বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১০ বৈশাখ ১৪৩২

বৈষম্যমূলক পদোন্নতি নীতিমালায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ

এম সাইফুল
  ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
বৈষম্যমূলক পদোন্নতি নীতিমালায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) থেকে মহাব্যবস্থাপক (জিএম) পদে পদোন্নতির জন্য প্যানেল চূড়ান্ত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। তবে পদোন্নতি নীতিমালা বৈষম্যমূলক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জিএম পদে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নের জন্য যে নীতিমালা জারি করা হয়েছে, তা বাস্তবায়িত হলে অনেক কর্মকর্তা পেশাগত জ্যেষ্ঠ ও দক্ষতা এবং মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হবেন বলে সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। এ ছাড়া বাস্তবতা বিবর্জিত বিদ্যমান এই নীতিমালার মাধ্যমে জিএম পদে পদোন্নতি হলে সাক্ষাৎকার প্রার্থীদের মধ্যে একটি বড় অংশ বৈষম্যমূলক অবিচারের শিকার হবেন বলে মনে করছেন ব্যাংকের সাক্ষাৎকার প্রার্থীরা।

গত ৪ নভেম্বর থেকে পদোন্নতির জন্য সাক্ষাৎকার নেওয়া শুরু হয়েছে। আগামী ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে। এই বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার নিরসন কিংবা সার্কুলার সংশোধন করেই জিএম পদে পদোন্নতির জন্য নতুনভাবে সাক্ষাৎকার নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন প্রার্থীরা।

জিএম পদে পদোন্নতির জন্য বাছাই কমিটির চেয়ারম্যান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, সদস্য হিসেবে আছেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডি নির্বাহী পরিচালক এবং সদস্য সচিব হিসেবে আছেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (ব্যাংক প্রশাসন)।

জানা যায়, ২০২২ সালের ২১ ডিসেম্বর নীতিমালা সভায় সিদ্ধান্ত হয় ব্যাংক ও আর্থিক

\হপ্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বা সিনিয়র অফিসারের পরের পদে পদোন্নতিতে দুই পর্বের ব্যাংকিং ডিপেস্নামা পাস বাধ্যতামূলক করার। আইবিবি তাদের সিদ্ধান্তের বিষয়টি গত বছরের ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠায়। এরপরই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২৩ সালের ৮ ফেব্রম্নয়ারি নির্দেশনা দেয়, ব্যাংকের চাকরিতে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা অথবা সমতুল্য পদের ওপর যে কোনো পদে পদোন্নতি পেতে হলে ব্যাংকিং ডিপেস্নামার দুই পর্বেই পাস বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে হবে। ব্যাংকিং ডিপেস্নামা পাস ছাড়া কোনো ব্যাংকার পদোন্নতির যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না।

আইবিবির এ সিদ্ধান্ত ব্যাংকিং পেশাকে জটিল পরিস্থিতিতে ফেলতে পারে বলে ওই সময় থেকে সামাজিক মাধ্যমে এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। তখন তারা বলেন, ব্যাংকিং পেশা শুধু বাণিজ্য অনুষদের শিক্ষার্থীদের জন্য নয়। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন অনুষদ ও বিভাগের শিক্ষার্থী ব্যাংকিং পেশায় যুক্ত হচ্ছেন। আইবিবি যে কোর্সগুলোর মাধ্যমে ব্যাংকারদের মৌলিক ও উন্নত জ্ঞান যাচাই করে, তা বেশিরভাগ সিনিয়র ব্যাংকাররা তাদের পূর্ববর্তী পড়ালেখা, বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ এবং তাদের দীর্ঘ পেশাজীবনে চলমান বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জেনে থাকেন। এসব ব্যাংকাররা তাদের পদোন্নতির জন্য ব্যাংকিং ডিপেস্নামা অর্জন করাকে হতাশা মনে করছেন। এ ছাড়া ব্যাংকিং ডিপেস্নামা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নিয়েও ওই সময় নানা প্রশ্ন ওঠে। কারণ ৫ শতাংশ পরীক্ষার্থীও এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারছেন না। এক্ষেত্রে আইবিবির সক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং এর পরই এমন নির্দেশনা কার্যকর করা উচিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এর আগে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ গত ২০২৩ সালের ৩ জানুয়ারি সরকারি খাতের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ও জিএম পদে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন নীতিমালা জারি করে ব্যাংকিং ডিপেস্নামাসহ বৈষম্যমূলক ও বিতর্কিত কিছু বিধিবিধান যুক্ত করেছে। পদোন্নতির এ নতুন নীতিমালায় পেশাগত ডিগ্রি অর্জনের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ নম্বর রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) চাকরিরত ব্যাংকারদের জন্য দুই বছর মেয়াদি পেশাগত কোর্স মাস্টার্স ইন ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট বা এমবিএম ডিগ্রি নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো ঢাকা কেন্দ্রিক যারা চাকরি করেন, শুধু সেসব চাকরিরত প্রার্থীদের পেশাগত এ ডিগ্রি নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া দেশ-বিদেশে কোনো স্বীকৃত জার্নালে পেশাগত লেখা ও পুস্তক প্রকাশনার জন্যও নির্দিষ্ট পরিমাণ নম্বর রাখা হয়েছে। কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপটে ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে গবেষণা ও জার্নাল প্রকাশনার দিকে মনোযোগী হওয়ার সুযোগ একেবারেই দুঃসাধ্য ব্যাপার। ফলে নতুন এ নীতিমালা নিয়ে তখন থেকেই রাষ্ট্রমালিকানাধীন সব ব্যাংকের বেশিরভাগ কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) থেকে মহাব্যবস্থাপক (জিএম) পদে সাক্ষাৎকার দিতে আসা একাধিক প্রার্থীদের অভিযোগ একদিকে বৈষম্যমূলক পদোন্নতি নীতিমালা প্রণয়নকারী শেখ মোহাম্মদ সলীম উলস্নাহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে দীর্ঘদিন আর্থিক খাতে এককভাবে কর্তৃত্ব খাটিয়ে নানামুখী বিতর্কিত কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েছিলেন। অন্যদিকে বিতর্কিত এ নীতিমালায় পদোন্নতির ক্ষেত্রে ব্যাংকিং ডিপেস্নামা পাস বাধ্যতামূলক করার আরেক কারিগর আইবিবি কাউন্সিলের তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ তালুকদার ৫ আগস্ট ক্ষমতাচু্যত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত হিসেবে পরিচিতি ছিলেন। যিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থাকাকালে ব্যাংক খাতে ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। যে কারণে সরকার পতনের পর লাপাত্তা হয়েছেন তিনি। এভাবে ব্যাংক লুটেরাদের বানানো নীতিমালায় ব্যাংকিং ডিপেস্নামা যদি পদোন্নতির মাপকাঠি হয়, তবে তা এক ধরনের বৈষম্য তৈরি করছে। কারণ ব্যাংকাররা দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্যাংক পরিচালনা করছেন। আবার তাদের ওপর ডিপেস্নামা পাস বাধ্যতামূলক করার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ।

যে কারণে সাক্ষাৎকার প্রার্থীদের দাবি, অবিলম্বে বিতর্কিত নীতিমালা সংশোধন করতে হবে; নিজ স্বার্থ কিংবা কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে বিতর্কিত নীতিমালা চাপিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে জেষ্ঠ, শিক্ষাগত যোগ্যতা, মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা এবং কর্মকালীন সময়ের গোয়েন্দা প্রতিবেদন বিবেচনায় অপরিহার্য পছন্দ রূপে সর্বমহলে প্রশংসিত ও গ্রহণযোগ্য অপরিবর্তনীয় স্থায়ী নীতিমালা প্রণয়ন করার আগ পর্যন্ত পদোন্নতি কার্যক্রম স্থগিত করা জরুরি বলে মনে করছেন তারা। অন্যথায় দীর্ঘদিন মাঠ পর্যায়ে কাজ করা ত্যাগী ও অভিজ্ঞরা বঞ্চিত হবেন। পদোন্নতি জটিলতায় আটকে কাজে মনোযোগ হারাবেন কর্মকর্তারা। ফলে অভিজ্ঞ ও যোগ্য ব্যক্তিদের সংকট তৈরি হবে সরকারি ব্যাংকগুলোয়।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জিএম পদে ভাইভা দেওয়া সরকারি ব্যাংকের এক ডিজিএম বলেন, 'চলমান সাক্ষাৎকার শেষে জিএম পদে পদোন্নতিতে জারিকৃত নতুন নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে জটিলতা হবে এবং অনেক যোগ্য, অভিজ্ঞ ও ত্যাগী কর্মকর্তাই পদোন্নতি পাবেন না। আর পদোন্নতির ক্ষেত্রে ব্যাংকিং ডিপেস্নামা, পেশাগত ডিগ্রি অর্জন ও পুস্তক প্রকাশনাসহ নতুন কিছু নিয়ম এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যার ফলে মূলত যে পদোন্নতি পাওয়ার কথা সে পাবে না। তাতে ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ তৈরি হবে। এতে এক ধরনের বিশৃঙ্খলাও তৈরি হতে পারে।'

জিএম পদে পদোন্নতির জন্য সাক্ষাৎকার দিতে আসা আরেক কর্মকর্তা বলেন, 'শুধু একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার জন্য জারি করা নীতিমালার ফলে ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তাদের মেধা, অভিজ্ঞতা ও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘিত হচ্ছে। ফলে অভিজ্ঞ ব্যাংকারদের পদোন্নতির স্বপ্ন পদদলিত হবে এবং সার্বিকভাবে ব্যাংকিং খাতে ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি হচ্ছে। বিধায় স্বৈরাচারী সরকারের আমলাদের বানানো বিতর্কিত পদোন্নতি ও পদায়ন নীতিমালা সংশোধন বা বাতিলের জন্য দ্রম্নত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।

এ বিষয়ে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফায়েকুজ্জামান যায়যায়দিনকে বলেন, পদোন্নতি নীতিমালার বিষয়ে সমালোচনা আছে। এটি পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। হঠাৎ একটি সিদ্ধান্ত চাপিয়ে না দিয়ে, সবার পরামর্শ নিয়ে করা উচিত।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে