গণ-অভু্যত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ রাজনৈতিক ও আর্থিকভাবে প্রভাবশালী প্রায় দুইশ' দুর্নীতিবাজকে জালে ঘিরেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে শুরুতে নানা তোড়জোড় থাকলেও কিছুদিন না যেতেই অদৃশ্য কারণে এ তৎপরতায় ভাটার টান ধরেছে। প্রায় তিন মাস হতে চললেও দুদক কর্মকর্তারা দুর্নীতিবাজ এসব রাঘব-বোয়ালদের অনুসন্ধানই শেষ করতে পারেনি। অথচ এরই মধ্যে অনেক দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী-এমপি-আমলা ও রাজনীতিক দেশ ছেড়ে পালিয়েছে।
দুদকের অনুসন্ধান শুরু হওয়া বেশিরভাগ দুর্নীতিবাজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টও প্রায় শূন্য। এরই মধ্যে অনেকেই তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কিংবা ঘনিষ্টজনদের নামে হস্তান্তর করেছেন। কেউবা বায়না কিংবা সাফ কবলা দলিল মূলে এসব সম্পদ বিক্রি করে দিয়েছেন। মামলা না হওয়ায় এসব দুর্নীতিবাজের অর্থ-সম্পদ আদালত জব্দ করতে পারেনি।
অথচ ২০০৭ সালের দুদক বিধিমালার ৭ বিধিতে বলা হয়েছে, 'নির্দেশ পাওয়ার পর অনুসন্ধান কর্মকর্তাকে ৪৫ দিনের মধ্যে অনুসন্ধান কাজ শেষ করতে হবে। এই সময়ের মধ্যে অনুসন্ধান কাজ শেষ করতে না পারলে যুক্তিসংগত কারণ উলেস্নখ করে অনুসন্ধান কর্মকর্তা আরও ৩০ দিন সময় নিতে পারবেন।' আর ২০ (খ) অনুযায়ী, তদন্ত কর্মকর্তার অদক্ষতার অভিযোগে কমিশন আইন বা প্রযোজ্য আইনে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে পারবে দুদক।
যদিও অনুসন্ধানের টাইম-লাইন সর্বোচ্চ ৭৫ দিনের মধ্যে অনুসন্ধান শেষ করতে না পারা দুদকের অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কমিশন কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে তা এখনো শোনা যায়নি।
দুদকের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনুসন্ধান শেষ করতে না পারার জন্য সময়মতো রেকর্ড-পত্র না পাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন বেশিরভাগ অনুসন্ধান কর্মকর্তা। তাদের ভাষ্য, অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রয়োজনীয় রেকর্ড-পত্র ইচ্ছাকৃতভাবে সরবরাহে দেরি করা হচ্ছে। ফলে তাদের নিয়মমাফিক অনুসন্ধান কাজ এগিয়ে নিতে বিলম্ব হচ্ছে।
তবে তাদের এ দাবিকে 'খোঁড়া যুক্তি' বলছেন আইনজ্ঞরা। তাদের ভাষ্য, দুদক আইন, ২০০৪-এর ১৯(৩) ধারায় এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া আছে। সেখানে বলা আছে, 'কোনো কমিশনার বা কমিশন হইতে বৈধ ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তাকে উপ-ধারা (১) এর অধীন ক্ষমতা প্রয়োগে কোনো ব্যক্তি বাধা প্রদান করিলে বা উক্ত উপ-ধারার অধীন প্রদত্ত কোনো নির্দেশ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো ব্যক্তি অমান্য করিলে উহা দন্ডনীয় অপরাধ হইবে এবং উক্ত অপরাধের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অনূর্ধ্ব তিন বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের
কারাদন্ডে বা অর্থদন্ডে বা উভয় প্রকার দন্ডে দন্ডনীয় হইবেন।'
একই ধারায় অনুসন্ধান বা তদন্তকার্যে কমিশনের বিশেষ ক্ষমতা সম্পর্কে বলা হয়েছে- 'দুর্নীতি সম্পর্কিত কোনো অভিযোগের অনুসন্ধান বা তদন্তের ক্ষেত্রে, কমিশনের নিম্নরূপ ক্ষমতা থাকিবে, যথা- সাক্ষীর সমন জারি ও উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ এবং শপথের মাধ্যমে সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা; কোনো দলিল উদঘাটন এবং উপস্থাপন করা; শপথের মাধ্যমে সাক্ষ্য গ্রহণ; কোনো আদালত বা অফিস হইতে পাবলিক রেকর্ড বা উহার অনুলিপি তলব করা; সাক্ষীর জিজ্ঞাসাবাদ এবং দলিল পরীক্ষা করার জন্য পরোয়ানা জারি করা এবং এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, নির্ধারিত অন্য যে কোনো বিষয়।'
