বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষে নিহতের ঘটনায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অর্ধসহস্রাধিক হত্যা মামলা রুজু হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ দলীয় প্রথম সারির নেতা, বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী মিলিয়ে এসব মামলায় এজাহার নামীয় আসামি ৫০ হাজারের বেশি। ভিকটিম পরিবারের অভিযোগ, এসব হত্যা মামলার তদন্ত শুরু হলেও তা খুবই ধীরগতিতে চলছে। তাই হত্যাকারীদের বিচার হওয়া নিয়ে তারা সংশয়ে রয়েছে।
তবে পুলিশের দাবি, সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে স্পর্শকাতর এসব মামলার তদন্ত করা হচ্ছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন মন্ত্রী-এমপি ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের অনেককে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশি ও গোয়েন্দা অভিযান চলমান রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহতের ঘটনায় রুজুকৃত মামলার তদন্তে যাতে কোনো ধরনের গাফিলতি না হয় এ জন্য বিশেষ তদারকির ব্যবস্থা করা হয়েছে। মামলার তদন্তকারীর কাছ থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তদন্তের নিয়মিত আপডেট নিচ্ছেন। একই সঙ্গে তদন্তে যাতে কোনো ধরনের ফাঁকফোকর ও দুর্বলতা না থাকে তা নিশ্চিত করার জন্য মামলার সুপারভিশন কর্মকর্তাদের সতর্ক করা হয়েছে। মামলার এজাহারভুক্ত আসামি হলেও নির্দোষ কোনো ব্যক্তি যাতে ফেঁসে না যায় সে ব্যাপারে তারা সতর্ক। পাশাপাশি এজাহারভুক্ত আসামি না হলেও হত্যাকান্ডে সম্পৃক্ত কোনো ব্যক্তি যেন পার পেয়ে না যায় সেদিকে বিশেষ নজর রাখতে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মামলার তদন্তের দায়িত্বে থাকা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে নিহতদের অনেকের লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করা হয়েছে। ফলে এসব মামলার তদন্তের শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে ওইসব মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য কবর থেকে উত্তোলনে আদালতের আদেশ নেওয়া হচ্ছে। আদালতের আদেশ পাওয়ার পর মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন এবং ময়নাতদন্ত রিপোর্ট সংগ্রহ করতে বেশকিছুটা সময় লাগছে। যা তদন্তের গতি বাধাগ্রস্ত করছে।
তবে ময়নাতদন্ত ছাড়াই মরদেহ দাফন করা ভিকটিম পরিবারগুলো এজন্য পুলিশকেই পুরোপুরি দায়ী করছে। তাদের ভাষ্য, বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে সংঘাত-সহিংসতাসহ যে কোনো অস্বাভাবিক মৃতু্যর ঘটনায় ময়নাতদন্ত
করা বিধান রয়েছে। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে যারা নিহত হয়েছেন পুলিশের ভয়ে তাদের অনেককেই ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করতে হয়েছে। এছাড়া বেশকিছু ক্ষেত্রে পুলিশ ময়নাতদন্ত সরাসরি অসহযোগিতা করেছে। তবে কত মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করা হয়েছিল সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান এখনো পাওয়া যায়নি।
নিহতদের স্বজনদের অভিযোগ, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ঘটনাস্থলেই যাদের মৃতু্য হয়েছে পুলিশ তাদের লাশ সরাসরি কবরস্থানে নিয়ে দাফন করার শর্তে তা হস্তান্তর করেছে। লাশ পোস্টমর্টেম করতে হাসপাতাল মর্গে নিয়ে যাওয়া হলে স্বজনদের ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। হয়রানির ভয়ে তাদের স্বজনদের অনেকেই মরদেহ সরাসরি বাড়িতে নিয়ে দাফন করেছেন।
অন্যদিকে, চিকিৎসাধীন অবস্থায় যাদের মৃতু্য হাসপাতালে হয়েছে তাদের বিষয়ে খবর দেওয়া হলেও পুলিশ অনেকক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত করার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি বলেও নিহতদের স্বজনরা অনেকেই অভিযোগ করেছেন।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, নিজেদের রক্ষা করতেই ওই সময় পুলিশ ময়নাতদন্ত এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। কারণ এসব মৃতু্যর ঘটনার সঙ্গে পুলিশের নামও জড়িত রয়েছে। ফলে তারা নিজেদের গা বাঁচানোর চেষ্টা থেকেই এসব করছে।
