কারখানার বাইরে তালা ভেতরে পলিথিন তৈরি
গভীর রাতে সচল হয় কারখানা চাহিদা বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে দাম এ ব্যবসা ঘিরে সক্রিয় সিন্ডিকেট
প্রকাশ | ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
গাফফার খান চৌধুরী
কারখানার বাইরে তালা লাগিয়ে ভেতরে দেদার তৈরি হচ্ছে নিষিদ্ধ পলিথিন। যদিও আগের মতো ২৪ ঘণ্টাই সচল রাখা হচ্ছে না কারখানাগুলো। দিনের অধিকাংশ সময় কারখানা বন্ধ থাকছে। রাত যত গভীর হচ্ছে, কারখানাগুলোয় ততই বেশি উৎপাদন বাড়ছে পলিথিনের। বাজারে পলিথিনের চাহিদা বাড়ায় দামও বাড়ছে পালস্না দিয়ে। নিষিদ্ধ এই পণ্যটিকে ঘিরে এলাকাভিত্তিক গড়ে উঠেছে ছোট-বড় নানা ধরনের সিন্ডিকেট। তারা প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
শুক্রবার সরেজমিন রাজধানীর হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর, লালবাগ, ইসলামবাগ, শহীদনগর, কামালবাগ, চকবাজারসহ আশপাশের এলাকা ঘুরে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। কামরাঙ্গীরচরের পূর্ব রসুলপুর বাজারের মূল সড়কে গিয়ে রীতিমতো চক্ষু চড়কগাছ। সেখানে দেদার প্রকাশ্যে প্রতিটি দোকানে বিক্রি হচ্ছে নানা আকারের নিষিদ্ধ পলিথিন। কয়েকজন দোকানির সঙ্গে কথা হয়। তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকার পলিথিন নিষিদ্ধ করেছে। তবে তা কাগজে কলমে। বাস্তবে কোনোদিনই পলিথিন নিষিদ্ধ করে বাজার থেকে তুলতে পারবে না। কারণ পলিথিনের বিকল্প হিসেবে এমন কোনো ব্যাগ বা হালকা বহনযোগ্য কিছু দিতে হবে। যার দাম কম ও সহজলভ্য হবে। তবেই পলিথিনের ব্যবহার কমবে। তাছাড়া পলিথিনের ব্যবহার কমবে না।
ওই ব্যবসায়ী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'পলিথিন ক্ষতিকর। এটি সত্য। আমরাও চাই পলিথিন নিষিদ্ধ থাক। এমনকি পলিথিন দেশ থেকে উঠে যাক। তাহলে বিকল্প হিসেবে সরকার এমন কিছু বাজারে ছাড়ুক, যাতে মানুষের কষ্ট না হয়। ব্যবসায়ীরাও আর পলিথিন বিক্রি করবে না। ক্রেতাদেরও আর পলিথিনের প্রয়োজন হবে না। পলিথিনে শপিং ব্যাগের কথা বলা হচ্ছে। এই ব্যাগ সহজেই পচে না। কিন্তু তার চেয়েও ভয়াবহ
জিনিস হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের বিস্কুট, চিপস, চানাচুরসহ এ জাতীয় নানা খাবার। এসব খাবার প্যাকেটজাত করতে যে পলিথিন ব্যবহৃত হয়, তা ৫০ বছরেও পচে না। অথচ চিপস, চানাচুর বা বিস্কুট কোম্পানিগুলোয় এমন ক্ষতিকর পলিথিনের প্যাকিং না করার ব্যাপারে তেমন কোনো তৎপরতা লক্ষ করা যায় না। যেটি বৈষম্যমূলক।'
কামরাঙ্গীরচর বাজারের বড় ব্যবসায়ী আজমল বলেন, 'আমার দোকানে যা কিছু আছে তা পলিথিন দিয়ে প্যাকিং করা। আমি নিজেও পলিথিন খুচরা ও পাইকারি হারে বিক্রি করি। আগে এক রোল পলিথিন কিনতে লাগত ৪৭০ টাকা। এখন সেই একই রোলের পলিথিন কিনতে বাড়তি ৫০ টাকা গুনতে হচ্ছে। প্রতি রোলে সোয়া ২ কেজি পলিথিন থাকে। পলিথিনের আকারের ওপর দাম নির্ভর করে না। পলিথিনের মানের ওপর দাম নির্ভর করে। মূলত কেজি হিসেবে পলিথিন বিক্রি হয়। সরকার পলিথিন নিষিদ্ধ করার পর প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় মহলস্নায় মহলস্নায় এবং কারখানা মালিক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা রীতিমতো সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। তাদের এক কথা। নিষিদ্ধ পলিথিন তাদের কাছে নেই। তাদের কাছে থাকলেও তা স্বীকার করছে না।'
