জগন্নাথের নতুন ক্যাম্পাসের 'কাজ পাচ্ছে' সেনাবাহিনী
প্রকাশ | ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি রিপোর্ট
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের নির্মাণকাজ সেনাবাহিনীকে হস্তান্তরে সায় দিয়েছেন শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
সচিবালয়ে মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আন্দোলনরত শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি বলেন, 'তারা (শিক্ষার্থীরা) চাচ্ছে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হোক। এতে কোনো সমস্যা নেই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তো স্বায়ত্তশাসিত অনেকাংশে, তারা যদি সেটা চায়, তাহলে ইউজিসির মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের এতে কোনো আপত্তি নেই।
বরং আমরা সহায়তা করব, কী করে তাদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া যায়। মন্ত্রণালয় এতে সহায়তা করবে।'
পাঁচ দফা দাবি আদায়ে সোমবার দুপুরে প্রথমে শিক্ষা চত্বর অবরোধ এবং পরে সচিবালয় ঘেরাও করেন পুরান ঢাকায় অবস্থিত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পরে ডাক, টেলিযোগাযোগ, তথ্য প্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম তিন দিনের মধ্যে সমস্যার সমাধানের আশ্বাস দিলে তারা ক্যাম্পাসে ফিরে যান।
শিক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর আন্দোলনের সংগঠক একেএম রাকিব বলেন,
'মন্ত্রণালয় আমাদের দাবির সঙ্গে একমত হওয়ায় আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেওয়া তিন দিনের আলটিমেটাম থেকে সরে আসছি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়কে আমাদের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা দিতে হবে।
এতদিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছে। তারা এতদিন বলে আসছে, তারা দ্বিতীয় ক্যাম্পাস আর হল নিয়ে ইউজিসির সঙ্গে কথা বলেছে। কিন্তু আজকে সামনাসামনি সবকিচু ক্লিয়ার হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে এ রকম কোনো দাবিই রাখা হয়নি।'
সচিবালয়ে বৈঠকে আন্দোলনের সংগঠক একেএম রাকিব ছাড়াও আন্দোলনের মুখপাত্র তৌসিব মাহমুদ সোহান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক রেজাউল করিম, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রইছ উদ্দীন এবং প্রক্টর অধ্যাপক মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক উপস্থিত ছিলেন।
'বোঝাপড়া এখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে'
আগের প্রকল্প পরিচালককে আইনের আওতায় আনা ও নতুন ক্যাম্পাসের কাজ সেনাবাহিনীকে হস্তান্তরসহ ৫ দাবিতে কয়েকদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা।
অন্য দাবিগুলো হলো- শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সুনির্দিষ্ট রূপরেখাসহ ঘোষণা করতে হবে যে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর হয়েছে, অবিলম্বে বাকি ১১ একর জমি অধিগ্রহণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং পুরাতন ক্যাম্পাস নিয়ে আগের সব চুক্তি বাতিল করতে হবে, সম্প্রতি ইউজিসির ঘোষণা করা পাইলট প্রকল্পে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেট সর্বনিম্ন ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে হবে।
এসব দাবি-দাওয়া নিয়ে সচিবালয়ে বৈঠকের পর ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী তৌসিব মাহমুদ সোহান বলেন, 'মন্ত্রণালয়ের কোনো গাফিলতি নেই, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কোনো দাবিই রাখেনি।
দ্বিতীয় ক্যাম্পাস নিয়ে আমাদের তিন দিনের আলটিমেটাম আমরা তুলে নিয়েছি। এখন আমাদের বোঝাপড়া হবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে। তারা কেন আমাদের হল ও দ্বিতীয় ক্যাম্পাস নিয়ে অসুবিধার কথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জানাল না; এর জবাব দিতে হবে। আমরা এত সহজে হাল ছাড়ছি না।'
মাকসুদুল হক নামে আন্দোলনকারীদের আরেকজন বলেন, 'মন্ত্রণালয় আমাদের দাবি মেনে নেওয়ায় আমাদের হিসাব-নিকাশ এখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইউজিসি কিংবা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কোনো যোগাযোগই করেনি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় আমাদের আবাসন ব্যবস্থা, দ্বিতীয় ক্যাম্পাস এবং বাজেট বৃদ্ধির ব্যাপারে আন্তরিক। তাই আমরা তিন দিনের দেওয়া আলটিমেটাম প্রত্যাহার করেছি। এখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছ থেকে প্রাপ্যটা বুঝে নেব।'
শিক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রইছ উদ্দীন বলেন, 'শিক্ষা মন্ত্রণালয় আমাদের শিক্ষার্থীদের সব যৌক্তিক দাবির সঙ্গে একমত। আগামীকাল থেকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কাজ শুরু করে দেব।
প্রজেক্ট ডিরেক্টরকে চেঞ্জ করে দ্রম্নতই সেনাবাহিনীর সাবেক দক্ষ একজন কর্মকর্তাকে প্রথমে পস্ন্যানিং ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে এবং পরে উনাকে প্রজেক্ট ডিরেক্টর করা হবে।'
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. রেজাউল করিম বলেন, 'দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ সেনাবাহিনীকে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা চলছে। আজ মন্ত্রণালয় শিক্ষার্থীদের সব দাবি সম্পর্কে একাত্মতা পোষণ করেছে। তারা আমাদের নির্দেশনা দিয়েছে, আমরা সে অনুযায়ী আমাদের কর্ম পরিকল্পনা এগিয়ে নিয়ে যাব।'
তেঘরিয়ায় ১৯২১ কোটি টাকার প্রকল্প
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে আবাসিক হলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের মাসব্যাপী আন্দোলনের মুখে কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়ায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনের সিদ্ধান্ত জানায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার।
অ্যাকাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন, আবাসন ব্যবস্থা, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, ক্যাফেটেরিয়া, খেলার মাঠ, চিকিৎসা কেন্দ্র, সুইমিংপুল, লেক নির্মাণসহ উন্নতমানের ক্যাম্পাস তৈরির মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে তেঘরিয়ার পশ্চিমদি মৌজায় ২০০ একর ভূমি অধিগ্রহণের অনুমোদন দেওয়া হয়।
২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর জমির চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় ভূমি মন্ত্রণালয়। ৯ অক্টোবর নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনে ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়নের জন্য প্রকল্প অনুমোদন করে একনেক। এক হাজার ৯২০ কোটি ৯৪ লাখ ৩৯ হাজার টাকার এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের অক্টোবরের মধ্যে।
২০১৯ সালের জুলাইয়ে নতুন ক্যাম্পাসের নকশাও দেখানো হয় ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। ওই বছরের জুলাইয়ে প্রায় ৯০০ কোটি টাকার চেক পায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
পরের বছর ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি মোট ২০০ একর জমির মধ্যে ১৮৮ দশমিক ৬০ একর জমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বুঝে পায়। কিন্তু এখনো অবশিষ্ট ১১ দশমিক ৪০ একর জমি বুঝে পায়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
চলতি বছরের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে তেঘরিয়া গিয়ে দেখা যায়, প্রায় এক তৃতীয়াংশ সীমানা প্রাচীরের কাজ এখনো বাকি আছে। লেক নির্মাণ শেষ হলেও তা এখনো বুঝে নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয়।
লেকের পাড়ে মাটি আটকে রাখার জন্য পাথর ব্যবহার করলেও বর্ষার বৃষ্টিতে এবং পাড়ে গবাদিপশু বিচরণের কারণে মাটি ধসে লেকের কিছু জায়গা আবার ভরাট হয়ে গেছে।
ইঞ্জিনিয়ারিং ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হলেও দরপত্র প্রক্রিয়ায় আটকে যায় মাটি ভরাটের কাজ। তবে ঘাট নির্মাণের কাজ হয়েছে। এ ছাড়া আর কোনো কাজই শুরু হয়নি।
প্রকল্পের মেয়াদ কয়েক দফা বাড়িয়ে তা সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। বর্ধিত সেই সময় শেষ হয়ে আরও পাঁচ মাস পার হয়েছে।
'দুর্নীতি করলে প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা'
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস নির্মাণকাজে প্রকল্প পরিচালকের দুর্নীতি থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
তিনি বলেন, 'চলমান প্রকল্প নিয়ে আমি তাদের অভিযোগ বুঝতে পারি। এত বছর ধরে প্রকল্পটা কেন হচ্ছে না, ভূমি অধিগ্রহণ কেন হয়নি, তারা বলছে যে, প্রকল্প পরিচালকের অনেক দুর্নীতি হয়েছে।
আমি বলেছি তদন্ত করে দেখুক, কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে সেই প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নতুন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হোক।'
উপদেষ্টা বলেন, 'তাদের ছোটখাটো কিচু দাবি আছে, সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সমাধান করা যেতে পারে। যেমন তারা চাচ্ছে এতদিন যত দুর্নীতি হয়েছে তার একটা হোয়াইট পেপার (শ্বেতপত্র)।
আমি বললাম, আমি তোমাদের জন্য কি পেপার তৈরি করব? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আছে, তারা তৈরি করবে।'