বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুলস্নাহ বলেছেন, কোনো ফ্যাসিবাদীদের এদেশে আর ঠাঁই হবে না। আওয়ামী লীগের মতো ফ্যাসিস্ট দল ও খুনি শেখ হাসিনাকে বিচারের আগে এদেশে রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না। তাদের এদেশে আনা হবে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর জন্য। এই খুনি হাসিনা বাংলাদেশে আর কখনো রাজনীতি করতে পারবে না। রোববার রাজধানীর জিরো পয়েন্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গণজমায়েতে এ ঘোষণা দেন তিনি।
এদিকে, শহীদ নূর হোসেন দিবস উপলক্ষে সদ্য ক্ষমতাচু্যত আওয়ামী লীগ ঢাকার জিরো পয়েন্টে বিক্ষোভ-কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিলেও রোববার দিনভর তারা এর আশপাশেও জড়ো হতে পারেনি। এর আগেই একই স্পটে গণজমায়েত কর্মসূচির ডাক দিয়ে শনিবার মধ্যরাত থেকে গোটা এলাকা দখলে নেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তাদের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংগঠনের নেতাকর্মীও ওই গণজমায়েতে যোগ দেয়। তাদের নানা স্স্নোগানে গুলিস্তান-বায়তুল মোকাররম ও ফুলবাড়িয়া এলাকা উত্তাল হয়ে ওঠে।
এ সময় তারা জিরো পয়েন্টে ও এর আশপাশের এলাকায় আওয়ামী লীগ কিংবা এর অঙ্গ সংগঠনের কোনো নেতাকর্মীকে দেখামাত্র বেধড়ক পিটুনি দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী সন্দেহে শনিবার মধ্যরাত থেকে রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত অন্তত ২০ জনকে গণধোলাই দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এ সময় নিরীহ কিছু পথচারীও হয়রানির শিকার হন। বেলা ১১টার কিছু আগে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বেশ কয়েকজনকে বেধড়ক পেটাতে দেখা গেছে। তাদের মধ্যে কয়েকজনের পোশাক খুলে ও ছিঁড়ে যায়। নানা উত্তেজিত স্স্নোগান দিয়ে একদল লোক তাদের গণপিটুনি দেয়। একজনকে পেটানোর সময় পুলিশকে উপস্থিত থাকতে দেখা যায়। যাদের পেটানো হয়েছে, তাদের কয়েকজনকে পুলিশকে নিয়ে যেতে দেখা যায়। ঘটনাস্থলের চারদিকে শনিবার মধ্যরাত থেকে পুলিশ সতর্ক অবস্থায় থাকলেও সেখানে বড় ধরনের কোনো বিশৃঙ্খলা না হওয়ায় তাদের অ্যাকশনে নামতে হয়নি।
এদিকে গত শুক্রবার আওয়ামী লীগ নিজেদের ফেসবুক পেজে জিরো পয়েন্টে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই জনমনে চরম আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়। ফলে রোববার ঢাকা মহানগরীর ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প কারখানা থেকে শুরু করে সব ধরনের কর্মক্ষেত্রে স্থবিরতা দেখা দেয়। নগরীতে দিনভর ব্যক্তিগত যানবাহনের পাশাপাশি গণপরিবহণ চলাচলও ছিল খুবই কম। ফলে সকাল ও বিকালের পিকআওয়ারে কর্মজীবী মানুষকে পরিবহণ সংকটের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। দূরপালস্নার পথেও খুবই নগণ্য সংখ্যক পরিবহণ চলাচল করে।
গণপরিবহণ মালিকদের দাবি, যাত্রী সংকটের কারণে তারা দূরপালস্নার রুটের নিয়মিত ট্রিপের অধিকাংশই বাতিল করতে হয়েছে। তবে ভুক্তভোগীদের অনেকের অভিযোগ, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ঢাকার জিরো পয়েন্টে বিক্ষোভ-কর্মসূচিতে যোগ দিতে পারে এ আশঙ্কায় বিএনপি-জামায়াত কৌশলে গণপরিবহণের সব ট্রিপ চালু রাখতে দেয়নি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রগুলো জানায়, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মী সন্দেহে অন্তত ৫০ জনকে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে ছাত্র-জনতা। এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা নিয়ে রাস্তায় নেমে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টির পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত ৫০ জনকে গ্রেপ্তার
করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থানের কারণে দিবসটি ঘিরে বড় ধরনের কোনো অপ্রীতিকর ও নাশকতার ঘটনা ঘটেনি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, শহীদ নূর হোসেন দিবসের কর্মসূচি পালনকে পূঁজি করে আওয়ামী লীগ ও দলটির অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী রোববার মাঠে নামছে- এমন একটি টেলিফোন কথোপোকথন শুক্রবার বিভিন্ন মাধ্যমে ফাঁস হয়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে শনিবার রাত ১১টা থেকেই ছাত্র-জনতা গুলিস্তান জিরো পয়েন্টের শহীদ নূর হোসেন চত্বরে জড়ো হতে থাকে। রাত সাড়ে ১১টায় দুই যুবককে ছাত্রলীগ নেতাকর্মী সন্দেহে ছাত্র-জনতা গণধোলাই দিয়ে সচিবালয়ের পাশে থাকা টহল পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। রাতভর সেখানেই অবস্থান নেয় ছাত্র-জনতা। এদিকে এসব খবর সামাজিক যোগাযোগসহ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে মানুষের মধ্যে রীতিমতো আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
এদিকে নূর হোসেন দিবস উপলক্ষে রাজধানীর জিরো পয়েন্টে আওয়ামী লীগের ডাকা বিক্ষোভ সমাবেশ প্রতিহত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে শোডাউন করে বিক্ষোভ মিছিল করে ছাত্রদলের নেতাকর্মী। রোববার দুপুরে এ শোডাউন করেন তারা। পরে একটি মিছিল নিয়ে টিএসসিতে গিয়ে অবস্থান নেয়। সেখানে নেতাকর্মী আওয়ামী লীগবিরোধী মুহুর্মুহু স্স্নোগান দিতে থাকেন। আওয়ামী লীগকে কোনোভাবেই প্রকাশ্যে মিছিল-সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তারা। পাশাপাশি বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ারও ঘোষণা দেন নেতাকর্মী। সকাল থেকে গুলিস্তানের বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দলে দলে জড়ো হতে থাকেন বিএনপির নেতাকর্মী।
এদিকে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে জিরো পয়েন্টে আওয়ামী লীগ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পাল্টাপাল্টি অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দিলেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ছোটখাটো মিছিল নিয়েও সেখানে আসতে সাহস পায়নি।
তবে বিকাল ৪টায় মতিঝিল বিআরটিসি বাস ডিপোর পাশ থেকে ঢাকা দক্ষিণ আওয়ামী লীগ ও বাড্ডা থানা আওয়ামী লীগের ব্যানারে কিছু নেতাকর্মী বিক্ষোভ শুরু করেন। তবে ঝটিকা মিছিল করে কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যানার গুছিয়ে নিয়ে তারা সটকে পড়েন।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জানানো হয়, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সামনে থেকে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের আরেকটি বিক্ষোভ মিছিলে যুবলীগসহ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী যোগ দেন। মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংকের উল্টো পাশের গলি থেকে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে জিরো পয়েন্টের দিকে অগ্রসর হলে পথে বিএনপির নেতাকর্মীদের ধাওয়ায় তারা নূর হোসেন চত্বরে পৌঁছাতে পারেননি। এতে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। তবে এই ঘটনার সত্যতা তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি এবং এ বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে শহীদ নূর হোসেন দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের ডাকা বিক্ষোভ মিছিলের প্রতিবাদে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সমাবেশ করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। রোববার সকালে রাজধানীর জাতীয় মসজিদ বাইতুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে সমাবেশের জন্য মঞ্চ তৈরি করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। মাইক লাগানো হয় গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম, পল্টন মোড়সহ আশপাশের এলাকায়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুলস্নাহ বলেন, কোনো ফ্যাসিবাদীদের এদেশে আর ঠাঁই হবে না। আওয়ামী লীগের মতো ফ্যাসিস্ট দল ও খুনি শেখ হাসিনাকে এদেশে ১০০ বছরেও রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়া হবে না। তাদের এদেশে আনা হবে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর জন্য। তাদের বিচারের মুখোমুখি হতেই হবে। কিন্তু এই খুনি হাসিনা বাংলাদেশে আর কখনো রাজনীতি করতে পারবে না। তারা আজকে যে কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছে, আমরা কোনোভাবেই সেই কর্মসূচি সফল হতে দেব না। শুধু রাজধানীর জিরো পয়েন্টেই নয় সারা দেশের কোথাও তাদের দাঁড়াতে দেওয়া হবে না।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলাম বলেন, আওয়ামী লীগের মতো ফ্যাসিস্ট দল ও খুনি শেখ হাসিনাকে এদেশে রাজনীতি করার কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না। তাদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো হবে। তারা বলেছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করবে। আমরা ভাঙচুর করলে সেগুলোর ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে পাঠানো হবে। তারা হয়তো জানে না আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি বদলায় না। এখন তাদের সময় আছে আমেরিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের জ্ঞান নেওয়ার। তাই তাদের বলব আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে আপনারা জানুন। ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। শুধু রাজধানীর জিরো পয়েন্টেই নয় দেশের কোথাও এই ফ্যাসিস্টদের দাঁড়াতে দেওয়া হবে না।
সরেজমিন জিরো পয়েন্ট এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সকাল ১০টা থেকে সেখানে অবস্থান নিয়েছেন। এ সময় 'আমার সোনার বাংলায়, ফ্যাসিবাদের ঠাঁই নাই', 'একটা একটা লীগ ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর', 'দিয়েছি তো রক্ত আরও দেব রক্ত'সহ নানান স্স্নোগান দিতে থাকেন তারা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, 'যারা ফ্যাসিবাদকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল, আমার ভাই-বোনদের হত্যা করেছিল, তাদের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় নেই। আমরা এই দেশে আর কখনো লীগের পুনর্বাসন চাই না। সেজন্যই আজ আমাদের এই অবস্থান কর্মসূচি।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আজিজুল হাকিম বলেন, 'নির্বিচারে ছাত্র-জনতা হত্যার এখনো ঠিকমতো তিন মাস পেরোয়নি। আওয়ামী লীগ আবার রাজপথে নামতে চাইছে। তারা এত সাহস পায় কীভাবে। আমরা ছাত্ররা সবসময় প্রস্তুত আছি তাদের প্রতিহত করার জন্য।'
খিলগাঁও মডেল কলেজের শিক্ষার্থী আইয়ুব আনসারী বলেন, 'আমার ভাইয়ের রক্তে এই সড়ক ভিজেছে। তাদের জীবনের বিনিময়ে এই দেশ ফ্যাসিবাদমুক্ত হয়েছে। আমরা তাদের জীবনের বিনিময়ে পাওয়া এই স্বাধীনতা বৃথা যেতে দেব না। ফ্যাসিবাদী শক্তি আওয়ামী লীগ যদি আবার ফিরতে চায় আমরা আমাদের জীবন দিয়ে হলেও তাদের দমন করব ইনশাআলস্নাহ।'
এদিকে সমাবেশ ঘিরে সতর্ক অবস্থানে দেখা গেছে পুলিশকে। সচিবালয় রোডের সামনে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনের উপস্থিতি ছিল। পুলিশের একটি সাঁজোয়া যানও রাখা হয় সেখানে।
রোববার সরেজমিন ঢাকার বিভিন্ন সড়ক এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রাস্তায় তেমন কোনো যানবাহনের চাপ নেই। এমনকি গণপরিবহণের সংখ্যাও একেবারেই কম। সড়কে সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস উপলক্ষে যে সংখ্যক ব্যক্তিগত পরিবহণ থাকে, তার এক-তৃতীয়াংশেরও কম যানবাহন দেখা গেছে। তবে মিরপুরের পলস্নবী বাসস্ট্যান্ড থেকে গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, পোস্তোগোলা, কাজলা, ডেমরাসহ আশপাশের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া বাসগুলোর অধিকাংশই আটকা পড়ে শাহবাগে মোড়ে গিয়ে। এ সময় অনেক বাস ঘুরিয়ে কাঁটাবন হয়ে নীলক্ষেত মোড় হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এসব বাসের অধিকাংশই কাঁটাবন মোড়ে আটকা পড়ে। আবার কিছু কিছু বাস আটকা পড়ে নীলক্ষেত মোড়ে। এ ছাড়া বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তায় কাঁটাতারের ব্যারিকেড দেওয়া ছিল। ফলে এ সড়ক চলাচলকারী যানবাহন বুয়েটের ভেতর দিয়ে চলাচল করে। এ ছাড়া গণপরিবহণগুলো পলাশী মোড় হয়ে লালবাগ সড়কের ঢাকেশ্বরী মন্দির এবং মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের রাস্তা দিয়ে বকশী বাজার মোড় হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। অনেক বাস নিচ দিয়ে না গিয়ে হানিফ ফ্লাইওভারে উঠে যানজটে আটকা পড়ে। আর যেসব বাস নিচ দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল, সেগুলো আটকা পড়ে ঢাকা চাঁনখারপুল মোড় ও বঙ্গবাজার মোড়ে।
এদিকে শাহবাগ পাঁচ তারকা হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের (সাবেক শেরাটন) সামনে দিয়ে বামদিকে মোড় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। সেখানে কাঁটাতারের ব্যারিকেড ফেলে তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে রাখে পুলিশ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বাসভবন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনের রাস্তা এবং শাহবাগ থেকে বামদিকের মোড় হয়ে প্রধান বিচারপতির বাসভবন পর্যন্ত ৭টি চেকপোস্ট বসানো হয়। প্রতিটি চেকপোস্টে সেনাবাহিনী সদস্য ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অবস্থান করতে দেখা গেছে। তবে রাস্তায় যানবাহন কম থাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও পায়ে চালিত রিকশা চলতে দেখা গেছে বেশকিছু ভিআইপি সড়কে।
এ ছাড়া হাইকোর্টের সামনে কদম ফুল ফোয়ারা, দোয়েল চত্বর, জাতীয় প্রেস ক্লাব, পুরানা পল্টন মোড়, নয়া পল্টন মোড়, কার্জন হলের সামনে, সচিবালয়ের সামনেসহ আশপাশের সব সড়কে বসানো হয়েছিল চেকপোস্ট। বেশ কয়েকটি চেকপোস্টে সেনা সদস্যদের পাশাপাশি পুলিশকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। নূর হোসেন দিবস উপলক্ষে ছাত্র-জনতা গণজমায়েত মঞ্চ তৈরি করেছিল জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটের রাস্তার ওপর। যে কারণে ওই এলাকায় আড়াইটা পর্যন্ত কোনো ধরনের যানবাহন চলাচল করতে পারেনি। জিরো পয়েন্ট থেকে পুরান ঢাকার রায় সাহেব মোড় হয়ে বাসের দীর্ঘ সারি যাত্রাবাড়ী গিয়ে ঠেকেছে বলে স্থানীয়রা জানান। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসগুলো সেখানে যানজটে আটকে ছিল। গণজমায়েত মঞ্চ ঘিরে চারদিকে অন্তত এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কোনো ধরনের যানবাহন দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত চলাচল করতে পারেনি। দুপুর আড়াইটার পর মঞ্চের সামনে ছাত্র-জনতার উপস্থিতি কমতে থাকলে ট্রাফিক পুলিশ যানবাহন চলাচলের অনুমতি দেয়। এসব যানবাহন শুধু পুরান ঢাকার রায় সাহেব বাজার মোড় হয়ে বিভিন্ন দিকে যেতে পেরেছে বলে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা জানান। কারণ গণজমায়েত মঞ্চ রাস্তার ওপরে হওয়ায় ওই এলাকার সঙ্গে যুক্ত সব সড়কে