সিন্ডিকেটগুলোর দাবি, তাদের জানামতে বিভিন্ন জায়গায় আছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা সরাসরি কিনতে গেলে তাদের দেয় না। তারা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের সদস্যদের কাছে বিক্রি করছে। কারখানা মালিকরাও বেশি দামে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট সদস্যদের কাছে বিক্রি করে বাড়তি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আর ব্যবসায়ী খুচরা ক্রেতাদের কাছেও বেশি দামে বিক্রি করে অবৈধভাবে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। প্রতিটি এলাকায় এমন সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। কোনো কোনো ব্যবসায়ী টনে টনে পলিথিন কিনে মজুদ করে রেখেছেন গোপন জায়গায়। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করছে। কামরাঙ্গীরচরে অন্তত ২৫ থেকে ৩০টি পলিথিন তৈরির কারখানা ছিল। ইতোমধ্যে ১৫টি বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি কারখানাগুলো তাদের কাজ বন্ধ করে রেখেছে। তবে পুরোপুরি বন্ধ করেনি। রাত গভীর হলে অল্প সময়ে বেশি শ্রমিক দিয়ে অধিকহারে পলিথিন উৎপাদন করে গোপন গোডাউনে মজুদ করছে। এমনকি কোনো মাঝারি ধরনের ব্যবসায়ীদের কাছেও পাইকারি হারে পলিথিন বিক্রি করছে না। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পলিথিন হাতবদল হচ্ছে।
কামরাঙ্গীরচরের পাশেই বুড়িগঙ্গা নদীর ধারে দেখা গেল, অনেক নারী-পুরুষ ময়লা-আবর্জনা হিসেবে ফেলে দেওয়া পলিথিন বাছাই করছেন। তাদের সঙ্গে কথাবার্তার এক পর্যায়ে তারা জানান, নদীর ঢালের অংশগুলোর মহাজন বা মালিক আছে। সেই মহাজনের সংখ্যা কয়েকশ'। ২০ বা ৩০ ফুট প্রস্থের নদীর পাড় থেকে তলা পর্যন্ত ওইসব মহাজনের নিয়ন্ত্রণে থাকে। এজন্য তারা স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে। সেখানে বিভিন্ন বাসাবাড়ি থেকে আনা ময়লা ফেলা হয়। এসব ময়লা কিনে নেন মালিক। ময়লাগুলো ভ্যানের চালকদের কাছ থেকে অল্প টাকা কেনেন। এ ছাড়া ঢাকা সিটি করপোরেশনের ময়লা ট্রাকগুলোর ময়লাও কিনে নেন তারা। সেসব ময়লা ক্রেতার নির্ধারিত জায়গায় ফেলা হয়। সেখানে বসে পলিথিন বাছাই করেন নারী-পুরুষরা। প্রতিদিন একজন নারী ময়লা থেকে পলিথিন বাছাই বাবদ দিনে ৩০০ টাকা করে পান। তবে শর্ত অনুযায়ী ওই নারীকে অন্তত ৫০ থেকে ৬০ কেজি পলিথিন বাছাই করে দিতে হবে। প্রতি কেজি পলিথিন কারাখানাগুলো ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় কিনে নেয়। রং অনুযায়ী পলিথিন বাছাই করতে হয়। লাল, সাদা, কালো, নীল বা অন্য কোনো রঙের পলিথিন আলাদা আলাদা করা হয়। বাছাই করা পলিথিন চলে যায় লালবাগ, ইসলামবাগ, কামালবাগ, কামরাঙ্গীরচর, চকবাজারসহ আশপাশের এলাকায় থাকা বিভিন্ন কারখানায়। সেখানে পলিথিনগুলো মেশিনে দিয়ে গুঁড়া বা পাউডার বানানো হয়। প্রতি পাউন্ড পাউডারে ছোট-বড় অন্তত ১ হাজার পিস পলিথিন তৈরি হয়। বর্তমান বাজার মূল্য অনুযায়ী প্রতি কেজি পলিথিন বিক্রি হচ্ছে ৫২০ টাকায়।
