সারাদেশে ডেঙ্গুতে মৃতু্যর অর্ধেকই ডিএসসিসিতে

প্রকাশ | ২৯ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

বিশেষ প্রতিনিধি
রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। দীর্ঘ হচ্ছে মৃতু্যর মিছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। ডেঙ্গুর 'হটস্পট' হয়ে ওঠা এই এলাকায় ডেঙ্গুতে মৃতু্যর সংখ্যা সারাদেশে এই রোগে আক্রান্ত মোট মৃতু্যর প্রায় অর্ধেক। যা স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও কীটতত্ত্ববিদদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডিএসসিসিকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৭৭ জনের মৃতু্য হয়েছে। এর মধ্যে শুধু ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মৃতু্যর সংখ্যা ১৩৫ জন। একই সময় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) মারা গেছে ৪৮ জন। যা ডিএসসিসির তুলনায় প্রায় তিন গুণ কম। এই দুই সিটি করপোরেশনের বাইরে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ডেঙ্গুতে ১২ জনের মৃতু্য হয়েছে। এ ছাড়া বরিশালে ৩৩ জন, চট্টগ্রাম মহানগরীতে একজন, সিটি করপোরেশনের বাইরে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ২৬ জন, খুলনায় ১৭ জন, ময়মনসিংহে তিনজন, রাজশাহীতে একজন এবং রংপুরে একজন ডেঙ্গুতে মারা গেছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের ১৮টি সরকারি ও ৫৯টি বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের হার সবচেয়ে বেশি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এই হাসপাতালটিতে চলতি বছরের ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত সর্বমোট ৫৪ জন ডেঙ্গু রোগী মারা গেছে। ভর্তি হয়েছে দুই হাজার ৩১১ জন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃতু্য হয়েছে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এই প্রতিষ্ঠানে এখন পর্যন্ত ভর্তি রোগীর সংখ্যা দুই হাজার ৭৬৮ জন, মৃতু্যর সংখ্যা ৩২ জন। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার এসএসএমসি ও মিটফোর্ড হাসপাতালে মারা গেছে ১৮ জন, সেখানে চিকিৎসা নিয়েছে এক হাজার ৯২২ জন। ধানমন্ডির স্কয়ার হাসপাতালে ২৯২ জন চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে ১০ জন মারা গেছে। ডিএনসিসির আওতাধীন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ১৩ জন এবং মহাখালী ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতালে ১০ জনের মৃতু্য হয়েছে। কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, পুরো রাজধানীই এখন ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে। আর এডিস মশার বিস্তার ও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের হার বিবেচনায় সবচেয়ে নাজুক অবস্থা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন মুগদা, মান্ডা, যাত্রাবাড়ী, দোলাইপাড় ও দনিয়া। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাম্প্রতিক এক জরিপে উঠে এসেছে এ তথ্য। সরেজমিন এসব এলাকা ঘুরে সেখানে এডিস মশার বিস্তার ও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের হারের আধিক্যের তথ্য পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞ ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার জানান, পুরো রাজধানীই এখন ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই ভয়াবহতা ঠেকাতে হটস্পট ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। তবে পরিস্থিতির অবনতি হলেও এবারের ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনায় বড় দুর্বলতা হচ্ছে, প্রতিবার বর্ষা মৌসুমে এডিসের জরিপ করলেও এবার তা করেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ। এমনকি বর্ষা-পূর্ব জরিপেরও তেমন ইঙ্গিত মিলছে না। যা রোগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অন্যতম চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মোশতাক হোসেন। এদিকে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের জরিপে যে চিত্র মিলছে, তা বেশ উদ্বেগজনক। জরিপ অনুযায়ী, ঢাকার প্রায় সব এলাকায় এডিস মশার ঘনত্ব বা ব্রম্নটো ইনডেক্স ২০-এর বেশি। যার অর্থ দাঁড়ায়, পুরো রাজধানীই এখন ঝুঁকিপূর্ণ। এমনকি উত্তরা, ধানমন্ডি, গুলশান, বনানীর মতো অভিজাত এলাকায়ও ব্রম্নটো ইনডেক্সের মাত্রা ৫০-এর বেশি। আর ডেঙ্গুর ঘনত্ব ও রোগীর হার বিবেচনায় সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা মুগদা, মান্ডা, যাত্রাবাড়ী, দোলাইপাড়, জুরাইন ও দনিয়া এলাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন মুগদা, ডেমরা ও জুরাইন তুলনামূলক নিচু এলাকা হওয়ায় এসব স্থানে ডোবা-নালা ও খালের সংখ্যা বেশি। যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে এসব এলাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। এ ছাড়া এখানে এমন অনেক ওয়াটার বডি রয়েছে, যেগুলো সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা হয়নি। রয়েছে অনেক মজা পুকুরও। এসব ছোট ছোট জলাশয় ওই অঞ্চলকে ডেঙ্গুর হটস্পট হওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। যথার্থ উদ্যোগের অভাবে পরিস্থিতি ভয়ানক দিকে মোড় নিচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, নিচু এলাকা-ডোবা ও জলাশয়ের কারণে রাজধানীর মুগদা, ডেমরা ও জুরাইন এডিস মশার জন্ম ও বসবাস উপযোগী এলাকায় পরিণত হয়েছে। ?