ইসি গঠনে ৬ সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি গঠন
সংলাপ নয়, রাজনৈতিক দলের মতামত নেবে সংস্কার কমিশন
প্রকাশ | ০১ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি রিপোর্ট
নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে যোগ্য ব্যক্তি বাছাইয়ের জন্য আপিল বিভাগের বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীকে সভাপতি করে ছয় সদস্যের অনুসন্ধান (সার্চ) কমিটি গঠন করে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
আইন অনুযায়ী, এই কমিটি নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য প্রতি পদের বিপরীতে দুজন করে ব্যক্তির নাম সুপারিশ করবে।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, অনুসন্ধান কমিটিতে সদস্য হিসেবে আছেন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান, বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মো. নূরুল ইসলাম, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান মোবাশ্বের মোনেম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক চৌধুরী রফিকুল আবরার (সি আর আবরার) এবং পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিন্নাতুন নেছা তাহমিদা বেগম।
ছাত্র-জনতার অভু্যত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। তার পরদিন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এরপর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠিত হয়। অন্তর্র্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। প্রধান বিচারপতি থেকে শুরু করে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনেকেই পদত্যাগ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ৫ সেপ্টেম্বর কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন ইসিও পদত্যাগ করে। এই কমিশন শপথ নিয়েছিল ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রম্নয়ারি।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে অনুসন্ধান কমিটি আইন অনুযায়ী দায়িত্ব ও কার্যাবলি সম্পন্ন করবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইনে নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে অনুসন্ধান কমিটি গঠনের কথা বলা আছে। এতে বলা হয়েছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য নির্বাচন কমিশনারের শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি ছয় সদস্যের একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবেন। কমিটির সদস্যদের মধ্যে থাকবেন প্রধান বিচারপতি মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারক (তিনি হবেন কমিটির সভাপতি), প্রধান বিচারপতি মনোনীত হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতি মনোনীত দুজন বিশিষ্ট নাগরিক, যাদের একজন হবেন নারী।
আইনানুযায়ী অনুসন্ধান কমিটি গঠনের ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ দেওয়ার কথা।
বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারকদের তালিকায় জ্যেষ্ঠতার বিচারে বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীর নাম রয়েছে তিন নম্বরে।
১৯৬১ সালের ১৮ মে জন্ম নেওয়া জুবায়ের রহমানের বাবা এএফএম আবদুর রহমান চৌধুরীও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ছিলেন। ২০১৮ সালে
বিচারক হিসেবে ১৫ বছরের কর্মজীবন শেষ করেন তিনি।
জুবায়ের রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করে যুক্তরাজ্যে আন্তর্জাতিক আইনে এলএলএম করেন।
১৯৮৫ সালে তিনি জেলা আদালতের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। দুই বছর পর হাইকোর্ট বিভাগে পেশাগত কাজ শুরু করেন।
২০০৩ সালের আগস্টে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান জুবায়ের রহমান চৌধুরী। নিয়ম অনুযায়ী দুই বছর পর তার নিয়োগ স্থায়ী হয়।
শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর সুপ্রিম কোর্টে বড় পরিবর্তনের মধ্যে ১৩ আগস্ট বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীকে আপিল বিভাগের বিচারক করা হয়।
বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান
সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগে বিচারকদের তালিকায় জ্যেষ্ঠতার বিচারে বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামানের নাম রয়েছে দুই নম্বরে।
১৯৫৯ সালের ১ মার্চ জন্ম নেওয়া আসাদুজ্জামান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর করেন। ১৯৮৩ সালে জেলা আদালতে তালিকাভুক্ত হওয়ার মাধ্যমে আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি।
১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে হাইকোর্ট বিভাগে এবং ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে আপিল বিভাগে তালিকাভুক্ত হন আসাদুজ্জামান। ২০০৩ সালের ২৭ আগস্ট হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। দুই বছর পর সেই নিয়োগ স্থায়ী হয়।
২০১১ সালে শ্রীলংকার কলম্বোতে কমনওয়েলথ সচিবালয়ের আয়োজনে 'অর্থনৈতিক ও আর্থিক অপরাধ' বিষয়ক সাউথ এশিয়ান জাজেস রিজিওনাল ফোরামে যোগ দেন বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান।
সিএজি মো. নূরুল ইসলাম