'কমিশন যে কোনো ব্যক্তিকে অনুসন্ধান বা তদন্ত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো তথ্য সরবরাহ করিবার জন্য নির্দেশ দিতে পারিবে এবং অনুরূপভাবে নির্দেশিত ব্যক্তি তাহার হেফাজতে রক্ষিত উক্ত তথ্য সরবরাহ করিতে বাধ্য থাকিবেন।'
আইনজ্ঞরা বলছেন, অনুসন্ধানে টাইম-লাইন না মানার জন্য রেকর্ড-পত্র সময়মতো না পাওয়ার অজুহাত তোলা হলে তা ধোপে টিকবে না। কারণ অনুসন্ধানের জন্য প্রয়োজনীয় রেকর্ডপত্র সরবরাহে কেউ গাফিলতি করলে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ এ অভিযোগে কারো বিরুদ্ধে কোনো মামলা করেছে তা শোনা যায়নি। এর নেপথ্যে অন্য কারণ আছে বলে সংশয় প্রকাশ করেন তারা।
যদিও এ নিয়ে দুদকের দায়িত্বশীলরা কেউ সরাসরি কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তারা বলছেন, কমিশনের এখতিয়ার ছাড়া গণমাধ্যমে কথা বলায় বিধিনিষেধ রয়েছে। অনুসন্ধানে ধীর গতির বিষয়টি তারা কেউ স্বীকার করেননি।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের একজন কর্মকর্তা বলেন, অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠনের পর ১৩ আগস্ট থেকে সংস্থাটির অনুসন্ধান কার্যক্রমে গতি পায়। প্রতি কার্যদিবসে নতুন নতুন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কাজ শুরু করে কমিশন। তলব, অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ ও বিভিন্ন দপ্তরে তথ্য চাওয়া শুরু করে। তবে গত ২৯ অক্টোবর মঈনুদ্দিন কমিশনের আকস্মিক পতনের পর থমকে গেছে এসব কার্যক্রম। ওইদিন দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দিন আবদুলস্নাহর সঙ্গে সংস্থাটির দুই কমিশনার মো. জহুরুল হক ও আছিয়া খাতুনও পদত্যাগ করেন। তাদের পদত্যাগের পর দুদক চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগের নাম প্রস্তাব করতে গত ১০ নভেম্বর বাছাই কমিটি গঠন করে সরকার।
জানা গেছে, মঈনউদ্দিন আবদুলস্নাহ কমিশনের পদত্যাগের পর নতুন কোনো অনুসন্ধান শুরু করেনি দুদক। বিভিন্ন অনুসন্ধানের ঘটনায় মাত্র তিনটি তলব ও একই সংখ্যক মামলা হয়েছে। এর মধ্যে আলোচিত কোনো মামলা নেই। এর আগের সপ্তাহে ২২ থেকে ২৯ অক্টোবর তলবের ঘটনা ছিল ৫টি। আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী ও ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু, জামালপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মির্জা আজমের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞাসহ সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের বিরুদ্ধে ঋণ কেলেঙ্কারির মামলা হয়েছে।
দুদকের একাধিক কর্মকর্তার দাবি, চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনারের পদত্যাগের পর অনেকটাই থমকে গেছে দুদকের নিয়মিত কার্যক্রম। বিশেষ করে অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত, মামলার সিদ্ধান্ত, অভিযোগপত্রের সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া ডাকযোগে ও কলসেন্টারযোগে আসা শত শত অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে সেগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।
এ প্রসঙ্গে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কর্তৃত্ববাদী সরকারের শতাধিক মন্ত্রী-এমপি এবং সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগে অনুসন্ধানের কাজ চলমান। এমন একটি সময়ে শীর্ষ পর্যায়ে শূন্যতা দুদকের তদন্তসহ সব কার্যক্রমে স্থবিরতা সৃষ্টি করবে। নতুন কমিশন গঠনের আগ পর্যন্ত নতুন করে কারও বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু ও তদন্ত বা মামলার সুযোগ থাকবে না। ফলে দ্রম্নত নতুন কমিশন গঠনের মাধ্যমে এ শূন্যতা পূরণ করা জরুরি।
দুদকের আইন অনুযায়ী, সব ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমিশনের। কমিশন শূন্য থাকলে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। ফলে যত দ্রম্নত কমিশন গঠন হবে, তত দ্রম্নত স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরতে পারবে দুদক।
