ছাত্র-জনতার অভু্যত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজধানীতে এই প্রথম বড় পরিসরে শোভাযাত্রা র্(যালি) করেছে বিএনপি। জাতীয় বিপস্নব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে শুক্রবার বিকালে নয়াপল্টন থেকে শুরু হওয়া বর্ণাঢ্যর্ যালিতে বিপুলসংখ্যক মানুষের ঢল নামিয়ে বিগত ১৭ বছর পর রাজধানীতে নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দিয়েছে দলটি।র্ যালিকে ঘিরে নেতাকর্মী ছাড়াও বিভিন্ন সমর্থক আর সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে পুরো নয়াপল্টন এলাকা ছাড়িয়ে আশপাশের এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়।
র্
যালিপূর্ব সংক্ষিপ্ত সমাবেশে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তির ষড়যন্ত্র এখনো থেমে নেই উলেস্নখ করে এর বিরুদ্ধে জনগণকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। পরের্ যালির শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
এদিকে বিএনপির ঘোষিতর্ যালিতে অংশ নিতে বেলা ১১টা থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন ওয়ার্ড, থানা এবং ঢাকার আশপাশের জেলা থেকে নেতাকর্মীরা জড়ো হতে শুরু করেন। মোড়ে মোড়ে এবং অলিগলিতে জমায়েত হয়ে বিভিন্ন সেস্নাগানে রাজপথ প্রকম্পিত করে তোলেন তারা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মতিঝিল থেকে ফকিরেরপুল-কাকরাইল ছাড়িয়ে মৎস্য ভবন পর্যন্ত হাজার হাজার নেতাকর্মীর এই সমাবেশে জনসমুদ্রে রূপ নেয়। বিকাল ৪টায় নয়াপল্টন থেকে শোভাযাত্রা শুরু হয়। কাকরাইলের নাইটিঙ্গেল রেস্তোরাঁর মোড় থেকে শুরু হওয়ার্ যালিটি কাকরাইল মোড়-কাকরাইল মসজিদ-মৎস্য ভবন-ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট-শাহবাগ-হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল-বাংলামোটর-কারওয়ান বাজার-ফার্মগেট হয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে গিয়ে শেষ হয়। আড়াই ঘণ্টাব্যাপী এইর্ যালির কারণে গুরুত্বপূর্ণ সড়কে ভয়াবহ যানজট সৃষ্টি হয়। বন্ধের দিনও যানজটে নাকাল হতে হয় ঢাকাবাসীকে। অনেক যাত্রী হেঁটে গন্তব্যে যেতে বাধ্য হন।
রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অস্থায়ী মঞ্চে বিকাল ৩টায় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে সমাবেশ শুরু হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নয়াপল্টন থেকে শান্তিনগর মোড় বা মালিবাগ পর্যন্ত পুলিশের অনুমতি নিয়ে বিভিন্ন সময়ের্ যালি করেছিল দলটি। এই রুটের বাইরে প্রায় দেড় যুগ পর এবার প্রথম মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ পর্যন্তর্ যালি করে বিএনপি।
র্
যালিতে অংশ নেওয়া নেতাকর্মীরা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবি সম্বলিত ব্যানার, ফেস্টুন, জাতীয় ও দলীয় পতাকা এবং বিভিন্ন রঙের ক্যাপ পরে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া ধানক্ষেত, কৃষক সাজে নেতাকর্মীরা যোগ দেন এবং ঢাকঢোল, ট্রাক নিয়ে ও বিভিন্ন রঙের টি-শার্ট পরে অংশ নেন। বর্ণাঢ্যর্ যালিতে নেতাকর্মীদের হাতে ছিল ধানের শীষের ছড়া এবং নানা রঙের পতাকা। ছিল ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যার নানান দৃশ্য।র্ যালিতে শেখ হাসিনাকে প্রতীকীভাবে খাঁচায় বন্দি করে উপস্থাপন করা হয়েছে। দেখা গেছে, একটি খাঁচার মধ্যে গোলাপি রঙের শাড়ি ও চোখে সানগস্নাস পরে দাঁড়িয়ে আছে মধ্যবয়স্ক এক নারী। যার সাজগোজ অনেকটা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার মতো। এই নারীর মুখমন্ডল সাজানো হয় দানবের মতো আর মাথায় ছিল দুটি শিং। খাঁচার সঙ্গে আওয়ামী লীগ শাসনামলে বিভিন্ন অন্যায়-অত্যাচার আর লুটপাটের তথ্য ছিল।
বিভিন্ন পথ ধরের্ যালি চলার সময় রাস্তার দুই পাশে হাজার হাজার মানুষ করতালি দিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের অভিনন্দন জানায়। নেতৃবৃন্দ হাত তুলে দর্শকদের অভিবাদনের জবাব দেয়।
বিকাল ৩টা ২৫ মিনিটে উদ্বোধনী বক্তব্য শুরু করেন তারেক রহমান। ৪ মিনিটের বক্তব্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, 'স্বাধীনতা প্রিয় জনগণকে আমি একটি বিষয় আবারও স্মরণ করিয়ে সতর্ক থাকতে অনুরোধ জানাতে চাই, আমি নিজেও সতর্ক থাকতে চাই। গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তির ষড়যন্ত্র এখনো কিন্তু থেমে নেই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে পলাতক স্বৈরাচারের দোসররা দেশে-বিদেশে, শাসনে-প্রশাসনে এখনো সক্রিয়। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। জাতীয়তাবাদী শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকলে কোনো ষড়যন্ত্র কাজে আসবে না।'
