ২২ ও ১৯ শতাংশ। এর অন্যতম কারণ, বিদেশি সিগারেটের সহজলভ্যতা। যা চলিত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের কয়েকগুণ বেড়েছে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মূলত চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক চক্রের মাধ্যমেই দেশের বাজারে এই সিগারেট প্রবেশ করছে। এনবিআর সূত্র বলছে, চট্টগ্রামভিত্তিক একটি সংঘবদ্ধ চক্র বিদেশি সিগারেট এবং ব্যান্ডরোল আমদানি করছে। অভিযোগ রয়েছে, এই চক্রে কাস্টমসের কিছু কর্মকর্তাও জড়িত রয়েছে। এনবিআরের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলের (সিআইসি) এবং কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর (সিআইআইডি) এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের অবৈধ সিগারেট বাণিজ্যের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে চট্টগ্রামভিত্তিক কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
রাজস্ব বিভাগ ও দেশের কাস্টমস গোয়েন্দা সূত্রগুলোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে অবৈধভাবে আমদানি করা সিগারেট আটকের পর করা ফৌজদারি মামলাগুলোর একটিরও বিচারকাজ শেষ হয়নি। অন্যদিকে দেশের এয়ারপোর্টগুলোতে অবৈধ সিগারেট নিয়ে ধরা পড়া যাত্রীদেরও অবৈধ সিগারেটের জন্য মামলার মুখোমুখি হতে হয় না। সিগারেটের কার্টন রেখে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয় বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।