যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন
ট্রাম্পের ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন
সিনেট রিপাবলিকানদের দখলে প্রতিনিধি পরিষদেও তারা এগিয়ে
প্রকাশ | ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
চার বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এক নাটকীয় প্রত্যাবর্তনে ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও সে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং কমলা হ্যারিসের তীব্র লড়াই আর ব্যাপক রাজনৈতিক মেরুকরণে উত্তপ্ত হয়ে ওঠা যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা শেষ পর্যন্ত 'আমেরিকা প্রথম' নীতিতে আস্থাশীল ট্রাম্পকেই বেছে নেন।
বিরল এ জয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সর্বশেষ সুইং স্টেট উইসকনসিনে জয় পান ডোনাল্ড ট্রাম্প। রাজ্যটিতে ১০টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট। এ জয়ের ফলে ২৭০ ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের ম্যাজিক ফিগারে পৌঁছে যান ট্রাম্প। বুধবার স্থানীয় সময় রাত ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কমলা হ্যারিস পেয়েছেন ২২৩টি ইলেকটোরাল ভোট। আর ট্রাম্প পেয়েছেন ২৭৯টি ইলেকটোরাল ভোট।
নির্বাচনী প্রচারণার সময় থেকেই ট্রাম্প অর্থনীতি, অভিবাসন ও জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে জোরালো বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন, যা মূলত তার সমর্থকদের আরও উজ্জীবিত করে। মার্কিন অর্থনীতির নিম্নগতি, মুদ্রাস্ফীতি এবং সীমান্ত নিরাপত্তার ইসু্যগুলোতে ট্রাম্পের অবস্থান অনেক ভোটারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পাশাপাশি, ইউক্রেনের মতো বাইরের দেশের জন্য বড় অংকের অর্থ ব্যয় নিয়ে আমেরিকানদের মধ্যেও অসন্তোষ তৈরি হয়। এ বিষয়ে ট্রাম্পের সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও নিজ দেশের অগ্রাধিকার নিশ্চিতের প্রতিশ্রম্নতি অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে।
বিশেষ করে নির্ধারণী সুইং স্টেটগুলোর জয়ই হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের ফেরার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখে। জর্জিয়া, নর্থ ক্যারোলিনা, ফ্লোরিডা, পেনসিলভানিয়া এবং উইসকনসিনের মতো ব্যাটেলগ্রাউন্ড রাজ্যগুলোতে ট্রাম্পের জয় দেখিয়ে দেয় যে, অনেক আমেরিকান ভোটার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সীমান্ত নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের সময় পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাটেলগ্রাউন্ড রাজ্যে এগিয়ে থাকলেও শেষ পর্যন্ত কমলা হ্যারিস সেই সমর্থন
\হধরে রাখতে পারেননি।
এবারের নির্বাচনের আরও একটি উলেস্নখযোগ্য বিষয় হলো, গণমাধ্যম ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক জরিপে ট্রাম্পের পিছিয়ে থাকার চিত্র উঠে আসা সত্ত্বেও ফলাফল ভিন্নভাবে প্রকাশ পায়। জরিপগুলোর অধিকাংশই ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী হ্যারিসের পক্ষে ইঙ্গিত দিলেও ট্রাম্পের সমর্থকরা শেষ মুহূর্তে বিপরীত সিদ্ধান্ত নিয়ে আসেন।
এই নির্বাচনী জয়ের মাধ্যমে ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর-বাইরের বিভিন্ন সংকটময় পরিস্থিতি সামলাতে প্রস্তুত হচ্ছেন। তিনি আরও শক্তিশালী ম্যান্ডেট নিয়ে ফিরে এসেছেন, যা তাকে তার 'আমেরিকা প্রথম' নীতি বাস্তবায়নে আরও স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ এনে দিয়েছে। তবে এই জয়ে ট্রাম্পের সমালোচকরা যেমন আমেরিকার গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত, তেমনি তার সমর্থকরা আশা করছেন যে এই মেয়াদে ট্রাম্প তাদের দেওয়া প্রতিশ্রম্নতি বাস্তবায়নে নিরলস থাকবেন।
বিশ্লেষকদের মতে, দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্প একাধিক ভিন্নমতকে উপেক্ষা করে তার নিজের বলয়ে আরও দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করবেন। তবে এটি শুধু আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেই নয়, বৈশ্বিক রাজনৈতিক ভারসাম্যের ক্ষেত্রেও পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে, যেখানে ট্রাম্প একাধিক আন্তর্জাতিক চুক্তি ও সংকটে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে পদক্ষেপ নিতে পারেন।
