হঠাৎ খেলাপি ঋণে বড় লাফ এক বছরে প্রায় দ্বিগুণ

প্রকাশ | ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
দেশে হঠাৎ অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে খেলাপি ঋণ। সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। শুধু গত তিন মাসেই খেলাপি ঋণ ৭৪ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। আর গত বছরের তুলনায় এটি প্রায় দ্বিগুণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, খেলাপি ঋণ হিসাবের পদ্ধতিগত কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। তাই দ্রম্নত বেড়েছে খেলাপি ঋণ। তবে আওয়ামী লীগ সরকার প্রকৃত খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ করেনি এমন অভিযোগও রয়েছে। তথ্য মতে, গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৮২২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। ব্যাংকাররা বলছেন, নীতি-সহায়তা দিয়ে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ গোপনের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মন্দ ঋণ। আগের সব রেকর্ড ভেঙে খেলাপি ঋণ রেকর্ড পরিমাণে দাঁড়িয়েছে। সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতার কারণেই ঋণ খেলাপির পরিমাণ এত বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোতে গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। তিন মাসেই ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। গত জুন শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ ৫ কোটি টাকা। তখন দেশের ব্যাংকগুলো থেকে বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ ছিল খেলাপি। ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এর পর থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলছে। তারা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছেন, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পরোক্ষ সহায়তায় ব্যাংক থেকে বিপুল অর্থ লুটপাট হয়েছে, যার একটা বড় অংশই পাচার হয়েছে বিদেশি। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর এই প্রথম খেলাপি ঋণের তথ্য পাওয়া গেছে, ফলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হতে শুরু করেছে। সাবেক সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে প্রভাবশালীদের বড় অঙ্কের ঋণ দিতে নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কাগজে-কলমে কম দেখাতে নেওয়া হয়েছিল একের পর এক নীতি। সরকার পরিবর্তনের পর সেই নীতি থেকে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুন থেকে সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে খেলাপি ঋণ বাড়াতে সরকারি ব্যাংকের চেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। এই সময়ে সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৩ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা। আর বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ৪৯ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। বিশেষ করে বিতর্কিত এস আলম গ্রম্নপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া ব্যাংকগুলো ঋণের প্রকৃত চিত্র দেখাতে শুরু করেছে। এদের মধ্যে ইসলামী ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। একইভাবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গেস্নাবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণও অনেকটা বেড়েছে। পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রম্নপ, বসুন্ধরা গ্রম্নপ, এস আলমসহ আরও কিছু বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। এতেও বেড়েছে খেলাপি ঋণ। ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অবশ্য মনে করেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হিসাবে অবলোপন করা ও আদালতের আদেশে স্থগিত থাকা ঋণ বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। সরকার পরিবর্তনের পর ব্যাংক খাত সংস্কারে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র আগামী দিনে আরও বেরিয়ে আসবে বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। হঠাৎ খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা যায়যায়দিনকে বলেন, 'আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করার কারণে খেলাপি ঋণ বেশি হয়েছে। আগে টার্ম লোনের গ্রেস পিরিয়ড ছয় মাসে ছিল, এখন তা তিন মাসে করা হয়েছে। ফলে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য মন্দা হওয়ার কারণে ঋণ পরিশোধ কম হচ্ছে। এর কারণেও খেলাপি বেড়ে গেছে।' আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে নির্বিচারে ঋণের মাধ্যমে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে, সেগুলো প্রকাশ করা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে এ বিষয়টি সঠিক নয় বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে মুখপাত্র। তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, 'এখানে রাজনৈতিক কোনো বিষয় নেই। টার্ম লোনের গ্রেস পিরিয়ড কমিয়ে আনার সিদ্ধান্তটি আগের সরকারই নিয়েছিল। এটি এখন বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র। একটি সিদ্ধান্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবায়ন করা যায় না। এজন্য সময় লাগে।'