সিটি করপোরেশনের ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনায় পরিবেশগত এ বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া উচিত। এদিকে ডিএসসিসি এলাকার হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর মৃতু্যর সংখ্যা সারাদেশের মোট মৃতু্যর প্রায় অর্ধেক হলেও তাদের সবাই ডিএসসিসি এলাকার বাসিন্দা নন বলে দাবি করেন ডিএসসিসির স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। তাদের দাবি, ঢাকা মেডিকেল, মুগদা ও মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের বেশির ভাগই ঢাকার বাইরের। তবে মুগদা, ডেমরা ও জুরাইনে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা যে তুলনামূলক অনেক বেশি, তা তারা অস্বীকার করেননি। ডিএসসিসিতে মাত্রাধিক সংখ্যক ডেঙ্গু রোগীর মৃতু্যর কারণ খুঁজতে গিয়ে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। সিটি করপোরেশনের মশক নিধন ও স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিযোগ, মেয়র তাপস এই প্রতিষ্ঠানটিকে ব্যবহার করেছেন পারিবারিক সম্পত্তির মতো। আগের মেয়র সাঈদ খোকনও একই কাজ করেছেন। প্রতিবছর ডেঙ্গুতে শত শত মানুষ মারা গেলেও নগর ভবনের কর্তা মেয়ররা জনগণের ট্যাক্সের টাকা নিয়েও করেছেন নানা ছেলেখেলা। এডিসসহ অন্যান্য মশক নিধনে উদ্ভট উদ্ভট ধারণা নিয়ে সেগুলো পরীক্ষা করার জন্য বেছে নিতেন ডিএসসিসি এলাকা। এমন নানা বাহানায় বছর বছর শত শত কোটি টাকা গচ্চা গেলেও এ নিয়ে কোনো জবাবদিহি ছিল না। তবে এসব প্রকল্প থেকে মেয়র এবং তাদের স্বজনরা হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ। গত দেড় দশকে রাজধানী বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় ওপরের দিকে উঠলেও ভাগ্য বদলেছে দায়িত্ব পালন করা মেয়র এবং তাদের স্বজনদের। এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর কোনো দেশেই ডেঙ্গুতে এত মৃতু্যর রেকর্ড নেই। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, অসচেতনতার কারণে রোগীদের দেরিতে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া। বিশেষত নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা কম, জ্বর নিয়ে অবহেলা করে, ফলে ডেঙ্গু শনাক্ত হতে দেরি হয়। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণে রোগীর মৃতু্যর সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক আহমেদ বলেন, প্রথমত রোগীর সংখ্যা বাড়লে আনুপাতিক হারে মৃতু্যর সংখ্যা বাড়বে- এটাই স্বাভাবিক। দ্বিতীয়ত গত বছর সর্বোচ্চ মৃতু্য হয়েছে যেসব কারণে, সেগুলো দূর হয়নি। চিকিৎসাব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি। এ ছাড়া যারা শনাক্ত হচ্ছে, কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ রোগী নয়, তাদের মাঠপর্যায়ে হাসপাতালে রাখার কথা, আবার যারা জটিল রোগী, তাদেরও একসঙ্গে রাখা হচ্ছে, ফলে তারা যথার্থ চিকিৎসা পাচ্ছে না। সব এক জায়গায় হওয়ার কারণে ব্যবস্থাপনা করা যাচ্ছে না। যা মৃতু্য সংখ্যা বৃদ্ধির বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি বুঝতে বারবার জরিপ করা জরুরি। অথচ বাস্তবে তা হচ্ছে না। এ বছর শুধুমাত্র প্রাক বর্ষায় একটি জরিপ হয়েছে। ফলে মশার লার্ভা কোথায় কতটুকু আছে, এ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই কারও কাছে। এ ছাড়া কাউন্সিলরা না থাকায় মশক নিধন এবং এ ব্যাপারে সচেতনতামূলক কার্যক্রমেও ভাটা পড়েছে। যদিও এডিস মশার প্রজননস্থল নিধনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নিয়মিত ও বিশেষ কর্মসূচির মাধ্যমে সফলভাবে ডেঙ্গু রোগ নিয়ন্ত্রণ করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সংস্থাটির প্রশাসক ড. মুহ. শের আলী। তিনি বলেন, এডিস মশার লার্ভা বিনষ্ট এবং জীবন্ত ও উড়ন্ত মশা নিধনের মাধ্যমে ডেঙ্গু রোগ নিয়ন্ত্রণে নিয়মিতভাবে লার্ভিসাইডিং ও এডাল্টিসাইডিং করা হচ্ছে এবং এই কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীর যে তালিকা পায়, সেসব রোগীর ঠিকানা অনুযায়ী বিশেষ মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।