আজ ৭ নভেম্বর, জাতীয় জীবনের এক ঐতিহাসিক অবিস্মরণীয় দিন। জাতীয় বিপস্নব ও সংহতি দিবস। ১৯৭৫ সালের এইদিনে দেশপ্রেমে বলীয়ান হয়ে সিপাহি-জনতা রাজপথে নেমে এসেছিল জাতীয় স্বাধীনতা সুরক্ষা ও হারানো গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনের অভূতপূর্ব অঙ্গীকার নিয়ে। সিপাহি-জনতা ক্যান্টনমেন্টের বন্দিদশা থেকে মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তমকে মুক্ত করে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দেয়। এরপর থেকে জাতি এই দিবসটি পালন করে আসছে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় শপথ গ্রহণ এবং সামরিক বাহিনী ও জনগণের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে।
রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, এই পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্রপতি জিয়ার নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব প্রভাবমুক্ত হয়ে শক্তিশালী সত্তা লাভ করে। গণতন্ত্র অর্গলমুক্ত হয়ে অগ্রগতির পথে এগিয়ে যায়, এইদিন থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়। মানুষের মনে স্বস্তি ফিরে আসে।
দিবসটি উপলক্ষে আজ সকাল ১১টায় শেরেবাংলা নগরস্থ শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারে বিএনপির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন ও ফাতেহা পাঠ অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যবৃন্দ, বিএনপি'র কেন্দ্রীয় নেতা, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির নেতৃবৃন্দ এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতাসহ সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা মাজারে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করবেন।
দিবসটির ঐতিহাসিক পটভুমি:১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে পাল্টে দিতে ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে পাল্টা অভু্যত্থান ঘটে। কয়েক দিনের জন্য বাংলাদেশ সরকার শূন্য অবস্থায় পড়ে যায়। জনগণ নিমজ্জিত হয় চরম হতাশা ও আতঙ্কে। তাদের পরম আস্থার উৎস সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান অভু্যত্থানকারীদের গৃহবন্দি হয়ে পড়েন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ করে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। তবে জাতির এক ক্রান্তিকালে তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করার এক শঙ্কা ও নৈরাশ্যের দুর্যোগে ৬ নভেম্বর মধ্যরাতের পর বিপস্নবী সৈনিকদের কামানের গোলার গর্জন কুচক্রীদের সব চক্রান্ত ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সকালের উদ্ভাসিত সূর্যালোকে ঢাকায় রাজপথে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য- ট্রাকে ট্রাকে সৈনিকরা আকাশের দিকে গুলিবর্ষণ করে তাদের বিজয়ের কথা জানান দিতে থাকেন। সৈনিক ও জনগণ অভূতপূর্ব আনন্দ মিছিলে যোগ দেয়। সেনা ট্যাঙ্কে ফুলের মালা পরিয়ে জনগণ সিপাহি বিপস্নবকে অভিনন্দন জানাতে থাকেন। রেডিওতে আবার জিয়ার কণ্ঠস্বর 'আমি জিয়া বলছি' শুনতে পায় দেশবাসী। ৭ নভেম্বরের চেতনা সব ধরনের জাতিঘাতী এবং রাষ্ট্রঘাতী অপকৌশলের বিরুদ্ধে এক শাণিত হাতিয়ার।
গত ৪৯ বছরের অধিকাংশ সময় দিবসটি সরকারিভাবে পালিত হয়েছে 'জাতীয় বিপস্নব ও সংহতি দিবস' হিসেবে। ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত দিবসটি ছিল সরকারি ছুটির দিন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তা বাতিল করা হয়। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে আবারও এই দিনে সরকারি ছুটি বহাল করা হয়। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশজুড়ে জরুরি আইন জারি এবং ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৬ সালের সরকারি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, ওই বছর দিনটিতে সরকারি ছুটি বহাল ছিল। পরের বছর ২০০৮ সালে তা ছিল না। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার প্রেক্ষাপটে ২০০৯ সাল থেকে দিনটি সরকারি ছুটি হিসেবে পালিত হচ্ছে না।
জাতীয় এই দিবসটি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে ভিন্ন ভিন্ন নামে অভিহিত। বিএনপিসহ দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের কাছে একে 'জাতীয় বিপস্নব ও সংহতি দিবস' বললেও বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগ 'মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস' এবং জাসদ 'সিপাহি-জনতার অভু্যত্থান দিবস' হিসেবে পালন করে।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভু্যত্থানে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচু্যত হওয়ার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসে। বিএনপিসহ জামায়াতে ইসলামী, এলডিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এই দিবসটিকে জাতীয়ভাবে পালনের আহ্বান জানিয়ে আসছে।