অষ্টম বিসিএসের অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস ক্যাডারের কর্মকর্তা মো. নূরুল ইসলাম ২০২৩ সালের মধ্য জুলাইতে মহাহিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক পদে আসেন। সাংবিধানিক এ পদে আসার আগে আড়াই বছর হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করা নূরুল ইসলাম কর্মজীবনে সরকারি হিসাব ও অডিট সংক্রান্ত বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
হিসাব মহানিয়ন্ত্রক থাকার সময় পেশাগত 'উৎকর্ষ ও সুশাসনে' ভূমিকার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ২০২২ সালে জাতীয় শুদ্ধাচার পুরস্কার পান তিনি।
অধ্যাপক মোবাশ্বের মোনেম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক মোবাশ্বের মোনেম ৯ অক্টোবর সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান।
মোবাশ্বের মোনেম ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে পিএইডি এবং সাসেক্স ও হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটিতে পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা করেছেন। লোকপ্রশাসন, সুশাসন ও পাবলিক পলিসি নিয়ে তার গবেষণামূলক কাজ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেছেন অধ্যাপক মোবাশ্বের মোনেম।
অধ্যাপক সি আর আবরার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক চৌধুরী রফিকুল (সি আর) আবরার অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) নির্বাহী পরিচালক।
তার গবেষণার বিষয়ের মধ্যে রোহিঙ্গা শরণার্থী, অভিবাসী শ্রমিক, বাংলাদেশের উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব প্রভৃতি। এক সময় মানবাধিকার সংগঠন 'অধিকার'-এর সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি।
অধ্যাপক জেড এন তাহমিদা বেগম
পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিন্নাতুননেসা তাহমিদা বেগম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। ২০০২ সালের ৯ মে থেকে পাঁচ বছর পিএসসি চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্যও ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনপি-জামায়াত সমর্থক শিক্ষকদের সাদাদলে সামনের সারিতে থাকা অধ্যাপক তাহমিদা বেগম সিনেট, সিন্ডিকেটসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ সামলেছেন।
সংলাপ নয়, রাজনৈতিক দলের মতামত নেবে সংস্কার কমিশন
এদিকে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় বা সংলাপের প্রয়োজন দেখছেন না সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেছেন, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যেই কমিশনের সুপারিশ সরকারের কাছে জমা দেওয়া হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের দরকার না হলেও তাদের কাছ থেকে সুস্পষ্ট মতামত নেবে সংস্কার কমিশন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে সংস্কার কমিশনের ১২তম বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন।
বৈঠকে সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. তোফায়েল আহমেদ, জেসমিন টুলী, ড. মো. আব্দুল আলীম, ডা. জাহেদ উর রহমান, মীর নাদিয়া নিভিন, মোহাম্মদ সাদেক ফেরদৌস, সদস্য ও ছাত্র প্রতিনিধি সাদিকাল আরমান, ইসির সিস্টেম ম্যানেজার মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন ও ইসির উপসচিব মো. আতিয়ার রহমান উপস্থিত ছিলেন।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, 'আমাদের কাজ উলেস্নখযোগ্যভাবে অগ্রসর হচ্ছে। এ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা ১২টি বৈঠক করেছি। নির্বাচনের বিভিন্ন আইন-কানুন আমরা পর্যালোচনা করছি। এই সংস্কারের জন্য আমরা বিভিন্ন অংশীজনের কাছ থেকে মতামত নেব।'
সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো মতবিনিময় করবেন কিনা- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে কমিশন প্রধান বলেন, 'আমি মনে করি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো মতবিনিময়ের প্রয়োজন নেই। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে আমরা সুস্পষ্ট মতামত নেব।'
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, 'সুন্দর নির্বাচন উপহার দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের নয়। নির্বাচন ব্যবস্থা বা নির্বাচন কার্যক্রম সুন্দরভাবে করার জন্য আমাদের কাজ হলো কিছু সুপারিশ করা। আগামী ৩১ ডিসেম্বর মধ্যেই আমাদের সুপারিশ দেওয়ার সময় দেওয়া হয়েছে। আমরা এর মধ্যেই সুপারিশ করব।'
আপনারা সার্চ কমিটির সংস্কারের প্রস্তাব দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার আগেই আজ (বৃহস্পতিবার) সরকারি প্রজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, 'বর্তমানে নির্বাচন কমিশন প্রয়োজন, আর নির্বাচন কমিশন গঠন করার জন্য সরকার এই সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন। সার্চ কমিটি তার নিজস্ব গতিতে কাজ করবে এবং আমরা আমাদের মতো কাজ করব। আমরা যে প্রস্তাবগুলো দেব সেই প্রস্তাবগুলো কিছু বাস্তবায়ন করবে সরকার এবং কিছু করবে নির্বাচন কমিশন। তাই সার্চ কমিটির সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ততা নেই।'
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম বলেন, 'প্রবাসী ভোটাররা যেন ভোট দিতে পারে সেই বিষয়েও আমরা আলোচনা করেছি।'
প্রসঙ্গত, এর আগে ১১টি বৈঠক হলেও সাত সদস্যের সংস্কার কমিশনে ছাত্র প্রতিনিধি যোগ দেন বৃহস্পতিবার। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদিকা আরমান কমিশনের সদস্য হওয়ায় তাকে ধন্যবাদ জানান সংস্কার কমিশন প্রধান।