অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ সর্বোচ্চ চার বছর কিংবা তারও কম হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সম্প্রতি আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনের (কপ২৯) ফাঁকে কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল-জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এ মন্তব্য করেন।
সরকারের সময়সীমা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে ড. ইউনূস বলেন, 'আমরা অন্তর্র্বর্তী সরকার। আমরা স্থায়ী সরকার নই। নিয়মিত সরকার পাঁচ বছরের হয়। নতুন সংবিধানে সরকারের মেয়াদ সম্ভবত চার বছর হতে পারে। কারণ, মানুষ আরও দ্রম্নত সময়ে সরকারের পরিবর্তন চায়। কাজেই এটা (অন্তর্র্বর্তী সরকারের মেয়াদ) নিশ্চিতভাবেই চার বছরের কম হবে। আরও কম হতে পারে। এটা পুরোপুরি নির্ভর করছে মানুষের চাওয়া ও রাজনৈতিক দলগুলোর চাওয়ার ওপর।'
তিনি বলেন, 'যদি রাজনৈতিক দলগুলো চায় এটা (সংস্কার) বাদ যাও, নির্বাচন দাও। আমরা সেটাই করব।'
সেক্ষেত্রে অন্তর্র্বর্তী সরকারপ্রধান হিসেবে তিনি চার বছর থাকছেন কিনা, এ প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, 'আমি সেটা বলিনি যে চার বছর থাকব। আমি বলেছি, আমাদের মেয়াদ সর্বোচ্চ চার বছর হতে পারে। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়। আমাদের উদ্দেশ্য, যত দ্রম্নত সম্ভব শেষ করা।'
আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চান কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'না, আমি রাজনীতিবিদ নই। আমি যা করি সেটা নিয়েই খুশি। জীবনের এই শেষ সময়ে এসে সেটা বদলাতে চাই না।'
সাক্ষাৎকারে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ ও বিভিন্ন দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে সেটা তুলে ধরে তিনি বলেন, এ বিষয়ে সকলের সচেতনতা জরুরি। এছাড়া, বাংলাদেশে চলমান সংস্কার প্রক্রিয়া, আগামী নির্বাচন, কূটনৈতিক সম্পর্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেছেন ড. ইউনূস।
তার মতে, 'জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক ইসু্য। গেস্নাবাল ফ্রেমওয়ার্কের মাধ্যমেই এটি সমাধান করতে হবে। আমি প্রকল্পগুলোকে নিরুৎসাহিত করছি না। কিন্তু, এখানে একটি ওখানে একটি প্রকল্প নিয়ে এই সমাধান হবে না।'
বিশ্বকে তিনি বার্তা দেন, আমাদের জীবনযাপনে পরিবর্তন আনা না হলে পরিবেশের মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধান করা যাবে না।
বাংলাদেশের বিষয়ে তিনি বলেন, গত ১৬ বছরে যে সিস্টেম ছিল, সেটার কারণে বাংলাদেশ গভীর দুর্নীতিতে ডুবে ছিল। এটা থেকে দেশকে ফেরাতে আমাদের হাতে অনেক বড় কাজ। প্রতিটি খাত ধরে ধরে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
ড. ইউনূস বলেন, 'এই পরিবর্তন শুধু সাময়িক সময়ের জন্য নয়। এখানে মৌলিক পরিবর্তন আনা হবে। যাতে ভবিষ্যতে সেই ধারায় সব চলতে পারে।'
বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক বিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এর জন্য ভারতকেও এগিয়ে আসতে হবে।'
পালিয়ে ভারতে যাওয়া শেখ হাসিনা সেখানে বসে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে যেসব কথা বলছেন এগুলোকে সরকার কীভাবে দেখছে জানতে চাইলে ড. ইউনূস বলেন, 'তিনি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছেন। এ বিষয়ে আমরা ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। আমরা বলেছি, আপনারা তাকে থাকতে দিয়েছেন, সেটা ঠিক আছে। তবে, এটা নিশ্চিত করুন যেন তিনি আমাদের জন্য কোনো সমস্যা তৈরি না করে।'