এদিকে যথাসময়ে ময়নাতদন্ত না হওয়ায় নিহতদের অনেকের মৃতু্যর প্রকৃত কারণ চাপা পড়ে যেতে পারে। একটি খুনের ঘটনাও স্বাভাবিক মৃতু্য হিসেবে দেখানোর সুযোগ থেকে যায় বলে জানান অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্য, মৃতু্যর পর তাড়াতাড়ি পোস্টমর্টেম করা গেলে রিপোর্ট কনভিনসিং হয়। দেরি হলে (মরদেহ নষ্ট হয়ে) অনেক এভিডেন্স পাওয়া যায় না। ফলে এভিডেন্স হিসেবে রিপোর্টটা তখন হালকা হয়ে যায়। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট না থাকায় এখন যেমন মামলা তদন্ত করতে বিলম্ব হচ্ছে তেমনি দেরিতে পোস্টমর্টেম করার কারণে কতটা সুষ্ঠু তদন্ত করা সম্ভব হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
প্রসঙ্গত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ৫ আগস্ট ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে মোবাইল ফোনের দোকান কর্মচারী মিরাজ খান গুলিবিদ্ধ হন। কিন্তু ঢাকার হাসপাতালে উপযুক্ত চিকিৎসা না হওয়ায় স্বজনরা তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করান। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮ আগস্ট তিনি মারা যান। ওই সময় ময়নাতদন্ত ছাড়াই তার লাশ দাফন করা হয়।
এ ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানায় দায়েরকৃত হত্যা মামলা তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ শুরুতেই হোঁচট খায়। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট না থাকায় মিরাজ গুলিতে নিহত হয়েছেন নাকি অন্য কোনোভাবে মারা গেছেন তা শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় আদালতের অনুমতি নিয়ে মিরাজের লাশ দাফনের ৯৮ দিন পর উত্তোলন করা হয়।
পোস্টমর্টেম রিপোর্ট হাতে পেলে তদন্ত কাজ নতুন করে গতি পাবে বলে তদন্তকারী কর্মকর্তা আশা করলেও দীর্ঘদিন পর লাশ উত্তোলন করার কারণে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট কতটা কনভিনসিং হবে তা নিয়ে তিনি সন্দিহান।
শুধু মিরাজই নন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত এমন অনেকের লাশই ময়নাতদন্ত ছাড়া দাফন করায় তাদের লাশ উত্তোলন করতে হচ্ছে। দীর্ঘদিন পর মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করায় কতটা সঠিক পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাওয়া যাবে তা নিয়ে খোদ তদন্তকারী কর্মকর্তাই সংশয়ে রয়েছেন।
এদিকে আন্দোলনে নিহতের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলা তদন্তে মন্থরগতির নেপথ্যে আরও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ চিহ্নিত করেছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। তারা জানান, সরকারের পটপরিবর্তনের পর ঢাকাসহ সারাদেশে থানা-ফাঁড়ি থেকে শুরু করে পুলিশের শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত ব্যাপক রদবদল করা হয়। নতুন কর্মস্থলে যোগ দেওয়া মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে এলাকার রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে সবকিছুই অপরিচিত। ফলে মামলার ডকেট হাতে পেয়েই স্বাভাবিক গতিতে তারা তদন্ত কাজ শুরু করতে পারেননি।
এছাড়া আন্দোলন চলাকালে ক্ষতিগ্রস্ত থানাগুলোতে যথাযথ লজেস্টিক সাপোর্ট না থাকায় তদন্তকারী কর্মকর্তাদের পক্ষে এতদিন স্বাভাবিক গতিতে তদন্ত কাজ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও অনেক ক্ষেত্রে তদন্তের সুষ্ঠু গাইডলাইন দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। যা মামলার তদন্ত গতিশীল করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহতদের নিয়ে 'মামলা বাণিজ্যের' হিড়িকের বিষয়টি প্রশাসনের সামনে আসায় তদন্ত গতিহীন হওয়ার আরও একটি বড় কারণ বলে উলেস্নখ করেন ঢাকা মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, নিরীহ কেউ যাতে এসব হত্যা মামলায় ফেঁসে না যায় এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল থেকে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাই তদন্ত কর্মকর্তারা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ধীর পদক্ষেপে তদন্ত কাজ এগোচ্ছেন।
ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, বেশকিছু হত্যা মামলায় নিরীহ অনেক মানুষকে ব্যক্তিগত শত্রম্নতা, এলাকাভিত্তিক দ্বন্দ্বে আসামি করা হয়েছে। কোনোদিন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলন ভিন্নদিকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রেও ভূমিকা ছিল না এমন ব্যক্তিও আসামি হয়েছেন। নিহতদের যে স্বজন বাদী হয়ে মামলা করেছেন তারা নিজেরাই অনেক আসামিকে চিনেন না। কখনো তাদের নামও শুনেননি। বেশ কয়েকজন বাদী জানিয়েছেন, তিনি মামলার এজাহারে যাদের আসামি করেছেন তার বাইরে অনেকের নাম রয়েছে। তাদের নাম এজাহারে কীভাবে যুক্ত হয়েছে তার তিনি কিছুই জানেন না।
এদিকে বেশিরভাগ হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে হাজার হাজার ব্যক্তিকে। এ ছাড়া কোনো কোনো মামলায় অজ্ঞাত হিসেবে আরও কয়েক শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। বেশিরভাগ মামলার এজাহারের বর্ণনা একই। উপরের সারির আসামিরা একই। নিচের সারিতে যারা আসামি তাদের নামের ক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকলেও অভিযোগ আছে এসব আসামিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, হয়রানি ও শত্রম্নতাবশত আসামি করা হয়েছে। ঢালাওভাবে এসব মামলার কারণে স্বাভাবিক গতিতে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব হচ্ছে না বলে দাবি করেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হত্যা মামলা প্রমাণের জন্য কিছু আলামত লাগে। কিন্তু গণহত্যা মামলা আদালতে গেলে অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যাবে। কারণ এসব হত্যা মামলা প্রমাণের যথেষ্ট আলামত তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছে নেই। তাই অন্যসব হত্যা মামলার মতো বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহতদের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার তদন্ত সময়মতো সম্পন্ন করা কঠিন হবে। আর এসব মামলা তাড়াহুড়া করে তদন্ত শেষ করে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হলে তা আইনের ধোপে টিকবে না। এতে প্রকৃত অপরাধীরাও পার পেয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে একাধিক অপরাধ বিশেষজ্ঞের ভাষ্য, ঢালাওভাবে মনগড়া যেভাবে আসামি করা হয়েছে এসব মামলার তদন্ত দ্রম্নত শেষ করা দূরে থাক, দীর্ঘ বিলম্বেও চার্জশিট দেওয়া চ্যালেঞ্জ হবে। আর চার্জশিট দিলেও মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হলে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ ও আলামতের অভাবে আসামিদের শাস্তি পর্যন্ত না-ও হতে পারে। এ কারণে অনেক আসামি অপরাধ করা সত্ত্বেও আইনের ফাঁকফোকরের কারণে মুক্তি পেয়ে যেতে পারে। কারণ আন্দোলনে যারা নিহত হয়েছেন তাদের অনেকেরই ময়নাতদন্ত হয়নি। হত্যা মামলায় মৃতু্যর প্রকৃত কারণ বের করার জন্য ময়নাতদন্ত রিপোর্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃতু্যর কথা বলা হলেও সরাসরি কে গুলি করে হত্যা করেছে তারও প্রমাণ নেই। তাকে শনাক্ত করাও কঠিন হবে। মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তাদের হুকুমদাতা ও নির্দেশদাতা হিসেবে উলেস্নখ করা হয়েছে। এতে করে মামলার গোড়ায়ই গলদ থেকে যাচ্ছে।
সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, একটা মামলায় যদি ২০০ আসামি থাকে। কে সম্পৃক্ত ছিল আর কে ছিল না; তার কী ভূমিকা ছিল এগুলো তদন্ত করে রিপোর্ট দেওয়া প্রায় অসম্ভব হবে। ফলে এসব এজাহারের মামলার বিচার হওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ।