আজও পথে নামবেন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা

ক্ষোভে উত্তাল দয়াগঞ্জ-মিরপুর

'দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত সড়ক অবরোধ করে রাখায় দয়াগঞ্জ এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। যার প্রভাবে আশপাশের সড়কেও যানবাহনের দীর্ঘ সারি জমে ওঠে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ওই এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়'

প্রকাশ | ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
ঢাকা মহানগর এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের উদ্যোগের প্রতিবাদে বুধবার দয়াগঞ্জ মোড়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখান চালকরা -নাজমুল ইসলাম
ঢাকা মহানগর এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশের প্রতিবাদে বুধবার দুপুরে রাজধানীর দয়াগঞ্জ ও মিরপুরে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন বিক্ষুব্ধ চালকরা। এ সময় যাত্রাবাড়ীর দয়াগঞ্জে পুলিশ অবরোধকারীদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে দু'পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর পুরান ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকা থেকে বিপুল সংখ্যক ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক সেখানে জড়ো হলে গোটা এলাকা ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে। যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সড়কজুড়ে সৃষ্টি হয় ব্যাপক যানজট। সংঘর্ষ চলাকালে আন্দোলনকারীদের হামলায় দুই পুলিশ সদস্য আহত হন। এদিকে মিরপুরে কোনো সংঘর্ষের ঘটনা না ঘটলেও ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা দীর্ঘ সময় কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়ার মধ্যবর্তী এলাকার দীর্ঘ সড়ক অবরোধ করে রাখায় সেখানে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। ফলে ওই সড়ক ব্যবহারকারী যানবাহন চালকরা চরম ভোগান্তিতে পড়ে। বিকালের পিকআওয়ারে সেখানকার যানজট সামাল দিতে ট্রাফিক পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়। মিরপুরের ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা বৃহস্পতিবারও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আগাম ঘোষণা দিয়েছে। তারা জানান, বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার দিকে আগারগাঁও নির্বাচন কমিশনের সামনে থেকে মিছিল নিয়ে তারা মিরপুর ১০ নম্বর গোল চক্করে যাবেন। পরবর্তীতে সেখানে কর্মসূচি পালন করবেন তারা। যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ফারুক আহম্মেদ জানান, মূল সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানোর দাবিতে দয়াগঞ্জ মোড়ে অবরোধ করেন রিকশাচালকরা। সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হলে তাদের অনুরোধ করা হয় সড়ক ছেড়ে দেওয়ার জন্য। তবে তারা পুলিশের অনুরোধ না শুনে উল্টো পুলিশের ওপর আক্রমণ চালায়। এতে দুই পুলিশ সদস্য আহত হন। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ওসি বলেন, দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত সড়ক অবরোধ করে রাখায় গোটা এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। যার প্রভাবে আশপাশের সড়কেও যানবাহনের দীর্ঘ সারি জমে ওঠে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ওই এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। তবে রিকশাচালকদের দাবি, তারা শান্তিপূর্ণভাবে দয়াগঞ্জ মোড়ে আন্দোলন করছিলেন। এ সময় পুলিশ তাদের সেখান থেকে সরিয়ে দিতে বলপ্রয়োগ করে। এতে তাদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পুলিশ তাদের ওপর চড়াও হলেও তারা কোনো ধরনের হামলা করেনি। এদিকে ঢাকা মহানগর এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধের নির্দেশের প্রতিবাদে রাজধানীর মিরপুরের কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়া এলাকার মধ্যবর্তী স্থানে সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করেন চালকরা। এতে ওই এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। স্থানীয়রা জানান, দুপুর থেকে চালকরা প্রায় কয়েক ঘণ্টা রাস্তা অবরোধ করার আন্দোলন করেন। এতে আগারগাঁও থেকে মিরপুর ১০ নম্বর পর্যন্ত রাস্তার দু'পাশে যানবাহনের দীর্ঘ সারি জমে ওঠে। বিকাল ৪টার আগে রিকশাচালকরা সড়ক থেকে অবরোধ তুলে নিলেও এর রেশ দীর্ঘ সময় রয়ে যায়। ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক মো. রাজু বলেন, 'মঙ্গলবার কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পর টেলিভিশনের খবরে দেখতে পাই আমাদের বাহন বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। আমরা অন্তর্র্বর্তী সরকারকে বলতে চাই, আমাদের রিকশা বন্ধ করেন আপত্তি নাই। তবে আমাদের সময় দিতে হবে। আমাদের রিকশার কিস্তি আছে। সেটি পূরণের জন্য আমাদের সময় দিতে হবে।' তিনি আরও বলেন, 'আমাদের এ তিন দিন আন্দোলন করতেই চলে যাবে। তাই মালিকপক্ষ যারা আছেন তাদের কাছে অনুরোধ, আপনারা কেউ এই তিন দিন কোনো টাকা রাখবেন না।' বুধবার দুপুরে ট্রাফিক মিরপুর বিভাগের ফেসবুক পেজে এক পোস্টে বলা হয়, কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়ার মধ্যবর্তী এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের আন্দোলনের জন্য 'আগারগাঁও-মিরপুর ১০' রুটে যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। টিম ট্রাফিক মিরপুর বিভাগ 'ডিসি ট্রাফিক মিরপুর' স্যারের নির্দেশে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করছে। বিকাল ৪টায় ট্রাফিক-মিরপুর বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) ইয়াসিনা ফেরদৌস বলেন, 'আন্দোলনরত রিকশাচালকরা চলে গেছে। তবে তারা কয়েক ঘণ্টা রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন করেছিল। ফলে পুরো এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়েছে, যার রেশ এখনো রয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আমরা কাজ করছি।' গত মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর এলাকায় তিন দিনের মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি মাহমুদুর রাজীবের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। স্বরাষ্ট্র সচিব, স্থানীয় সরকার সচিব, আইজিপি, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের আদালতের এ আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। প্যাডেলচালিত রিকশা সংগঠন ঢাকা মহানগর রিকশা মালিক ঐক্যজোটের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক রিট পিটিশনটি দায়ের করেন। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার এইচ এম সানজিদ সিদ্দিকী ও ব্যারিস্টার তাহসিনা তাসনিম মৃদু। বৃহত্তর ঢাকা সিটি করপোরেশন প্যাডেলচালিত রিকশা মালিক ঐক্যজোটের সভাপতি জহুরুল ইসলাম মাসুম ও সাধারণ সম্পাদক মো. মমিন আলী এ বিষয়ে রিট দায়ের করেন। এদিকে ব্যাটারিচালিত যানবাহন বন্ধে হাইকোর্টের আদেশ প্রত্যাহারের দাবি করেছে রিকশা-ভ্যান-ইজিবাইক শ্রমিক ইউনিয়ন। বুধবার সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি শাহাদাৎ খাঁ ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস এক বিবৃতিতে এ দাবি করেন। বিবৃতিতে তারা বলেন, হাইকোর্টের এই আদেশ দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও মানবিক বোধবিবর্জিত। আমরা ধারণা করি মহামান্য আদালতকে ব্যাটারিচালিত যানবাহন সম্পর্কে সঠিক বাস্তবতা ও পরিস্থিতি অবগত না করায় আদালত ব্যাটারিচালিত যানবাহন বন্ধের মতো আদেশ দিয়েছেন। ব্যাটারিচালিত যানবাহন বন্ধে হাইকোর্টের এই আদেশ বাস্তবায়িত হলে ঢাকা মহানগরীতে ১২ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে, যা দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে। নেতারা