পণ্য কেনাবেচায় ভাটা
প্রয়োজনের বাইরে কিছু কিনছেন না ভোক্তারা
প্রকাশ | ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি রিপোর্ট
মুদিপণ্য থেকে শুরু করে পায়ের জুতা, সব ধরনের কেনাকাটায় লাগাম টেনে ধরছে ভোক্তারা। একান্তই প্রয়োজন না হলে কিনছেন না কোনো পণ্যই। ফলে দেশের বাজারে বিভিন্ন পণ্যের চাহিদায় ব্যাপক পতন দেখা যাচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, গত জুলাই থেকে পণ্যের চাহিদা নিম্নমুখী। তারা বলছে, মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট হয়ে কমছে গৃহস্থালি ব্যয়, যার কারণে অনেক পরিবারই টুকিটাকি অন্যান্য জিনিস কেনার চেয়ে অপরিহার্য পণ্য কেনাতেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, গরু ও খাশীর মাংসের পাশাপাশি অতিরিক্ত দামের কারণে মুরগি ও মাছের মতো খাবারের বিক্রিও এক-তৃতীয়াংশ কমে গেছে।
দেশের সর্ববৃহৎ সুপারমার্কেট চেইন 'স্বপ্ন'র করা সাম্প্রতিক সময়ের একটি ভোক্তা আস্থা সূচক (সিসিআই) জরিপে উঠে এসেছে এমন চিত্র, যেখানে ব্যক্তির অর্থকড়ি ব্যয় ও সার্বিক অর্থনীতিতে ব্যাপক নিরাশার ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
অর্গানাইজেশন ও ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের তৈরি করা ভোক্তার আস্থা/ মনোভাব যাচাইয়ের জরিপ পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে স্বপ্ন'র সিসিআই জরিপও তৈরি করা হয়, এটি বলছে, অক্টোবরে ভোক্তা আস্থা নেমে এসেছে মাত্র ৩২.৫ শতাংশে। অর্থাৎ বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যতের বিষয়ে গভীর শঙ্কা রয়েছে ভোক্তাদের মধ্যে, কারণ এই সূচকে আস্থার সূচক ৫০ শতাংশের নিচে থাকা মানেই হচ্ছে নেতিবাচক মনোভাব।
এর মধ্যে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের মূল্যায়ন খুবই কম বা মাত্র ২১.৫ শতাংশ, আর ভবিষ্যৎ পরিস্থিতির সূচক একটু বেশি বা ৪৩.৮ শতাংশে অবস্থান করলেও ইতিবাচক পরিস্থিতির জন্য যা থাকা দরকার, তার চেয়ে কম।
বিভিন্ন আর্থসামাজিক অবস্থার ৩৩০ জোন ভোক্তার মধ্যে পরিচালিত এই জরিপে দেখা গেছে, গৃহস্থালি পর্যায়ে ব্যয় নিয়েই বেশি হতাশা মানুষের মধ্যে, এবং তা বর্তমান ও আগামী ছয় মাসের পরিস্থিতি উভয় প্রেক্ষাপটেই। এসব মনোভাব উঠে আসে যে সূচকে, সেই গৃহস্থালি ব্যয় সক্ষমতা ইনডেক্স মাত্র ১ হওয়ার মতো আশঙ্কাজনক স্কোর করেছে।
পণ্যমূল্যের স্তর নিয়েও ভোক্তাদের ধারণা একই রকম মলিন, সূচকে যার মূল্যায়ন হচ্ছে ৭। যেহেতু, নিত্যপণ্যের দাম ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ার ফলে ভোক্তারা যে চাপের মধ্যেই আছেন।
গৃহস্থালি বা পারিবারিক আয়ের আস্থার ইনডেক্স স্কোর হলো ৩৬.২, যা আয়ে কিছুটা স্থিতিশীলতার আভাস দেয়। তবে পরিবারের আর্থিক অবস্থার ৩০.৭ স্কোর ইঙ্গিত দেয়, আয় বাড়ার চেয়ে মূল্যস্ফীতিই বেশি। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির মধ্যেই
\হহারিয়ে যাচ্ছে আয়ের যে কোনো বৃদ্ধি।
অর্থাৎ কোনো ইনডেক্সই ইতিবাচক অবস্থানের জায়গায় পৌঁছতে পারেনি, জাতীয় অর্থনীতির বিষয়ে ভোক্তা মনোভাবের স্কোরও মাত্র ৩৯।
সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক মনোভাব লক্ষ করা গেছে- রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রাম ও ঢাকার ভোক্তাদের মধ্যে, যেখানে সিসিআই জরিপে সবার মতো ৩০ স্কোরেরও নিচে। সে তুলনায়, রংপুরে তা অনেকটাই বেশি বা ৫৪.৬ শতাংশ, যা অঞ্চলটিতে ভোক্তা আস্থা তুলনামূলক শক্তিশালী অবস্থানে থাকার ইঙ্গিত দেয়।
অর্থনৈতিক টানাপড়েনের জন্য রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে দায়ী করেছেন ৪৭.৫ শতাংশ অংশগ্রহণকারী, তবে ২৯.৯ শতাংশ দায়ী করেন সার্বিক অর্থনীতির অবস্থাকে। এর বাইরে বন্যা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ অন্য অনুঘটককে উদ্বেগের গৌণ কারণ হিসেবে মত দেন ভোক্তারা।
শিশুখাদ্যের বিক্রি কমেছে ৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত
বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান নেসলে'র বাংলাদেশে বার্ষিক টার্নওভার প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার, দেশের শিশুখাদ্যের বাজারের ৬০ শতাংশই তাদের দখলে। কফি, নুডলস ও চকোলেটের মতো পণ্যও বাজার নেতৃত্ব দেয় প্রতিষ্ঠানটি।
গত ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর, নেসলে বাংলাদেশের বিক্রিবাট্টা কমেছে ৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত, এমনটাই জানান প্রতিষ্ঠানের কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক দেবব্রত রায়। তিনি বলেন, 'অবশ্য মূল্যস্ফীতির চাপে গত দুই বছর ধরেই বেবি ফুডের বিক্রি কমছিল। সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা এই পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটায়, যার ফলে বিক্রিতে নেগেটিভ গ্রোথ হচ্ছে।'
মুনাফা কমাতে হচ্ছে সুপার মার্কেটগুলোকে
দেশজুড়ে স্বপ্ন এর ৫০০টির বেশি আউটলেট রয়েছে, প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাব্বির হাসান নাসির বলেন, ক্রমবর্ধমান সংখ্যক গ্রাহক তাদের পছন্দের স্বাস্থ্য-বান্ধব খাবার বা বিভিন্ন প্রিমিয়াম আইটেম বাজারের থলে থেকে বাদ দিচ্ছেন, কারণ তাদের একটা বাজেটের মধ্যে চলতে হচ্ছে।
কম দামের বিকল্প পণ্য ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য কেনার দিকে মানুষের এই ঝোঁক সাধারণত প্রতিকূল সময়গুলোয় লক্ষ করা যায়। যেমন আমদানি করা অ্যাপল সিডার ভিনেগার, দামি নারিকেল তেল, সূর্যমুখীর তেল ও বিভিন্ন ধরনের বাদামের বিক্রি কয়েক বছর ধরে বাড়ার পরে এখন তাতে খাড়া পতন দেখা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, টাকা সাশ্রয়ের জন্য অনেকেই এখন প্যাকেটজাত পণ্যের বদলে খোলা পণ্য কিনছেন। দামি ব্যক্তিগত প্রসাধনী, লাইফস্টাইল প্রোডাক্টসহ সাধারণ ভোগ্যপণ্যের বিক্রিতেও ধস দেখা যাচ্ছে বলে জানান নাসির।
জুতার পেছনে আগের মতো খরচ করছে না ক্রেতা
অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ কাজুরি বলেন, গত দুই বছর ধরে গ্রাহকদের টানাটানি খুব স্পষ্টভাবেই লক্ষ করছি আমরা, তবে সাম্প্রতিক কয়েক সপ্তাহে তারা খরচের বিষয়ে আরও রক্ষণশীল হয়ে পড়েছেন। সেপ্টেম্বরের শেষে অ্যাপেক্স ফাউন্ডার্স ডে'তে দেশব্যাপী তাদের শাখাগুলোয় বিপুল পরিমাণ গ্রাহককে টানতে বড় মূল্যছাড় দেওয়া হয়। এ বছর এই সেলস ফেস্টিভ্যালের দিন খারাপ আবহাওয়ার কারণে একদিন বাড়ানোও হয়, এরপরও গত বছরের ফাউন্ডার্স ডের চেয়ে সামান্যই ছাড়ায় বিক্রির পরিমাণ। বড় কোনো উৎসব ছাড়া এখন বেশিরভাগ গ্রাহকই নতুন জেতা কেনার কথা সেভাবে ভাবছেন না, অন্তত যতদিন না তাদের ব্যবহৃত জুতাটি বদলানোর প্রয়োজন দেখা দেয় বা বড় মূল্যছাড় পাওয়া যায়।
দিলীপ বলেন, 'বেশিরভাগ মানুষ এখন অপেক্ষাকৃত কম দামের জুতা কিনছে। যেমন আমাদের একজন নিয়মিত গ্রাহক যিনি অনেক বছর ধরে পাঁচ হাজার টাকার জুতা কিনতেন, তিনিও এখন তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকার জুতা কেনেন। বেশিরভাগ গ্রাহকের ক্ষেত্রেই একই অবস্থা।'
ফ্যাশন পণ্যের বিক্রি নেমেছে অর্ধেকে
ফ্যাশন হাউস 'রঙ বাংলাদেশ' এর সিইও সৌমিক দাস বলেন, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় ভারত থেকে কেনাকাটা বা স্থানীয় বাজার থেকে ভারতীয় পণ্যের কেনাকাটা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে, যে কারণে ভালোভাবে প্রস্তুতি নেওয়া কিছু ব্র্যান্ড দুর্গাপূজায় বিক্রিটা ধরে রাখতে পেরেছে। কিন্তু, পূজার পর আবারও বিক্রিতে ধস নেমেছে, কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময় মানুষ নিত্যদিনের চাহিদা মেটানোকেই এখন বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
ফ্যাশনওয়্যারের বিক্রি সাধারণত মাসে যা হয়, তার চেয়ে প্রায় অর্ধেকে নেমেছে বলে জানান ফ্যাশন এন্টারপ্রের্র্নস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আজহারুল হক আজাদ। তিনি জানান, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সময়ে এই খাতের বিক্রি ২০২১ সালের পরে সবচেয়ে কম হয়েছে।