ছাত্র-জনতার বিপস্নবে ফ্যাসিবাদের পতন হওয়ায় জনগণকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, '১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ছিল বাংলাদেশের শত্রম্ন-মিত্র চেনার দিন। আর আজ ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের শত্রম্ন চিহ্নিত করার দিন। আমি বলতে চাই, বাংলাদেশের পক্ষের শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকলে আর কেউ দেশের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করতে পারবে না।'
৭ নভেম্বরের শিক্ষায় উদ্বৃত্ত লাখো মানুষের মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের অভিনন্দন জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, 'আজকের এই মিছিল থেকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিজয়ী যে জনতা, সেই জনতাকে জানাই বীরোচিত অভিনন্দন। রাজধানী ঢাকার রাজপথে আজ লাখো জনতার এই মিছিল বাংলাদেশের পক্ষের শক্তিকে ৭ নভেম্বরের অন্তর্নিহিত শিক্ষায় দীক্ষিত করার মিছিল, লাখো জনতার আজকের এই মিছিল ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে আহত অসংখ্য ছাত্র-জনতা এবং হাজারো শহীদের স্বপ্নে একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক, মানবিক বাংলাদেশ গড়ায় প্রত্যয় মিছিল।'
তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী অপশক্তি জেনে রাখুক- রাজধানীর রাজপথের আজকের এই সমাবেশ ও মিছিল কারও বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় তোলার মিছিল নয় বরং রাজপথের জনতার আজকের এই মিছিল বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষার মিছিল, নিজের অধিকার রক্ষার মিছিল, নিজের ভোট প্রয়োগের অধিকার প্রতিষ্ঠার মিছিল।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, 'বাংলাদেশে যাতে আর কখনোই ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচার ফিরে আসতে না পারে, সেজন্য প্রতিটি নাগরিক সরাসরি ভোট দিতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত সক্ষমতা অর্জন জরুরি। জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার জন্য স্থানীয় সরকার থেকে কেন্দ্রীয় সরকার পর্যন্ত জনপ্রতিনিধি হতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের জনগণের ভোটের প্রতি যতক্ষণ মুখাপেক্ষি করা না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত জনগণ গণতন্ত্রের সুফল পাবে না। এমনকি স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদমুক্ত পরিবেশেও স্বল্প আয়ের মানুষকে বাজার সিন্ডিকেটের অভিশাপ থেকে মুক্ত করা অসম্ভব। যদি না মানুষের সরাসরি ভোটের অধিকার আমরা নিশ্চিত করতে পারি।'
সভাপতির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, 'এই ৭ নভেম্বর ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার দিন, ৭ নভেম্বর ছিল বাংলাদেশকে আধিপত্যবাদের কবল থেকে মুক্ত করবার দিন। দীর্ঘ ১৭ বছর আমরা লড়াই করেছি, সংগ্রাম করেছি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, এই ১৭ বছরে আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামো ধ্বংস করে দিয়েছিল। বাংলাদেশকে একটা লুটপাটের রাজত্বে মাফিয়া রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। শেখ হাসিনা তার পরিবার, তার সহকর্মীদের নিয়ে এদেশকে লুটপাট করেছে। ছাত্র-জনতার অভু্যত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও তার দোসরা দেশের সর্বত্র ঘাপটি মেরে বসে আছেন। তাদের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে।'
র্
যালিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, সিনিয়র নেতা মোহাম্মদ শাহজাহান, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আবদুল আউয়াল মিন্টু, মজিবুর রহমান সারোয়ার, খায়রুল কবির খোকন, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, আবদুস সালাম আজাদ, রশিদুজ্জামান মিলস্নাত, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, রফিকুল ইসলাম, সাইফুল আলম নিরব, রাকিবুল ইসলাম বকুল, নিলোফার চৌধুরী মনি, তাইফুল ইসলাম টিপু, রফিকুল আলম মজনু, আমিনুল হক, এম মোনায়েম মুন্না, নরুল ইসলাম নয়ন, এসএম জিলানি, রাজীব আহসান, হাসান জাফির তুহিন, রাকিকুল ইসলাম রাকিব, নাছির উদ্দিন নাছির, নিপুণ রায় চৌধুরীসহ কেন্দ্রীয় ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতারা শোভাযাত্রায় উপস্থিত ছিলেন। বিএনপি মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যরা একটি খোলা ট্রাকে এই মিছিলে অংশ নেন। ঢাকা মহানগরের সব ওয়ার্ডসহ মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, নরসিংদীসহ আশপাশের জেলাগুলো থেকে বাসে করে নেতাকর্মীরা এইর্ যালিতে অংশ নেন। রাজধানী ছাড়াও বিভাগীয় শহরগুলোতে বর্ণাঢ্যর্ যালির এই কর্মসূচি একযোগে আয়োজন করা হয়।
প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার ছিল ৭ নভেম্বর। দিনটি 'জাতীয় বিপস্নব ও সংহতি দিবস' হিসেবে পালন করে বিএনপি। দিবসটি উপলক্ষে আলোচনা সভা, শোভাযাত্রাসহ ১০ দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করে দলটি।