বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচনের আগে সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বুধবার বার্তা সংস্থা এএফপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশে নতুন সরকার নির্বাচনের আগে কিছু সংস্কার প্রয়োজন।
শান্তিতে নোবেলজয়ী ও মাইক্রোফাইন্যান্সের পথিকৃৎ ড. ইউনূস কপ-২৯ জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিতে বর্তমানে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অবস্থান করছেন। এই সম্মেলনের সাইডলাইনে তিনি এএফপিকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তিনি বলেন, সংস্কারের গতি ঠিক করবে নির্বাচন কত দ্রম্নত হবে। তিনি দেশকে গণতান্ত্রিক ভোটের দিকে নিয়ে যাবেন বলেও উলেস্নখ করেন।
শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. ইউনূস বলেন, সংস্কারের গতিই ঠিক করে দেবে, নির্বাচন কত দ্রম্নত হবে। তবে ড. ইউনূস জোর দিয়ে বলেন, তিনি দেশকে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের দিকে নিয়ে যাবেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, 'এটি একটি প্রতিশ্রম্নতি, যা আমরা দিয়েছি। আমরা প্রস্তুত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নির্বাচন দেব এবং নির্বাচিত ব্যক্তিরা ক্ষমতা গ্রহণ করে দেশ পরিচালনা করতে পারবেন।'
ড. ইউনূস আরও বলেন, সম্ভাব্য সাংবিধানিক সংস্কারের পাশাপাশি সরকার, জাতীয় সংসদ ও নির্বাচনী বিধিমালার কাঠামোর বিষয়ে দেশে দ্রম্নত ঐকমত্য দরকার।
অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান
উপদেষ্টা বলেন, 'আমরা অন্তর্র্বর্তী সরকার। তাই আমাদের মেয়াদ যতটা সম্ভব সংক্ষিপ্ত হওয়া উচিত।'
শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বাধীন গণ-অভু্যত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন হয়। এরপর অন্তর্র্বর্তী সরকারকে নেতৃত্ব নেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. ইউনূসের নাম ঘোষণা করা হয়।
প্রথমে সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে লাখো মানুষ প্রতিবাদ-বিক্ষোভে নামেন। পরে তা শেখ হাসিনার ১৫ বছরের কঠোর শাসনের অবসানের দাবিতে দেশব্যাপী গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে করে ভারতে পালিয়ে যান। এর আগে ৭০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হন, যাদের মধ্যে অনেকে পুলিশের নৃশংস দমন-পীড়নে প্রাণ হারান।
শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচু্যত করার পর থেকে বাংলাদেশ অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তার শাসনামলে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে তার রাজনৈতিক বিরোধীদের গণগ্রেপ্তার ও বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়টি আছে।
ড. ইউনূস বলেন, 'যেকোনো সরকারই স্থিতিশীলতার বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকবে। আমরাও উদ্বিগ্ন।'
ড. ইউনূস বলেন, 'আশা করছি, আমরা এটি সমাধান করতে পারব এবং শান্তিপূর্ণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পাব।' নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ বলেন, বিপস্নবের পর মাত্র তিন মাস পেরিয়েছে।
প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ। দেশটি আর্থিকভাবে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। চলতি মাসের শুরুর দিকে ভারতীয় শিল্পগোষ্ঠী আদানি প্রায় ৮৫ কোটি মার্কিন ডলার অপরিশোধিত বিল পরিশোধের দাবিতে বাংলাদেশে বিদু্যৎ সরবরাহ অর্ধেক কমিয়ে দিয়েছে।
থেরেসা মে'র সঙ্গে বৈঠকে
শ্রম সংস্কারের প্রতিশ্রম্নতি
এদিকে, বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, তার সরকার দেশের উৎপাদন খাতে আরও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে গুরুত্বপূর্ণ শ্রম সংস্কার করবে।
বৃহস্পতিবার আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনের (কপ-২৯) ফাঁকে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে'র সঙ্গে বৈঠকের সময় প্রধান উপদেষ্টা এই মন্তব্য করেন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছেন, 'বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করার সময় ড. ইউনূস তাকে বলেন শ্রম ইসু্যটি আমাদের শীর্ষ অগ্রাধিকারের একটি। আমরা সব শ্রম সমস্যা সমাধান করতে চাই। বিষয়টি নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন মে। তিনি ড. ইউনূসের সঙ্গে মানব পাচার ও অভিবাসন নিয়েও আলোচনা করেন।'
আইনি মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে অভিবাসন বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এটি ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিয়মিত অভিবাসন কমিয়ে দেবে এবং মানব পাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করবে।