কোনোভাবেই যানবাহন চলাচল করতে পারেনি। মঞ্চের আশপাশে সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যান, পুলিশের সাঁজোয়া যান এবং জল কামানসহ আপৎকালীন মুহূর্ত মোকাবিলা করতে বিভিন্ন যানবাহন প্রস্তুত রাখা হয়। এ ছাড়া আশপাশে অবস্থান করতে দেখা গেছে সেনাবাহিনীসহ পুলিশের বিপুল সংখ্যক সদস্যকে। মঞ্চের চারদিকে অন্তত আধা কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এমন প্রস্তুতি ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক প্রস্তুতি এবং সতর্কতার কারণে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর বা নাশকতার ঘটনা ঘটেনি।
দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত মঞ্চের আশপাশের অবস্থান করা তিনজনকে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মী সন্দেহে ধরে গণপিটুনি দেয় ছাত্র-জনতা। পরে তাদের সচিবালয়ের সামনে ট্রাফিক পুলিশ বক্সের পাশে থাকা টহল পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এর আগেও তিনজনকে এভাবেই ধরে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে ছাত্র-জনতা। যদিও রোববার রাত থেকে সোমবার দুপুর পর্যন্ত ছাত্র-জনতার হাতে গণপিটুনির শিকার হওয়া ৮ জনের নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। পুলিশ জানিয়েছে, ছাত্র-জনতার তরফ থেকে হস্তান্তর করাদের নাম-পরিচয় শনাক্ত করার কাজ চলছে।
সোমবার ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপ-কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমানের ভাইরাল হওয়া অডিও ক্লিপের বরাত দিয়ে জানান, সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার একটি অডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়। ভাইরাল হওয়া সেই অডিও ক্লিপে দেশকে অস্থিতিশীল করার বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়। পরিকল্পনা মোতাবেক বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার দলের নেতাকর্মীদের নূর হোসেন দিবসের কর্মসূচি উপলক্ষে মাঠে নামতে বলা হয়। আর নেতাকর্মীদের হাতে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের ছবি ও যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা ব্যবহার করে অবৈধ মিছিল সমাবেশের কথা বলা হয়।
তিনি আরও জানান, ছবি ও পস্ন্যাকার্ডগুলো ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার নির্দেশ প্রদান করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে সেগুলো ভাঙচুর ও অবমাননার ফুটেজ সংগ্রহের নির্দেশনা দেওয়া হয়। বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের সুসম্পর্ক বিনষ্টের অপচেষ্টার অংশ হিসেবে তারা এই অপতৎপরতার পরিকল্পনা করেছেন বলে মনে করা হয়। শেখ হাসিনার ভাইরাল হওয়া সেই অডিও ক্লিপের নির্দেশনা বাস্তবায়নে জড়িত থাকার অভিযোগে ৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
উপ-কমিশনার তালেবুর রহমান জানান, গোয়েন্দা তথ্যের সূত্র ধরে শনিবার রাতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ওই দশজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারদের কাছে পাওয়া গেছে বিপুল পরিমাণ উসকানিমূলক পোস্টার, ছবিসহ পস্ন্যাকার্ড ও নগদ টাকা। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের যে কোনো চক্রান্ত রুখে দিতে প্রস্তুত রয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। এসব অপকর্মের উসকানিদাতা, টাকার জোগানদাতা ও জড়িতদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত থাকবে। গ্রেপ্তারদের মধ্যে তিনজনের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। বাকিদের বিষয়ে তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে তাদের ছবিসহ যাবতীয় তথ্য প্রকাশ করা হবে।