তবে শীর্ষ পর্যায়ে শূন্যতার কারণে অনুসন্ধান থমকে যাওয়ার দাবিটি কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। তাদের ভাষ্য, গত ১৯ আগস্ট স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ও আয়ে শীর্ষে থাকা ৪১ জন সাবেক মন্ত্রী-এমপির দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। আর দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দিন আবদুলস্নাহ এবং দুই কমিশনার মো. জহুরুল হক ও আছিয়া খাতুনও পদত্যাগ করেন ২৯ অক্টোবর। এ হিসাবে ওই ৪১ মন্ত্রী-এমপির দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরুর ৬৯ দিনের মাথায় মঈনউদ্দিন কমিশনের পতন হয়। অথচ অনুসন্ধানের টাইম লাইন ৪৫ দিন। এর মধ্যে অনুসন্ধান কাজ শেষ করতে না পারলে যুক্তিসঙ্গত কারণ উলেস্নখ করে অনুসন্ধান কর্মকর্তা আরও যে ৩০ দিন সময় নিতে পারে সে মেয়াদের বাকি ছিল মাত্র ৬ দিন। যা কোনোভাবেই থেমে থাকার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে এই সময়ের মধ্যে মাত্র একটি অনুসন্ধান সমাপ্ত করে মামলা করা হয়েছে।
দুর্নীতি পর্যবেক্ষণকারী সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিদের দাবি, আওয়ামী লীগ সরকারের পট পরিবর্তনের পর মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও এমপিসহ যেসব জনপ্রতিনিধি এবং আমলাদের দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করা হয়েছে, এদের অধিকাংশের বিরুদ্ধে বেশ আগে থেকেই এ ব্যাপারে অভিযোগ ছিল। এ ব্যাপারে এর আগে টিআইবি থেকেও তথ্য দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের আগে তারা দেখিয়েছে কীভাবে জনপ্রতিনিধিদের সম্পদ অস্বাভাবিকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তখন দুদক পদক্ষেপ নেয়নি। তবে সরকারের পট পরিবর্তনের পর আগের ওই তথ্যের ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করে দুদক।
প্রসঙ্গত, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম দুই মাসে দুদকের অনুসন্ধানের তালিকায় ১৮০ জনের নাম থাকলেও তৃতীয় মাসে তা দুই শ'য়ের কোটা ছাড়িয়ে যায়। এ তালিকার বেশিরভাগই আওয়ামী দলীয় মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-এমপি এবং বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠজন। এছাড়া বেশ কয়েকজন আলোচিত-সমালোচিত ব্যবসায়ী ও ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা রয়েছেন।
এর মধ্যে গত ১৫ আগস্ট সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ১৭ আগস্ট সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালসহ চার এমপি, ১৮ আগস্ট সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। এর বাইরে ১৯ আগস্ট সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশীসহ ৪১ জন মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করা হয়। ২০ আগস্ট সাবেক নৌপরিবহণমন্ত্রী শাজাহান খানসহ পাঁচ এমপি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক সহকারী (পিয়ন) মো. জাহাঙ্গীর, ২২ আগস্ট সালমান এফ রহমানসহ তিন এমপি, ২৫ আগস্ট সাবেক পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীসহ চার এমপি ও একজন সাবেক আমলা, ২৭ আগস্ট সাবেক দুই এমপি, ২৮ আগস্ট সাবেক মৎস্যমন্ত্রীসহ চার এমপি ও ২৯ আগস্ট সাবেক রেলমন্ত্রী জিলস্নুল হাকিমসহ দুই এমপির দুর্নীতি অনুসন্ধানে নামে দুদক। এদের মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে ৯ অক্টোবর মামলা করা হয়েছে।
দুর্নীতি পর্যবেক্ষণকারী সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিদের দাবি, যে গতিতে অনুসন্ধান চলছে এ ধারা অব্যাহত থাকলে দুর্নীতিবাজ রাঘব-বোয়ালদের বিরুদ্ধে শাস্তির আওতায় আনতে দীর্ঘ বিলম্ব হবে। তাদের অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ-সম্পদ বেহাত হয়ে যাবে। তাই দুদককে দ্রম্নত সংস্কার করে অনুসন্ধান-মামলা ও তদন্ত গতিশীল করা জরুরি।