পলিথিন বাছাই করা এক নারী বলেন, এই ময়লা ব্যবসার বিশাল সিন্ডিকেট আছে। ঢাকার এমন কম ময়লাই আছে, মূলহীন। শতকরা ৯৮ ভাগ ময়লা বিক্রি হয়। ক্রেতার সংখ্যাও অনেক। এমনকি হাসপাতালের বর্জ্য বিক্রি হয় সবচেয়ে বেশি দামে। যেটি হয়তো অনেকেই সাধারণ চোখে দেখতে বা বুঝতেই পারেন না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগসাজশ করে একটি চক্র শুধু হাসপাতালের বর্জ্য কিনে নেয়। যাদের অধিকাংশই লালবাগের বড় বড় ভাঙারি ব্যবসায়ী। মানুষের মল ব্যতীত সব বর্জ্যই বিক্রি হয়। হাসপাতালের বর্জ্যগুলো কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বছরভিত্তিক চুক্তি করে কিনে নেয়। সেই বর্জ্য চলে যায় কারখানায়। সেখানে ব্যবহৃত সব বর্জ্য আলাদা আলাদা করা হয়। মান অনুযায়ী বাছাই করা বর্জ্য কেমিক্যাল দিয়ে গলিয়ে তৈরি করা হয় উন্নতমানের পস্নাস্টিক সামগ্রী। এমনকি কোনো কোনো কোম্পানি হাসপাতালে ব্যবহৃত নানা চিকিৎসা সরঞ্জামও উৎপাদন করে। সেসব সরঞ্জাম আবার হাসপাতালেই সরবরাহ করা হয়ে থাকে।
লালবাগ থানাধীন শহীদ নগরের একটি বিশাল কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, গেটে চারটি তালা ঝুলছে। অথচ ভেতর থেকে মানুষের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। অপেক্ষার এক পর্যায়ে একটি বড় ভ্যানে করে ভাঙারির জিনিসপত্র আসে। দরজায় টোকা দিতেই ভেতর থেকে গেট খুলে দেওয়া হয়। বাইরে কোনো সাইনবোর্ড নেই। ভেতরে তাকিয়ে রীতিমতো অবাক হওয়ার মতো অবস্থা। হাজার হাজার বস্তা ভাঙারি সামগ্রী কারখানার নিচতলা থেকে শুরু করে দ্বিতীয় তলার ছাদ পর্যন্ত মজুদ করা। প্রথমে কথা বলতে রাজি না হলেও শেষ পর্যন্ত তিনি নানা বিষয়ে কথা বলেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই ব্যক্তি বলছিলেন, কোম্পানিটি অন্তত একশ' কোটি টাকার জমির ওপর নির্মিত। কোম্পানির মূল কাজই হচ্ছে হাসপাতালের বর্জ্য সংগ্রহ করা। বছরভিত্তিক চুক্তি করে ঢাকার বড় বড় হাসপাতালের বর্জ্য কিনে নেন তিনি। এরপর সেসব বর্জ্য বাছাই করে আলাদা করা হয়। রং অনুযায়ী বর্জ্য আলাদা করে তা গলিয়ে তৈরি করা নানা উন্নতমানের পস্নাস্টিক সামগ্রী। দেখতে বিদেশি জিনিসের চেয়েও সুন্দর। তবে এসব করা হয় ব্যবহৃত বর্জ্য থেকে। ব্যবহৃত বর্জ্য থেকে পস্নাস্টিক সামগ্রী বা চিকিৎসা সামগ্রী কতটুকু নিরাপদ সে বিষয়ে তেমন কিছু্ই বলতে পারছি না। আমি শুধু এখানে কাজ করি।
তিনি বলেন, ব্যবহৃত জিনিস দিয়ে আবার নতুন করে জিনিস বানানো হয়। স্বাভাবিক কারণেই সেটি ক্ষতিকর হওয়ার সম্ভবনাই বেশি। তবে আমি যেহেতু বিশেষজ্ঞ না, তাই এ ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত করে কিছুই বলতে পারছি না। কোম্পানির মালিকের খোঁজ করতেই তিনি জানান, মালিক সাধারণত আসেন না। অপরিচিত কারও ফোন নম্বরও ধরেন না। শুক্রবার হওয়ায় অফিসে গিয়েও কাউকে পাওয়া যায়নি। এই কারখানায় তৈরি করা অনেক ছোটখাটো চিকিৎসা সরঞ্জাম যেমন ইনজেকশনের সিরিঞ্জ, সেলাইনের পাইপ, সেলাইনের ব্যাগ, প্রস্রাব পরীক্ষার জন্য যে পস্নাস্টিকের বোতল বা জারে মূত্র জমা করা হয়, পায়খানা বা টুলস জমা করার সরঞ্জামও তৈরি হয়। তারা শুধু জারগুলো তৈরি করে দেয়। অনেক কোম্পানি আছে তা এসব তৈরি করে নিয়ে নিজেদের মতো করে তাদের কারখানায় সিল দেয়। দেখতে বিদেশি কোম্পানির জিনিসের চেয়েও ভালো দেখায়। এসব চিকিৎসা সরঞ্জাম আবার অনেক হাসপাতালে সাপস্নাই বা বিক্রি হয়ে থাকে।
কামালবাগের কয়েকটি কারখানায় গিয়ে দেখা গেছে, গেটে একাধিক তালা ঝোলানো। ডাকাডাকির এক পর্যায়ে তিনটি কোম্পানি তাদের মূল গেট খুলে। তাদের সঙ্গে কথা হয়। তারা বলেন, শুধু কামালবাগেই অন্তত এক হাজার পলিথিন কারখানা আছে। পলিথিন নিষিদ্ধ করার পর দিনের বেলায় অধিকাংশ কারখানা বন্ধ রাখা হয়। দরজায় লাগিয়ে রাখা হয় একাধিক তালা। যাতে বাইর থেকে কেউ বুঝতে না পারে, ভেতরে কারাখানা চলছে। সন্দেহজনক হলে গেট সাধারণত খোলা হয় না। তবে কাউকে সন্দেহ না হলে গেট খুলে দেই। কাস্টমার ভেবে দরজা খুলেছেন বলে জানান। কামালনগর মেইন রোডসংলগ্ন একটি কারখানার মালিক বলছিলেন, আমরা রীতিমতো নিরুপায়। কারণ বাড়ির মালিকরা ভাড়া দিতে চায় না। আবার ভাড়া দিলেও ভাড়া বেশি। আমাদেরও আর কোনো বিদ্যা নেই, যেটা বিদ্যা কাজে লাগিয়ে আমরা কিছু করে খাব। সরকার পলিথিন নিষিদ্ধ করেছে। ভালো কথা। তবে পলিথিনের বিকল্প এমন কিছু বাজারে ছাড়ুক যাতে সবার উপকার হয়। দেশের পরিবেশ ভালো থাকে। শপিং ব্যাগের কথা বলা হচ্ছে। শপিংব্যাগ তৈরির কারখানার চেয়ে পলিথিন উৎপাদনকারী কারাখানাগুলোকেই বেশি ধরছে। আবার অনেক সময় অভিযান চালালেও দুই তিনটি কারখানায় গিয়েই অজ্ঞাত কারণে অভিযান থেমে যাচ্ছে। কে বা কি কারণে থেমে যাচ্ছে তাও বোধগম্য না। থানকাপড়, জুতা থেকে শুরু করে মুদি দোকান এমন কোনো ব্যবসা নেই, যেখানে পলিথিনের ব্যবহার নেই। এমনকি ফ্রিজে মাছ-মাংস রাখতেও পলিথিনের বিকল্প নেই। ইতোপূর্বেও সরকার বহুবার পলিথিন নিষিদ্ধ করেছে। তবে কার্যকর করতে পারেনি। কারণ বাজারে পলিথিনের বিকল্প কিছুই সহজলভ্য করতে পারেনি। যে কারণে পলিথিন মুক্ত হচ্ছে না দেশ। ভবিষ্যতেও দেশ পলিথিন মুক্ত হবে না, এটি প্রায় শতভাগ নিশ্চিত।
পস্নাস্টিকের পাউডার প্রস্তুতকারক একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মূলত তিন ধরনের পলিথিন তৈরি হয়। যার মধ্যে পিপি ও এলডিপি খুবই স্বচ্ছ ও পাতলা। এর মধ্যে পিপি ক্যাটাগরির পলিথিনটি মাটিতে বা যে কোনো জায়গায় ফেলার তিন থেকে চার মাসের মধ্যে পচে পানি বা মাটির সঙ্গে মিশে যায়। এলডিপি ক্যাটাগরির পলিথিন গলতে আরও দুই থেকে তিনমাস সময় বেশি লাগে। তবে এসডিপি ক্যাটাগরির পলিথিন ৫০ বছর পরও কিছুই হয় না। পানি বা মাটিতেও পচে না। এসডিপি ক্যাটাগরির পলিথিন উৎপাদন খরচ খুবই কম। স্বাভাবিক কারণে এর দামও অনেক কম। যে কারণে এই ক্যাটাগরির পলিথিন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সারা দেশে সবচেয়ে বেশি এসডিপি ক্যাটাগরির পলিথিন কারখানা বেশি। এই পলিথিন মাটি নিচে চাপা পড়ে না পচার কারণে আম থেকে শুরু করে নারিকেল বা ডাব সব ফলেরই আকার দিনকে দিন ছোট হয়ে আসছে। এটি যেভাবেই হোক রোধ করতে হবে।
তিনি বলেন, পলিথিন কারখানা ব্যাঙের ছাতার মতো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে যেসব এলাকায় মিল কারখানা বেশি, সেখানে অত্যধিক পরিমাণে পলিথিন কারখানা গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে টঙ্গী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, খুলনাসহ পুরো প্রায় সারা দেশেই পলিথিন তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে শিল্প এলাকায় পলিথিন কারখানার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। পলিথিন উৎপাদন বন্ধ বা পলিথিন নিষিদ্ধ করার চেয়েও জরুরি বিষয় হচ্ছে, পলিথিনের ব্যবহার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা। এসডিপিসহ সব ধরনের পলিথিন ব্যবহারের পর তা একটি নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা উচিত। সেই ছাই পরিত্যক্ত জমিতে গর্ত করে পুঁতে রাখতে হবে। এতে পরিবেশের ক্ষতি কিছুটা হলেও কম হবে। অধিকাংশ মানুষই পলিথিন ব্যবহার করে। তবে ব্যবহারের পর তা ধ্বংস করে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে বা পুঁতে রাখে না। এজন্য পলিথিন পুরো দেশকে এক প্রকার খেয়ে ফেলছে।
ঢাকার চকবাজারে অবস্থিত বাংলাদেশ পস্নাস্টিক ব্যবসায়ী সমিতির তালিকাভুক্ত শীর্ষ ব্যবসায়ী হোসেন (ছদ্মনাম) যায়যায়দিনকে বলেন, বিকল্প কোনো কিছুৃর ব্যবস্থা না করেই পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যেটি এই ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। উচিত ছিল নিষিদ্ধ করার আগে পলিথিনের বিকল্প কোনো কিছু তৈরি বা আমদানি করে বাজারে সহজলভ্য করা। পলিথিন নিষিদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পস্নাস্টিক দানা ব্যবসায় রীতিমতো ধস নেমেছে। অনেক ব্যবসায়ী দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন। ব্যবসায়ীদের মধ্যে রীতিমতো ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোতে এলসি খোলা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে পস্নাস্টিকের দানা আমদানির কথা বলামাত্রই ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এলসি খুলতে নানা টালবাহানা করছে। অনেক ব্যবসায়ী নিজেকে পস্নাস্টিকের দানা ব্যবসায়ী পরিচয় দিতেও ভয় পাচ্ছেন। সম্প্রতি পস্নাস্টিকের দানা আমাদানি আশঙ্কাজনকহারে কমেছে। আগে প্রতি মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে লাখ লাখ টন দানা আমদানি হতো। এখন অধিকাংশ ব্যবসায়ী আত্মগোপনে চলে গেছেন। কারণ আমদানি বা প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে তৈরিকৃত দানা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পস্নাস্টিক সামগ্রী তৈরি করা হয়। যার মধ্যে রয়েছে বাচ্চাদের খেলনা, বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত নিত্যপ্রয়োজনীয় পস্নাস্টিক সামগ্রী, পলিথিন, পলিথিনের শপিং ব্যাগ, রাবারের পাপস থেকে শুরু করে নানা ধরনের জিনিসপত্র। এই শিল্পের সঙ্গে অন্তত ৬০ লাখ মানুষ জড়িত। পলিথিন নিষিদ্ধ হওয়ার পর এর সঙ্গে জড়িতরা কঠিন সময় পার করছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ইয়াসির আরাফাত খান জানান, পলিইথিলিন বা পলিথিন হচ্ছে হালে ব্যবহৃত সবচেয়ে সাধারণ পস্নাস্টিক। মূলত কোনো কিছুকে প্যাকিং বা মোড়কজাতকরণের জন্য ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে প্রায় ১৫ কোটি টন পলিইথিলিন রেজিন প্রতি বছর উৎপাদিত হচ্ছে। জার্মান রসায়নবিদ হান্স ফন পেখমান ১৮৯৮ সালে প্রথম পলিথিন আবিস্কার করেন। আর ১৯৩৩ সাল থেকে শিল্প কারখানায় পলিথিন ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পলিথিনের ব্যাপক ব্যবহার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ব্যাপক অসুবিধার সৃষ্টি করছে। কারণ এটি সহজেই পরিবেশের সঙ্গে মিশতে পারে না। তবে এটিকে পুনঃব্যবহারযোগ্য করা গেলে অসুবিধা অনেকাংশে কমে যাবে।