ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষে ঢাকার সাইন্স ল্যাবরেটরি এলাকা রীতিমতো রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সংঘর্ষে দুটি বাস ভাঙচুর করে এতে আগুন দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে সেনাবাহিনী ও পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে বাস দুটি ছাড়াও অন্যান্য যানবাহন ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের হাত থেকে রক্ষা পায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশকে টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে হয়েছে। দুপুর আড়াইটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ওই এলাকার সব সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। চার ঘণ্টা পর যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়। দীর্ঘ সময় সড়ক বন্ধ থাকায় যানজটে মানুষের ভোগান্তি ছিল চরমে।
সংঘর্ষে সাংবাদিক, পুলিশ, শিক্ষার্থী ও পথচারীসহ অন্তত অর্ধশত আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১১ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে চারজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তবে তারা পুরোপুরি আশঙ্কামুক্ত বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। মঙ্গলবার ঢাকা কলেজের বাসে সিটি কলেজের কয়েক শিক্ষার্থীর ওঠার চেষ্টার সূত্র ধরে সংঘর্ষের ঘটনাটি ঘটে থাকতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে পুলিশ।
বুধবার দুপুর আড়াইটার দিকে ঢাকার সাইন্সল্যাবরেটরি মোড়ে ঘটনার সূত্রপাত। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বুধবার ছিল ঢাকা কলেজের ১৮৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান শেষে শিক্ষার্থীদের বহনকারী ঢাকা কলেজের তিনটি বাস মিরপুরের বিভিন্ন জায়গার উদ্দেশে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে ছেড়ে যায়। বাসগুলো সিটি কলেজের সামনে গিয়ে যানজটে আটকা পড়ে। এ সময় বাসের ভেতর শিক্ষার্থীরা আনন্দ করছিল। আনন্দের ছলে উচ্চস্বরে নানা কর্থাবার্তা ও হৈ-হলেস্নাড় চলছিল। এ নিয়ে সেখানে থাকা সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রথমে হালকা কথা কাটাকাটি হয়। পরে তুমুল ঝগড়া লেগে যায়। একপর্যায়ে সিটি কলেজ ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন।
খবর পেয়ে দুই কলেজের শিক্ষার্থীরাই লাঠিসোটা ও রড নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এ সময় ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের বহনকারী তিনটি বাসের মধ্যে সামনের দিকে থাকা দুটি বাসে ব্যাপক ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। তৃতীয় নম্বর বাসটি যানজটের পেছনের দিকে অর্থাৎ নিউমার্কেটের
\হদিকে থাকায় সে পর্যন্ত আর শিক্ষার্থীরা আসেনি, এমনকি সংঘর্ষও ছড়ায়নি। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে লাঠিসোটা নিয়ে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের সূত্র ধরে সংঘর্ষ বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে সাইন্সল্যাবরেটরি এলাকা রীতিমতো রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
স্থানীয়রা জানান, দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে ভাঙচুরের কবলে পড়া দুটি বাসে আগুন দেওয়ার চেষ্টা হয়। এ সময় দুই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যার যার কলেজের ক্যাম্পাসের আশপাশের থাকা গলিতে অবস্থান নেয়। গলি থেকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। ইটপাটকেলের আঘাতে সাংবাদিক, পুলিশ, শিক্ষার্থী ও পথচারীসহ অন্তত অর্ধশত আহত হন।
আইনশঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, খবর পেয়ে দ্রম্নত সেনাবাহিনীর সদস্যরা এবং অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে থাকে। এমন পরিস্থিতি চলে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত। টানা দুই ঘণ্টার সংঘর্ষে পুরো এলাকা রীতিমতো রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বিভিন্ন ভবনের বাসিন্দারা আতঙ্কে বাসা ছেড়ে নিরাপদ জায়গায় চলে যান। বন্ধ হয়ে যায় ওই এলাকার সব ধরনের দোকানপাট। মার্কেটসহ সবকিছু। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সেনাবাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য ও পুলিশের বাড়তি ফোর্স পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা যার যার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে ও আশপাশের এলাকায় অবস্থান নেয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পুলিশ পরির্দশক মোহাম্মদ ফারুক জানান, আহতদের মধ্যে শাহরিয়ার (২১), নূর হোসেন (১৮), তুষার (১৯), সিজান (১৯), তানিম (২১), দেওয়ান নাঈম (২৩), নিরব (২১) ও আরাফাতসহ (২১) ১১ জন শিক্ষার্থীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হয়েছিল। তবে তারা কোন কলেজের শিক্ষার্থী, সেটা নিশ্চিত করে জানা যায়নি। চিকিৎসকরা সাতজনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পাঠিয়ে দেন। চারজনকে হাসপাতালে ভর্তি করে রেখেছেন। তবে তারা পুরোপুরি আশঙ্কামুক্ত বলে চিকিৎসকরা জানান।