ড. ইউনূস জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে দেয়ালচিত্র নিয়ে প্রকাশিত 'আর্ট অব ট্রায়াম্ফ' বইয়ের একটি কপি উপহার দেন থেরেসা মে-কে।
প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয় সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফী সিদ্দিকী, সিনিয়র সচিব ও এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোর্শেদ এবং তুরস্ক ও আজারবাইজানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম আনামুল হকও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ-আজারবাইজান নতুন
উচ্চতায় নিতে চায় সম্পর্ক
এদিকে, আজারবাইজানের রাষ্ট্রপতি ইলহাম আলিয়েভ জানিয়েছেন, তার দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে একটি নতুন উচ্চতায় নিতে চায়।
বৃহস্পতিবার দেশটির রাজধানী বাকুতে কপ-২৯ বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনের ফাঁকে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে প্রেসিডেন্ট আলিয়েভ এ মন্তব্য করেন। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এ তথ্য জানিয়েছেন।
আজারবাইজানের রাষ্ট্রপতি জানান, বাংলাদেশের সঙ্গে একটি ব্যাপক সম্পৃক্ততা অন্বেষণ করতে আজারবাইজানের সরকারের একটি উচ্চ পর্যায়ের দল আগামী বছরের শুরুতে বাংলাদেশ সফর করবে। দেশটি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। এছাড়া তারা ঢাকায় একটি আবাসিক দূতাবাস খুলতে চায়। কারণ উভয় দেশ ব্যবসা, বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্রমবর্ধমান সুযোগ দেখতে পাচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট আলিয়েভও ছাত্র-নেতৃত্বাধীন জুলাই-আগস্ট বিপস্নবের প্রশংসা করে জানান তিনি কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশে ঘটনাগুলো অনুসরণ করছেন। তিনি আজারবাইজানে একটি যুব আত্মকর্মসংস্থান কর্মসূচির কথা উলেস্নখ করেন যা অধ্যাপক ইউনূসের ধারণা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল।
অন্তর্র্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, 'আপনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নতি ও সমৃদ্ধি অর্জন করবে। আপনার কাজটি খুবই চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু আমি জানি, আপনিই সেই চ্যালেঞ্জকে অতিক্রম করতে পারেন।'
প্রধান উপদেষ্টাও দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, 'দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, জনগণের মধ্যে মিথষ্ক্রিয়া এবং বড় আন্তর্জাতিক ফোরামে সহযোগিতা বৃদ্ধি পেলে উভয় দেশই সমৃদ্ধ হতে পারে।'
অধ্যাপক ইউনূস তেলসমৃদ্ধ মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে বাংলাদেশির জন্য আরও বেশি কাজের সুযোগের ওপর জোর দেন।
প্রেসিডেন্ট আলিয়েভ বলেন, 'আজারবাইজান তার পরিষেবার ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে।' তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের ডিজিটালাইজেশন অভিজ্ঞতা শেয়ার করার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
বৈঠকে আরও ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফী সিদ্দিকী, সিনিয়র সচিব ও এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোর্শেদ এবং তুরস্ক ও আজারবাইজানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম আমানুল হক।
ব্রাজিলের ভাইস প্রেসিডেন্টের স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ
এদিকে, ব্রাজিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেরাল্ডো অ্যালকমিনের স্ত্রী লু অ্যালকমিন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। বৃহস্পতিবার কপ-২৯ বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনের ভেনু্যতে এ সাক্ষাৎ হয় বলে জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।
বৈঠকে তারা পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। ব্রাজিলের ভাইস প্রেসিডেন্টের স্ত্রী লু অ্যালকমিন প্রধান উপদেষ্টাকে ২০০৬ সালের নোবেল শান্তি বিজয়ীর ওপর লেখা একটি বই উপহার দেন।
তিনি বলেন, অধ্যাপক ইউনূসের বই অনুবাদ করেছেন এবং তার কাজের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন তিনি।
এ সময় ড. ইউনূস বাংলাদেশ ও দক্ষিণ আমেরিকার বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে বাণিজ্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেন।
বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক ও সিনিয়র সচিব লামিয়া মোর্শেদ।