এরই মধ্যে তিনি ফ্লোরিডার পাম বিচে দলীয় নেতাকর্মীদের কনভেনশন হলে পৌঁছে ভাষণ দিয়েছেন। এতে তিনি মার্কিনিদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। নিজেকে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছেন। দলীয় সমর্থকদের ব্যাপক করতালির মধ্য দিয়ে তিনি মঞ্চে আরোহণ করেন। সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী মেলানিয়া ট্রাম্প, রানিংমেট জেডি ভ্যান্স, মেয়ে ইভানকা ট্রাম্প, ছেলে ব্যারন ট্রাম্প প্রমুখ। প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের যে ক্ষতি হয়েছে তা সারিয়ে তুলতে।
বক্তব্যের এক পর্যায়ে তিনি মেলানিয়া ট্রাম্পকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করেন। এ সময়ই তিনি মেলানিয়াকে ফার্স্টলেডি হিসেবে আখ্যায়িত করে তাকে ধন্যবাদ জানান।
মেলানিয়া একটি বই লিখেছেন। সেটা দেশে অন্যতম বেস্টসেলার হয়েছে বলে তার প্রশংসা করেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, তিনি একটি মহান কাজ করেছে। জনগণকে সহায়তা করার জন্য তিনি কঠোর কাজ করেন। নিজের সন্তানদের 'অ্যামেজিং চিলড্রেন' আখ্যায়িত করেন ট্রাম্প। তিনি এ সময় প্রতিশ্রম্নতি দেন সীমান্ত সমস্যা সমাধান করার। তিনি আরও বলেন, তিনি এবং তার দল আরও একবার ইতিহাস রচনা করেছেন। এ জয়কে তিনি 'ম্যাগনিফিসেন্ট ভিক্টরি' বলে অভিহিত করেন। ট্রাম্প বলেন, 'এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে সোনালী যুগের সূচনা হলো।' তিনি বলেন, 'এই বিজয় মার্কিন জনগণের। এর ফলে আমরা আবার আমেরিকাকে গ্রেট করে গড়ে তুলতে পারবো।' এ সময় সমর্থকদের স্স্নোগানে ফেটে পড়ছিল কনভেনশন সেন্টার। তার মাঝেই ট্রাম্প বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র আমাদেরকে অপ্রত্যাশিত ও শক্তিশালী ম্যান্ডেট দিয়েছে।' নির্বাচনী প্রচারণায় পাশে থাকার জন্য এক্সের মালিক ও বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ককে তিনি রিপাবলিকান দলের 'নতুন তারকা' আখ্যায়িত করেন। ট্রাম্প বলেন, প্রচারণাকালে দু'বার হত্যাচেষ্টা থেকে তিনি রক্ষা পেয়েছেন। তিনি রক্ষা পেয়েছেন একটি কারণে। ট্রাম্প বলেন, হোয়াইট হাউসে তিনি প্রতিটি কাজে উৎসাহ ও লড়াই নিয়ে আসবেন। বলেন, প্রেসিডেন্ট হওয়া হলো বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। সরকার চালাবেন তার ঘোষণা- 'প্রমিজেস মেইড, প্রোমিজেস কেপ্ট' নীতি অনুযায়ী।
সিনেটে রিপাবলিকানদের
জয়, প্রতিনিধি পরিষদেরও এগিয়ে
এদিকে, মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে ডেমোক্রেটরা। সামান্য ব্যবধানে এতদিন তারা সিনেটের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছিল। কিন্তু মঙ্গলবারে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সঙ্গে সিনেট এবং নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদেও ভোট হয়। এতে সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজনীয় ৫১ আসন নিশ্চিত করেছে রিপাবলিকানরা। অন্যদিকে প্রতিনিধি পরিষদেও তারা এগিয়ে আছে। নিউইয়র্ক টাইমস এ খবর দিয়েছে। এতে বলা হয়, চার বছর পর সিনেটের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে ডেমোক্রেটরা। ওয়েস্ট ভার্সিনিয়ায় গভর্নর জিম জাস্টিস সহজেই জিতেছেন। এই আসনের সিনেটর জো মানচিন তৃতীয় অবসরে গেছেন। তিনি এই আসনে দীর্ঘদিন যাবত ডেমোক্রেট দলের সিনেটর ছিলেন। এ বছরের শুরুর দিকে তিনি স্বতন্ত্র হয়ে যান। এর আগে সিনেটে ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকানদের সংখ্যা ছিল ৫১-৪৯। এর ফলে সামান্য ব্যবধানে সিনেট ধরে রেখেছিল ডেমোক্রেটরা। সিনেটর মাইক ব্রাউনের ছেড়ে দেওয়া আসন ইন্ডিয়ানায় নির্বাচিত হয়েছেন জিম ব্যাংকস। ফ্লোরিডায় নির্বাচিত হয়েছেন সিনেটর রিক স্কট। ভারমন্টে নির্বাচিত হয়েছেন ৮৩ বছর বয়সি সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স। তিনি এর আগে ডেমোক্রেট দল থেকে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হয়েছিলেন। ডেমোক্রাটদের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব আছে। তিনি স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করেছেন এবার। এর মধ্য দিয়ে টানা চতুর্থবার তিনি সিনেটর নির্বাচিত হলেন।