স্থানীয়রা জানান, দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় সেখানে থাকা মানুষের মধ্যে রীতিমতো আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। যেসব যানবাহন সুযোগ পেয়েছে, সেগুলো ঘুরে অন্য রাস্তা দিয়ে চলে গেছে। অধিকাংশ গাড়ি যানজটে আটকা পড়ে। আটকাপড়া যানবাহনের যাত্রীরা যে যার মতো নেমে নিরাপদ জায়গায় চলে যান। কোনো কোনো গাড়ির চালককে পর্যন্ত গাড়ি ফেলে নিরাপদ জায়গায় চলে যেতে দেখা গেছে। এমন পরিস্থিতিতে পুরো এলাকার সব সড়ক বন্ধ হয়ে যায়। থেমে যায় সব ধরনের যানবাহন চলাচল। এক প্রকার অচল হয়ে পড়ে রাজধানী। যানজটে নাকাল মানুষজন হেঁটে গন্তব্যের দিকে রওনা হন।
সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দুই কলেজের শিক্ষার্থীরা যার যার ক্যাম্পাসে অবস্থান করছে বলে জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের ধানমন্ডি জোনের সহকারী কমিশনার তরিকুল ইসলাম। তিনি আরও জানান, ঢাকা কলেজের দুটি বাস ভাঙচুর করার সূত্র ধরেই সংঘর্ষ ব্যাপক আকার ধারণ করে। পূর্ব রেষারেষি এবং ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের ছাত্রদের মধ্যে কথা কাটাকাটির জের ধরে ঘটনাটি ঘটে থাকতে পারে বলে প্রাথমিক জানা গেছে। পুরো এলাকায় অতিরিক্ত সেনা সদস্য ও পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। দুই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও অনেকটাই মুখোমুখি অবস্থান করছে। যেকোনো ধরনের অরাজক পরিস্থিতি এড়াতে সেনাবাহিনী ও পুলিশ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে।
পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ জানায়, সন্ধ্যা ৫টা থেকে সাড়ে ৫টা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ ক্যাম্পাসে অবস্থান করলে আশপাশের সব সড়কে যানবাহন চলাচল শুরু হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৫টার পর দুই কলেজের শিক্ষার্থীরা আচমকা যার যার কলেজ ক্যাম্পাস এলাকা থেকে মিছিল বের করে। যদিও মিছিল ঘিরে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এমনকি শিক্ষার্থীরাও আর কোনো যানবাহন ভাঙচুরের চেষ্টা করেনি। এ সময় আবারও যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
যদিও নিউমার্কেট থানার সহকারী কমিশনার শাহ মোস্তফা তারিকুজ্জামান জানান, মঙ্গলবার সাইন্সল্যাব এলাকায় ঢাকা কলেজের ছাত্রদের একটি বাসে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন সিটি কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী। এতে বাধা দিলে দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাকবিতন্ডা হয়। পরে সেটা হাতাহাতিতে গড়ায়। ঘটনাটি দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে।
তিনি আরও জানান, বুধবার সকালে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা সিটি কলেজে গিয়ে ভাঙচুর চালায়। সেই ঘটনার জের ধরে সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। কাকতালীয়ভাবে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের বহনকারী তিনটি বাসের মধ্যে দুটি সিটি কলেজের সামনে গিয়ে যানজটে আটকা পড়ে। সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরাও সেই সুযোগকে কাজে লাগায়। তারা মঙ্গলবারের ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে বাস দুটি ভাঙচুর করে। পরে এতে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করে। তবে সেনাবাহিনী ও পুলিশের কারণে তা পারেনি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ জানায়, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে শিক্ষার্থীরা যার যার মতো নিরাপদ জায়গায় চলে যায়। এরপর থেকেই যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। সব রাস্তায় পুরোদমে যানবাহন চলছে। তবে দীর্ঘ সময় যানজটে শত শত যানবাহন আটকা থাকায় সড়কে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগছে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার পর অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে যায় যানবাহন চলাচল। সংঘর্ষের ঘটনায় কোনো মামলা বা কাউকে আটক করা হয়নি বলে ধানমন্ডি ও নিউমার্কেট থানা পুলিশ জানায়।