শেখ হাসিনা নিজেকে এখনো প্রধানমন্ত্রী দাবি করার বিষয়ে ড. ইউনূস বলেন, 'এটা বাস্তবতা নয়। এমনকি তাকে আশ্রয় দেওয়া দেশ ভারতও বলছে যে তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী।'
শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হবে কি না, সে প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আইনি প্রক্রিয়া চলছে। দোষী সাব্যস্ত হলে তার প্রত্যাবর্তন চাওয়া হবে।
বাংলাদেশে নির্বাচন কবে হতে পারে জানতে চাইলে ড. ইউনূস বলেন, আন্দোলন হয়েছে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য। এখনই নির্বাচন দিয়ে দিলে সেই আগের অবস্থাই চলতে থাকবে। সারাদেশের মানুষ চায় নতুন কিছু হোক। তার জন্য অনেক কিছু ৫
প্রয়োজন। এর জন্য আইন, সংবিধানসহ অনেক সংস্কার প্রয়োজন।
তিনি বলেন, 'আমরা সংস্কারের জন্য কমিশন গঠন করেছি। তারা ডিসেম্বরের শেষে প্রতিবেদন জমা দেবে।'
'দুটি কাজ একইসঙ্গে চলছে- নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং সংস্কার কাজ' যোগ করেন তিনি।
এখানে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে না উলেস্নখ করে তিনি বলেন, সবকিছু জনগণের সঙ্গে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করে তাদের মতামতের ভিত্তিতেই হচ্ছে।
বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনের সঠিক সময় বিষয়ে কোনো ভাবনা আছে কি না জানতে চাইলে ড. ইউনূস বলেন, 'না, এমন কিছু নেই।'
বর্তমান সরকারের সময়ে সংখ্যালঘু ইসু্য নিয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে ড. ইউনূস বলেন, 'আমরা এ বিষয়ে নজর রাখছি। আমরা সব সময়ই বলছি, সবাই এ দেশের নাগরিক। সংবিধান সবাইকে সমান অধিকার দিয়েছে। মত প্রকাশ, নিজ ধর্ম পালনের নিশ্চয়তা সংবিধান দিয়েছে।'
হিন্দুসহ সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা বাড়ছে বলা হলে ড. ইউনূস বলেন, 'বাড়ছে না, আমি বলব কমছে। আন্দোলনের সময় যেসব হামলা হয়েছে সেটা এ জন্য হয়নি যে তারা হিন্দু, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হয়েছে তারা আওয়ামী লীগ করে বলে।'
এটাকে সমাধানে সরকার কী করবে? ড. ইউনূস বলেন, 'মতপার্থক্য থাকতেই পারে, কিন্তু সবাই একটি পরিবার। একে অপরকে শত্রম্ন মনে করা যাবে না। দেশে আইন আছে। নাগরিকের অধিকার আছে। আমাদের কাজ হচ্ছে সকলের অধিকার নিশ্চিত করা।'
ট্রাম্পের সঙ্গে কখনো কথা হয়নি
তবে রিপাবলিকান দলে বন্ধু আছে
সাক্ষাৎকারের এই পর্যায়ে নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রসঙ্গ আসে। সাক্ষাৎকারের উপস্থাপক বলেন, 'আপনি নিশ্চয় জানেন, মার্কিন নির্বাচনের আগে ট্রাম্প তার মতে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সঙ্গে যে আচরণ করা হচ্ছে, তার নিন্দা জানিয়েছেন।'
এ প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, এটা বেশিরভাগই অপপ্রচার (প্রোপাগান্ডা)। এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন অপপ্রচার। এটা দুর্ভাগ্যজনক। এই অপপ্রচারের বেশিরভাগই ভারতীয় দিক থেকে আসা।...সম্ভবত এই উত্তেজনা জিইয়ে রাখার জন্য এটা করা হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। হিন্দুদের সবচেয়ে বড় পূজা হাজার হাজার স্থানে উৎসবমুখর পরিবেশে কোনো অঘটনা ছাড়াই উদযাপিত হয়েছে।
ট্রাম্পের সঙ্গে উত্তেজনা থাকা ও তা মোকাবিলা করা সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, 'ট্রাম্পের সঙ্গে অতীতে কখনো আমার আলাপ-আলোচনা হয়নি। তাই ব্যক্তিগতভাবে তার সঙ্গে আমার কোনো সমস্যা নেই। আর আপনি যদি রিপাবলিকান পার্টির কথা বলেন তাহলে বলব আমার ডেমোক্রেটিক পার্টিতে বন্ধু আছে, রিপাবলিকান পার্টিতে বন্ধু রয়েছে। আমাকে কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল দিতে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ (হাউস) ভোট দিয়েছিল। এ বিষয়ে উভয় পার্টির সদস্যরা শতভাগ একমত হয়েছিলেন। আমাকে এ মেডেল দেওয়া নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। রিপাবলিকান পার্টি উদ্বিগ্ন বা ডেমোক্রেটিক পার্টি উদ্বিগ্ন বা ট্রাম্প উদ্বিগ্ন এই হিসেবে আমার কোনো সমস্যা হয়নি। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার কারণে হঠাৎ করে কোনো নেতিবাচক কিছুর উদ্ভব হবে এমন শঙ্কা আমি দেখছি না। আমি মনে করি, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি এমন নয় যা প্রেসিডেন্ট কে, তার ওপর নির্ভর করে। দেশটির এই নীতির একটি স্থিতিশীল অংশ আছে।'
ড. ইউনূসের এমন জবাবে তাকে আবার প্রশ্ন করা হয়, 'তাহলে আপনি কি মনে করেন না যে তিনি (ট্রাম্প) এই অঞ্চলের ব্যাপারে একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে পারেন?'
উত্তরে ড. ইউনূস বলেন, 'আমি তেমনটা মনে করি না। একেবারেই না।'
এরপর উপস্থাপক প্রশ্ন করেন, 'শেখ হাসিনা অভিযোগ করেছেন, তাকে ক্ষমতাচু্যত করার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল। বাইডেন প্রশাসন এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এ বিষয়ে আপনি কী মনে করেন?'
উত্তরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, 'আপনি বাংলাদেশে অবস্থান করলে এমনটা ভাবতে আপনাকে পাগলাটে হতে হবে। শিক্ষার্থীরা রাজপথে বিক্ষোভ করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন। যখন মব (উচ্ছৃঙ্খল জনতা) সবদিক থেকে তার (শেখ হাসিনা) বাসার দিকে যাচ্ছিল, তখন তার পরিবারই তাকে পালাতে বলেছে। কারণ, অন্যথায়, মব পুরো বাড়ি দখল করবে।...এই পরিস্থিতিতে দেশ থেকে বের হতে সহায়তার জন্য তিনি সেনাবাহিনীকে ডেকেছিলেন। আর সেনাবাহিনী তাকে দেশ থেকে বের হতে, ভারতে চলে যেতে সহায়তা করেছিল। এভাবেই বিষয়টি ঘটেছিল।...এটা ছিল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। আর তাতে দেশের সব মানুষ যোগ দিয়েছিল।'
উপস্থাপক বলেন, 'ঘটনা যখন ঘটল, তা কি আপনাকে অবাক করেছিল? কিংবা আপনি কি ধারণা করতে পেরেছিলেন যে এমন কিছু ঘটবে?'
এ প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, 'প্রথমত আমি তখন দেশে ছিলাম না। তাই ঘণ্টায় ঘণ্টায় কী ঘটছিল, তা আমি জানতে পারছিলাম না। গণমাধ্যমে যা আসছিল, আমি শুধু তা-ই জানতে পারছিলাম। আমি চূড়ান্ত ফলাফল জানতে পেয়েছিলাম।...কারণ আমাকে সরকার গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আমাকে ফোন করে বলা হয়েছিল, আমরা আপনাকে সরকার গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানাই। এই পরিস্থিতিতে দেশে তিন দিন সরকার ছিল না। কারণ, আমি দেশে ছিলাম না। দেশে আসার পর আমি শপথ গ্রহণ করি। এভাবে সরকার গঠিত হয়। সুতরাং তখন এই অনিশ্চয়তা, অপ্রত্যাশিত বিভিন্ন ঘটনা ঘটছিল। এ সবকিছু ঘটানোর জন্য কেউ কোথাও থেকে পরিকল্পনা করেনি। এ রকম কিছু ঘটেনি।'