সেনাবাহিনী কতদিন মাঠে থাকবে সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে :সেনাসদর

প্রকাশ | ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
ইন্তেখাব হায়দার খান
বর্তমান পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী কতদিন মাঠে থাকবে, অন্তর্র্বর্তী সরকারই তা নির্ধারণ করবে বলে জানিয়েছে সেনাসদর। 'ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার' এর আওতায় মোতায়েন করা সেনাবাহিনীর কার্যক্রম নিয়ে বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে মিলিটারি অপারেশন্স ডিরেক্টরেটের স্টাফ কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার খান বাহিনীর এই অবস্থান তুলে ধরেন। সেনানিবাসের বনানী রেল ক্রসিং সংলগ্ন স্টাফ রোডের মেসে এই সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, সেনাবাহিনী দেশের পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় নিয়োজিত রয়েছে। তিনি আরও বলেন, 'সেনাবাহিনী ডিপস্নয় হয়েছে সরকারের সিদ্ধান্তে। সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে সেনাবাহিনী কতদিন মোতায়েন থাকা প্রয়োজন।' কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার খান জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর (৫ আগস্টের পর) দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এখন পর্যন্ত সেনাবাহিনী ছয় হাজারের বেশি অবৈধ অস্ত্র এবং প্রায় দুই লাখ গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে। পাশাপাশি অস্ত্র-গোলাবারুদ সংশ্লিষ্ট আড়াই হাজারের বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এই প্রেস ব্রিফিংয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রদান করা। এই মুহূর্তে দেশের ৬২টি জেলায় সেনাসদস্যরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অন্তর্র্বর্তী সরকার, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন, বিভিন্ন সংস্থা, গণমাধ্যম এবং স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সার্বক্ষণিক সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিরাজমান অবস্থায় দেশের পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তায় সেনাবাহিনী নিয়োজিত রয়েছে বলে জানান সেনা কর্মকর্তা ইন্তেখাব হায়দার খান। তিনি বলেন, এই দায়িত্ব পালনে সেনাবাহিনী জনগণের জানমাল, রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা (কেপিআই) এবং সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলোকে রক্ষা করার কাজ করছে। পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সদস্যরা যেসব দায়িত্ব পালন করছেন, সেটা হলো পুলিশ বাহিনীকে পুনরায় কার্যক্ষম হতে সহায়তা করা; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন ও জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা, বিদেশি কূটনীতিক ও দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, শিল্পাঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও কারখানাগুলোকে সচল রাখতে সহায়তা করা, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থায় অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে অরাজকতা ও ভাঙচুর প্রতিরোধ করা, জনগণের ভোগান্তি এড়াতে এবং দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে মূল সড়কগুলোকে বাধামুক্ত রাখা, বিভিন্ন স্থান থেকে বেহাত ও লুট হওয়া অস্ত্রসহ সব অবৈধ অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধার করা, সার্বিকভাবে দেশের অন্তর্র্বর্তী সরকার যাতে তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারে, সে জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখা। অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধার ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তারের পাশাপাশি দেশের শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতা রোধে সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বলে উলেস্নখ করেন ইন্তেখাব হায়দার খান। তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে ছয়শ'র অধিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে সেনাবাহিনী। কারখানাগুলোকে চালু রাখতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিজিএমইএসহ সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, যার ফলে বর্তমানে দেশের দুই হাজর ৮৯টি গার্মেন্ট কারখানার মধ্যে প্রায় সব কটিই এই মুহূর্তে চালু রয়েছে। পাশাপাশি সাতশ'র বেশি বিভিন্ন ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে সেনাবাহিনী, যার মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-সংক্রান্ত ঘটনা ছিল ১৪১টি, সরকারি সংস্থা বা অফিস-সংক্রান্ত ৮৬টি, রাজনৈতিক কোন্দল ৯৮টি এবং অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ঘটনা ৩৮৮টি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সময়মতো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে অনেক অপ্রীতিকর পরিস্থিতি ও বহু মানুষের জানমালের ক্ষতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। বিদেশি কূটনীতিক ও দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কূটনৈতিক এলাকায় স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। সার্বক্ষণিক সেনা টহলের মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। অবৈধ মাদকদ্রব্য উদ্ধার, মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার, বিভিন্ন অপরাধী ও নাশকতামূলক কাজের ইন্ধনদাতা ও পরিকল্পনাকারীদের গ্রেপ্তার কার্যক্রমে সেনাবাহিনী সক্রিয় রয়েছে বলে উলেস্নখ করেন ইন্তেখাব হায়দার খান। তিনি বলেন, যৌথ অভিযানে ৭০০ জনের বেশি মাদক ব্যবসায়ী অথবা মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ ইয়াবা, ফেনসিডিল, মদ, গাঁজাসহ অন্যান্য অবৈধ মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছে। দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থে গত ১৭ সেপ্টেম্বর সশস্ত্র বাহিনীর ক্যাপ্টেন ও তদূর্ধ্ব পদবির অফিসারদের সরকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয় বলে উলেস্নখ করেন ইন্তেখাব হায়দার খান। তিনি বলেন, এই বিশেষ ক্ষমতার কার্যকর প্রয়োগের কারণে ইতোমধ্যে বেশ কিছু সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি- যেমন চিহ্নিত অপরাধীদের গ্রেপ্তার, শিল্পাঞ্চলের বিশৃঙ্খলা, রাস্তা অবরোধ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণসহ সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এসব দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সেনাবাহিনী অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় বাংলাদেশ-দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট সিরিজ চলাকালে উভয় দলের খেলোয়াড়, কর্মকর্তা ও ভেনু্যর সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। দেশের বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা যাতে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হতে পারে, সে জন্য দেশব্যাপী নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছিল বলে উলেস্নখ করেন ইন্তেখাব হায়দার খান। তিনি বলেন, এ সময় সারাদেশে অতিরিক্ত ১৩৩টি সেনা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ১০ হাজারের বেশি অতিরিক্ত সেনাসদস্য মোতায়েন করা হয়। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কোনো উলেস্নখযোগ্য দুর্ঘটনা ছাড়াই পূজা উৎসব সম্পন্ন হয়। একইভাবে বৌদ্ধদের দেশব্যাপী প্রবারণা পূর্ণিমা ও কঠিন চীবরদান উৎসব যেন নিরাপদে পালিত হতে পারে, সে জন্য সেনাবাহিনী অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সংশ্লিষ্ট বৌদ্ধ সংগঠন ও ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে দায়িত্ব পালন করছে। পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত এড়াতে এবং কক্সবাজার জেলায় এফডিএমএন ক্যাম্প এলাকায় সার্বিক নিরাপত্তা বজায় রাখতে সেনাবাহিনী নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় যারা আহত হয়েছেন, সেনাবাহিনী তাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে বলে উলেস্নখ করেন সেনা কর্মকর্তা ইন্তেখাব হায়দার খান। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত তিন হাজার ২৯৫ জনকে দেশের বিভিন্ন সিএমএইচে চিকিৎসা প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৩ জন এখনো চিকিৎসাধীন রয়েছেন। 'বিচারবহির্ভূত হত্যা প্রতিরোধে সর্বোচ্চ চেষ্টা' প্রেস ব্রিফিংয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে ইন্তেখাব হায়দার খান বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘন বা বিচারবহির্ভূত হত্যা প্রতিরোধের ব্যাপারে সেনাবাহিনী অত্যন্ত সচেতন। এটার ব্যাপারে তাদের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের নির্দিষ্ট আদেশ রয়েছে, যেকোনো ধরনের পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী যেন বিচারবহির্ভূত হত্যা সংঘটিত হতে না দেয়। তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে এটা প্রতিরোধ করার। তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা রয়েছে, যাতে করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো ঘটনা তারা ঘটতে না দেন। এর আগে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল, সেখানে বলা হয়, ধর্ম অবমাননার জন্য একজনকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ভিডিওতে সেনাসদস্যরা একজন ব্যক্তিকে চোখে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছেন, মারধর করছেন- এমন দৃশ্য দেখা গেছে। সেই ভিডিওটি কী আপনার দেখেছেন?-এক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে ইন্তেখাব হায়দার খান বলেন, 'পরিস্থিতির প্রয়োজনে অনেক কিছু করতে হয়। বাট (কিন্তু) এটা সেনাবাহিনীর টার্গেট (লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে) করে কাউকে মেরেছে, এমন কোনো ঘটনা হয়নি।' আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনী কাজ করছে, পুলিশকে সহায়তা করছে। এমন অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আদৌ উন্নতি হয়েছে কিনা- এক সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সেনা কর্মকর্তা ইন্তেখাব হায়দার খান বলেন, 'পুলিশের কাছে যেসব ডেটা আছে, সেটি দিয়ে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই স্টাডি অনুযায়ী বর্তমানে সেনাবাহিনী মোতায়েন এবং ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা পাওয়ার পর যে পরিসংখ্যান, সেখানে আগের তুলনায় অপরাধ কমেছে। পরিস্থিতির অবনতি হয়নি। তবে হয়তো প্রত্যাশা অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিত উন্নতি হয়নি। সেটা যেন হয়, সেই অনুযায়ী চেষ্টা চলছে। পরিসংখ্যানগতভাবে অপরাধের সংখ্যা কমেছে। এর বাইরে অনেক কিছু থাকতে পারে, যা আমাদের পারসেপশন ইনফ্লুয়েন্স করছে। সেটা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।' কয়েক দিন আগে পুলিশের একজন সহকারী সুপারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর একজন মেজরের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু এ বিষয়ে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে পরিষ্কার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সেদিন আসলে কী হয়েছিল, পরবর্তী সময় কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, এ বিষয়ে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন। জবাবে ইন্তেখাব হায়দার খান বলেন, 'এটা একটি ভুল-বোঝাবুঝির ঘটনা ছিল। এ ঘটনায় সংস্থার পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পুলিশের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।'