দিনটি উপলক্ষে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এক বাণীতে বলেন, ৭ নভেম্বর জাতীয় জীবনের এক ঐতিহাসিক অবিস্মরণীয় দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে দেশপ্রেমে বলীয়ান হয়ে সিপাহি-জনতা রাজপথে নেমে এসেছিল জাতীয় স্বাধীনতা সুরক্ষা ও হারানো গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনের অভূতপূর্ব অঙ্গীকার নিয়ে। তাই ৭ নভেম্বরের ঐতিহাসিক বিপস্নব অত্যন্ত তাৎপর্যমন্ডিত।
তিনি বলেন, স্বাধীনতোত্তর রাষ্ট্রীয় অনাচার, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, তৎকালীন ক্ষমতাসীন মহল নিজ স্বার্থে জাতীয় স্বাধীনতাকে বিপন্ন ও সার্বভৌমত্বকে দুর্বল করে আধিপত্যবাদের থাবার মধ্যে দেশকে ঠেলে দেয়। শুধুমাত্র নিজেদের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্যই গণতন্ত্রবিনাশী কর্মকান্ড শুরু করে। সেজন্য মানুষের বাক-ব্যক্তি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে গলাটিপে হত্যার মাধ্যমে একদলীয় বাকশাল গঠন করে গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়। শুরু হয় নির্মম একদলীয় দুঃশাসন। দেশে নেমে আসে অশান্তি ও হতাশার কালো ছায়া। বাকশালী সরকার চরম অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী পন্থায় মানুষের ন্যায়সংগত অধিকারগুলোকে হরণ করে। দেশমাতৃকার এই চরম সংকটকালে '৭৫ এর ৩ নভেম্বর কুচক্রীরা মহান স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানকে সপরিবারে ক্যান্টনমেন্টে বন্দি করে। এই অরাজক পরিস্থিতিতে ৭ নভেম্বর স্বজাতির স্বাধীনতা রক্ষায় অকুতোভয় সৈনিক এবং জনতার ঢলে রাজপথে এক অনন্য সংহতির সম্মিলন ঘটে এবং জিয়াউর রহমান মুক্ত হন। এই পটপরিবর্তনে রাষ্ট্রপতি জিয়ার নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব প্রভাবমুক্ত হয়ে শক্তিশালী সত্তা লাভ করে। গণতন্ত্র অর্গলমুক্ত হয়ে অগ্রগতির পথে এগিয়ে যায়, এই দিন থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়। মানুষের মনে স্বস্তি ফিরে আসে। জাতীয় বিপস্নব ও সংহতি দিবসে দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান তারেক রহমান।
অপর এক বিবৃতিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার স্বতস্ফূর্ত বিপস্নব সংঘটিত হয়েছিল, এই বিপস্নবে বন্দিদশা থেকে মুক্ত হন জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমানকে সমর্থন করে সামরিক বাহিনী ও সাধারণ মানুষ পথে নেমে এসেছিল। জাতি পেয়েছিল এক যোগ্য নেতৃত্ব জিয়াউর রহমানকে, যিনি '৭১ এ জাতির চরম ক্রান্তিলগ্নে মহান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার দিক-নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সফল রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উন্মেষ ঘটিয়ে জাতিকে উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির মহাসড়কে উঠিয়েছিলেন। আর সেজন্যই আমাদের জাতীয় জীবনে এই বিপস্নবের গুরুত্ব অপরিসীম।
তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরে আমরা স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম সেই একই চেতনা বুকে ধারণ করে বহুদলীয় গণতন্ত্র নিশ্চিত করা, স্বাধীনতার সুফল তথা অর্থনৈতিক মুক্তি, শান্তি-শৃঙ্খলা, সাম্য, ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
কর্মসূচি: ৭ নভেম্বর মহান জাতীয় বিপস্নব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে আজ সকাল ৬টায় নয়াপল্টনস্থ বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারাদেশে দলীয় কার্যালয়গুলোতে দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। বিএনপির উদ্যোগে ৬ নভেম্বর বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
দিবসটি উপলক্ষে কাল শুক্রবার রাজধানীতে বর্ণাঢ্যর্ যালি অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া জেলাগুলোতেওর্ যালি অনুষ্ঠিত হবে। দিবসটি উপলক্ষে দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন স্ব স্ব উদ্যোগে আলোচনা সভা ও অন্যান্য কর্মসূচি পালন করবে। আজ জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) উদ্যোগে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় জাতীয় শহীদ মিনারে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। একই সঙ্গে জাসাসের উদ্যোগে বিভাগীয় শহরগুলোতেও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। ৭ নভেম্বরের ডকুমেন্টরি (ভিডিও, স্থিরচিত্র) ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট মিডিয়াসহ ফেসবুক, ইউটিউব, অনলাইনে প্রকাশ করা হবে। এছাড়া পোস্টার ও ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়।
একইভাবে দেশব্যাপী বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের উদ্যোগে স্থানীয় সুবিধানুযায়ী ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপস্নব ও সংহতি দিবসের ওপর আলোচনা সভাসহ অন্যান্য কর্মসূচি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হবে।