আরও বলেন, হাইকোর্টের এই আদেশের প্রেক্ষিতে মামলার বিবাদীপক্ষ সরকারের পক্ষ থেকে দ্রম্নত আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল করতে হবে। এবং মহামান্য হাইকোর্টকে ব্যাটারিচালিত যানবাহন সম্পর্কে সঠিক বাস্তবতা ও পরিস্থিতি অবগত করতে হবে। ব্যাটারিচালিত যানবাহনের কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যার সমাধান হিসেবে আমরা অবিলম্বে ব্যাটারিচালিত যানবাহন বন্ধে হাইকোর্টের আদেশ প্রত্যাহার ও বিআরটিএ কর্তৃক লাইসেন্স এবং যৌক্তিক রুটপারমিট প্রদানের আহ্বান জানাচ্ছি। এদিকে রাজধানীর সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধে রাস্তায় নামতে পারেন পায়ে চালিত রিকশার চালকরা। বৃহত্তর ঢাকা সিটি করপোরেশন রিকশা মালিক ঐক্যজোটের ব্যানারে তারা আন্দোলনে নামবেন এমন আভাস পাওয়া গেছে। পায়ে চালিত রিকশাচালকরা জানান, ব্যাটারিচালিত রিকশার দাপটে তাদের রোজগার কমে গেছে। ব্যাটারিচালিত রিকশা শুধু অলিগলিতে চলার কথা থাকলেও তারা এখন নির্বিঘ্নে প্রধান সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা ৪০ টাকার ভাড়া ৩০ টাকা কিংবা তার চেয়েও কম নিচ্ছে। এতে পায়ে চালিত রিকশা ট্রিপ কম গেছে। ঢাকা সিটি করপোরেশন রিকশা মালিক ঐক্যজোটের সাধারণ সম্পাদক মো. মমিন আলী সাংবাদিকদের বলেন, পায়ে চালিত রিকশকার চালকরা তাদের দাবিগুলো জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন। দাবি না মানলে বৃহত্তর আন্দোলনে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন চালকরা। মমিন আলী বলেন, 'আমরা এক লাখ ৪৩ হাজার লাইসেন্সধারী বৈধ রিকশার মালিক। আমরা সরকারকে ট্যাক্স দিই। কিন্তু আমাদের দাবি পূরণে এখনও কোনো আশ্বাস পাইনি। দাবি মানা না হলে আগামীতে বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দিতে বাধ্য হবো।' গত মে মাসে ঢাকার সড়কে ব্যাটারিচালিত কোনো রিকশা চলাচল করতে পারবে না বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন সাবেক সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বিদু্যৎচালিত তিন চাকার যানগুলো অটো, ইজিবাইকসহ নানা নামে পরিচিত। দুর্ঘটনার জন্য সড়কে মোটরবাইক এবং ইজিবাইকের চলাচলকে দায়ী করেন তিনি। সে সময় ঢাকার সাবেক দুই মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস এবং আতিকুল ইসলামও শহরের মধ্যে এসব ব্যাটারিচালিত যানবাহন চলাচল বন্ধের বিষয়ে তাদের সম্মতি জানিয়েছিলেন। পরে ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ঢাকায় সড়ক অবরোধ করেন চালকরা ও গ্যারেজ মালিকরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংক্ষুব্ধ চালকদের সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটে। পরে 'জীবিকার' বিষয়টি বিবেচনায় এনে ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করবে পারবে বলে ঘোষণা দেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রসঙ্গত, বর্তমানে প্রায় ১৩ লাখ রিকশা চলাচল করছে রাজধানীতে। যার বড় একটি অংশ ব্যাটারিচালিত। পুরাতন প্যাডেলচালিত অনেক রিকশায় ব্যাটারি লাগিয়ে যান্ত্রিক করা হচ্ছে। রাজধানীর মূল সড়কের চেয়ে অলিগলিতে ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল বেশি। সুযোগ পেলে মূল সড়কও দাপিয়ে বেড়ায় এসব রিকশা। রাজধানীর খিলগাঁও, মান্ডা, বাসাবো, মানিকনগর, রামপুরা, বাড্ডা, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, সবুজবাগ, শ্যামপুর, ডেমরা, মোহাম্মদপুর, বছিলা, উত্তরা, ভাটারা, দক্ষিণখান, উত্তরখান, ময়নারটেক, মিরপুর, পলস্নবী এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা বেশি। এসব এলাকা ছাড়াও রাজধানীর প্রায় সর্বত্র ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল রয়েছে। ফলে নিয়মিত ঘটছে দুর্ঘটনা। অনেকে আহত হচ্ছেন, প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কয়েক দফা অভিযান চালালেও থেমে নেই অবৈধ এসব বাহনের দৌরাত্ম্য।